ফিরে দেখা সময়
কয়েক শ বানভাসি মানুষ জটলা বেঁধে দাঁড়িয়ে আছেন ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ের সামনে। তাঁরা যেন ভেতরে ঢুকতে না পারেন, সে জন্য ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারপরও ত্রাণপ্রত্যাশী বন্যার্ত মানুষ সরেননি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সুউচ্চ লোহার ফটকের সামনে হাত পেতে দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁরা। ত্রাণ পেতে কেউ কেউ জনপ্রতিনিধিদের দৃষ্টি আকর্ষণেরও চেষ্টা করেন।
এমন দৃশ্যের দেখা পেয়েছিলাম চলতি বছরের ২১ জুন। ঘটনাস্থল ছিল সিলেট সদর উপজেলার কান্দিগাঁও ইউনিয়ন কার্যালয়। তখন বন্যার পানিতে ভাসছে সিলেট। প্রায় ঘরেই হাঁটু থেকে কোমরসমান পানি। খাদ্যসংকটে ধুঁকছিলেন মানুষজন। দীর্ঘক্ষণ ইউপি কার্যালয়ের সামনে ত্রাণের অপেক্ষায় থাকা বানভাসি মানুষ একসময় শূন্য হাতে, হতাশ মনে বাড়ি ফিরে যান। ত্রাণ না পাওয়াদের একজন পঁচিশ বছরের তরুণী শিরিন আক্তার।
ফটকের সামনের ভিড়বাট্টা থেকে সামান্য দূরে শিরিন দাঁড়িয়ে ছিলেন। সংবাদ-সংক্রান্ত কাজ শেষে যখন ফিরতি পথে পা বাড়াব, তখনই তাঁকে দেখতে পাই। এগিয়ে গিয়ে কথা বলি। শুরুতে আড়ষ্টতা ভেঙে খাদ্যসংকটের বিষয়ে কথা বলতে সংকোচ হচ্ছিল তাঁর। পরে কী মনে করে তিনি কথা বলতে শুরু করেন। নিজের জীবনের দুঃখগাথা বলতে বলতে শিরিনের কণ্ঠ ক্রমে ভারী হতে থাকে।
শিরিন জানান, মার্চ মাসে তাঁর স্বামী ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। স্বামী একটি লন্ড্রিতে কাজ করতেন। হঠাৎ স্বামীর মৃত্যুতে দুই মেয়েকে নিয়ে অকূল সাগরে পড়েন তিনি। সন্তানদের মুখে ভাত তুলে দিতে তিনি একটি ফাস্টফুড তৈরির প্রতিষ্ঠানে আলু ও পেঁয়াজ কাটার চাকরি নেন। দৈনিক ৩০ কেজি করে মোট ৬০ কেজি আলু ও পেঁয়াজ তাঁকে কাটতে হয়। এতে মাস শেষে বেতন হিসেবে পান পাঁচ হাজার টাকা। এভাবে সংসার ঠিকঠাক চলছিল না। এর মধ্যে বন্যাকবলিত হওয়ায় বিপদ আরও বেড়ে গেছে। ইউনিয়ন পরিষদে ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে, এমন খবর শুনে এসেছেন। তবে তাঁর ভাগ্যে ত্রাণ জোটেনি।
শিরিনের সঙ্গে কথা শেষে অফিসে ফিরি। কিন্তু কাজে মন বসাতে পারছিলাম না। বারবার চোখে ভাসছিল শিরিনের করুণ চাহনি। ঘটনার কয়েক দিন পরও তাঁকে কোনোভাবেই ভুলতে পারছিলাম না। বিষয়টি আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। এক সকালে লিখতে শুরু করি তাঁর দুঃখগাথা। সেটি পাঠিয়ে দিই প্রথম আলোয়। ২৫ জুন তা অনলাইন সংস্করণে ছাপা হয় ‘স্বামী হারানো তরুণী শিরিনের বিপদ আরও বাড়িয়েছে বন্যা’ শিরোনামে। এরপর অনেকেই শিরিনের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন। আমার ভেতরেও স্বস্তি ফেরে।
স্বস্তি ফেরার এমন অনুভূতি অনেকবারই ঘটেছে সাংবাদিকতা জীবনে। ২০০৪ সাল থেকে অদ্যাবধি, প্রথম আলোয় ১৮ বছর ধরে কাজ করছি। কতশত মানবিক বিপর্যয় দেখেছি, লিখেছি—তা বলে শেষ করা যাবে না। চলতি বছরের হিসাব কষলেই প্রথম আলোর ছাপা ও অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত এমন অন্তত শতাধিক প্রতিবেদনের কথা বলা যাবে, যেসবের সূত্র ধরে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সহায়তায় হৃদয়বান ব্যক্তিরা এগিয়ে এসেছেন।
চলতি বছর ছাপা হওয়া এমন দুটি প্রতিবেদনের বরং উদাহরণ দিই। ২৪ জুন অনলাইনে লিখেছিলাম, ‘কখন ঘর হেলে পড়ে, এই চিন্তায় ঘুম আসে না পঞ্চাশোর্ধ্ব আমিরুনের’। সংবাদ পড়ে পরদিনই তাঁর কাছে ছুটে যান স্থানীয় সংসদ সদস্য। ২৫ জুন একরাশ আনন্দ নিয়ে ফলোআপ লিখি, ‘নতুন ঘর পাচ্ছেন বিশ্বনাথের সেই আমিরুন’। ১৪ আগস্ট প্রকাশিত হয় আমার প্রতিবেদন ‘মায়ের ওষুধ কিনমু না মাইয়ার লাগি দুধ কিনমু, ধন্দে থাকি’। শামীম নামের যে যুবককে নিয়ে এ প্রতিবেদন, সহৃদয়বান এক ব্যক্তির সহায়তায় কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর জীবন বদলে যায়। ৩১ আগস্ট এ ঘটনার ফলোআপ এভাবে ছাপা হয়, ‘ঋণ থেকে দায়মুক্ত হয়ে উচ্ছ্বসিত সিলেটের রিকশাচালক শামীম’।
প্রথম আলোয় আমার ১৮ বছরের পেশাগত জীবনে অসংখ্য শিরিন, আমিরুন কিংবা শামীমদের সুখ-দুঃখের যে গল্প লিখেছি, তা বলে শেষ করা যাবে না। অনিয়ম, দুর্নীতি, সফলতার খবরও সমানতালে লিখেছি। তাই সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে তিক্ত-মধুর অভিজ্ঞতাও তো কম জমা হলো না! তবে সেসব স্মৃতি-আলেখ্য কখনো সবিস্তার লেখার সুযোগ ঘটবে কি না, জানি না!
লেখক: নিজস্ব প্রতিবেদক, সিলেট