কয়েক দশক ধরে চীনের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে বিস্ময়কর উত্থান বাংলাদেশের জনগণ গভীর আগ্রহের সঙ্গে দেখছে। ১৯৭৫ সালে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর থেকে সম্পর্কের গভীরতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সম্পর্কের একটি প্রধান মাইলফলক ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের বাংলাদেশ সফর। সেই সফরের সময় বাংলাদেশ চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য চুক্তি করে এবং একই সঙ্গে চীন কর্তৃক বাংলাদেশকে ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের আর্থিক প্যাকেজ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে যে এই সময় বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক কৌশলগত অংশীদারত্বের পর্যায়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের নানাবিধ সহযোগিতা রয়েছে। চীন-বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার, যদিও এ ক্ষেত্রে অসম ভারসাম্য রয়েছে, যেটা সংশোধন করা দরকার। বাংলাদেশের অবকাঠামোর উন্নয়নে তাদের সবচেয়ে বড় ভূমিকা রয়েছে। শিক্ষা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে দুই দেশের মানুষের যোগাযোগ দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বর্তমান আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন নতুন বাঁক ও মোড় আসছে। ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও নানা রকম জটিলতা ও চ্যালেঞ্জ আসার ঝুঁকি আছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে যে একটি কঠোর কৌশলগত প্রতিযোগিতা চলছে, তা আরও বৃদ্ধি পেয়ে কৌশলগত উত্তেজনায় রূপান্তরিত হচ্ছে। এটা হয়তোবা নতুন শীতল যুদ্ধের একটি অন্য রূপ। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। আমরা বিআরআইয়ের অন্তর্ভুক্ত একটি দেশ এবং একই সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের কর্তৃক প্রণীত ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের মৌলিক বিষয়গুলো বিশ্বাস করি।
বাংলাদেশ সব উদ্যোগেরই অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সহযোগিতায় বিশ্বাস করে এবং অংশ নিতে আগ্রহী, কিন্তু কোনো সামরিক জোটভুক্ত হতে উৎসাহী নয়। একইভাবে কোনো কৌশলগত উদ্যোগ যদি অন্য কোনো দেশের বিরুদ্ধে হয়, সেটার অংশীদারও বাংলাদেশ হতে চায় না। তবে বর্তমানে যে কৌশলগত পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে, তাতে বিশ্ব আবার ওই নতুন শীতল যুদ্ধের অধীনে দুই ভাগে বিভক্ত হতে পারে। একদিকে চীন ও সমমনা দেশগুলো, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব। বাংলাদেশ কৌশলগত নিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করে এবং আমাদের যেকোনো মূল্যে জাতীয় স্বার্থে এই কৌশলগত স্বকীয়তা বজায় রাখতে হবে।
আঞ্চলিক, দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রেও নতুন টানাপোড়েন দেখা যাচ্ছে। আমাদের কাছাকাছি যদি আমরা দৃষ্টিপাত করি, তাহলে সবচেয়ে উদ্বেগের কারণ হচ্ছে, চীন ভারত সম্পর্ক, বিশেষ করে তাদের বিরাজমান সীমান্তের অমীমাংসিত বিষয়গুলো। মাঝেমধ্যেই দুই দেশের মধ্যে সীমান্তে সংঘাত ঘটে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এ ধরনের সম্ভাব্য সংঘাত থেকে আমরা যাতে সম্পূর্ণভাবে সামরিক ও কূটনৈতিক দূরত্ব বজায় রাখি, সে বিষয়ে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। বাংলাদেশ এক চীন নীতিতে বিশ্বাস করে এবং সেই কূটনৈতিক অবস্থানে আমাদের সুদৃঢ় থাকতে হবে।
চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ধারাবাহিকতায় নতুন নতুন বিষয় খুঁজে বের করার প্রয়োজন আছে। প্রচলিত সহযোগিতা ছাড়াও, বিশেষ করে বর্তমান বিশ্বে যে অভূতপূর্ব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি হয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে আমাদের নতুন সহযোগিতার পথ খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের উচিত হবে, চীনের কাছ থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিকস, ডেটাপ্রযুক্তি, ফিন্টেক, মেটাভারস, অন্যান্য প্রযুক্তির সাহায্য এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরের দ্বার উন্মুক্ত করা।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য আমাদের এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। এ ক্ষেত্রেও আমরা চীনের সহযোগিতা চাইতে পারি। এ ছাড়া বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক কৃষিনির্ভর দেশ। এসব ক্ষেত্রে চীনের যে বড় ধরনের অগ্রগতি হয়েছে, তা থেকে আমরা শিক্ষা ও সহযোগিতা পেতে পারি। বাংলাদেশের ভূকৌশলগত অবস্থানের কারণে, বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরের প্রবেশমুখে যে দ্বার আমরা নিয়ন্ত্রণ করি, তার কারণে বাংলাদেশ কৌশলগতভাবে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমান বিশ্ববাস্তবতায় ভারত মহাসাগর, তথা বঙ্গোপসাগরের গুরুত্ব যেহেতু বেড়েছে তাই আমাদের এই অবস্থানকে জাতীয় স্বার্থে কাজে লাগাতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে বিআরআই ও বিসিআইএম করিডরের একটি বড় ভূমিকা থাকবে। তা ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশের ওপর আসছে, তা মোকাবিলা করার জন্য চীনের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। তবে এখানে উল্লেখ করার প্রয়োজন আছে যে আঞ্চলিক সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে চীনের কাছ থেকে আমরা আরও বেশি সহযোগিতা ও ভূমিকা আশা করেছিলাম, কিন্তু আশানুরূপ ফল এখনো পাইনি।
চীন বর্তমান বিশ্বের একটি উদীয়মান পরাশক্তি। আমরা চীন, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বে আমাদের বন্ধুদের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক বজায় রাখতে চাই। এই কূটনৈতিক সম্পর্কের ভারসাম্যই বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক ফল নিয়ে আসতে পারে।
লেখক: বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি