পঁচিশের নির্বাচিত
বাংলাদেশ নামক ধাঁধা
প্রথম আলোর বয়স মাত্র ২৫ বছর, কিন্তু এর অর্জন অনন্য। প্রথম আলো তার স্বপ্নের পথে এগোতে এগোতে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে অভূতপূর্ব কিছু মাইলফলক স্থাপন করেছে। সাহসী সাংবাদিকতা, উদ্ভাবনী পরিকল্পনা, দেশ ও বিদেশের অগ্রগণ্য মানুষের সম্পৃক্ততা ছিল এর শক্তি। প্রথম আলোর ২৫ বছরের নির্বাচিত ও সংক্ষেপিত বিষয়বস্তু থেকে পাওয়া যাবে এর স্বতন্ত্র পথরেখার নিশানা।
স্বাধীনতা অর্জনের পাঁচ বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ এমন সব ভয়াবহ ঘটনা-দুর্ঘটনার শিকার হয় যে অনেকের মনে আশঙ্কা হয়েছিল দেশটি টিকে থাকবে কি না। একটি বড় দুর্ভিক্ষ, তিনটি সফল সামরিক অভ্যুত্থান, প্রায় ৩০টি ব্যর্থ অভ্যুত্থান এবং চারটি ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত হেনরি কিসিঞ্জার অভিহিত ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’টি কেমন করে উন্নয়ন ধরে রাখছে? আন্তর্জাতিক বাজিকরেরা বাংলাদেশের ওপর বাজি ধরতে কৌতূহল দেখাচ্ছে। আবার নিরাশাবাদীরা বলছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন আগামী ২০ থেকে ৩০ বছরে ভেঙেও যেতে পারে। অর্থনীতিবিদেরা লক্ষ করছেন, বাংলাদেশ এ পর্যন্ত কোনো ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়নি। আমাদের অবস্থা গ্রিস, সাইপ্রাস, স্পেন বা ইতালির মতো তেমন ঝুঁকিপূর্ণ নয়। বাংলাদেশে জীবন ধারণ করা যায় অতি সহজে, স্বল্প ব্যয়ে। ইঁচা মাছ আর কদু আমাদের কাছে পাঁচতারা সরাইখানার চেয়েও উপাদেয়। সামান্য জীবনোপকরণ নিয়ে বাংলাদেশ একধরনের স্বাচ্ছন্দ্যে রয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের হাসি আজ সবচেয়ে সুখী মানুষের হাসি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
মানুষের জীবন কূটাভাসে ভরা। কৌতুকময় তো বটেই। তাই ঘণ্টা বাজিয়ে দুর্গাপূজাও হয়, আবার ইতু পূজায় ঢাক বাজে। আমরা কৌতূহলে প্রশ্ন করি, ওখানে কে গা? আমরা উত্তর পাই, আমি সর্বময়ী। দাঁড়িয়ে কেন গা? এই প্রশ্নের উত্তর, না, দুটো খুদের জন্য।
আমাদের পিঠ চাপড়ে যেসব মুরব্বি আহ্লাদিপনা করে বলত, ‘বাংলাদেশ একটা মডারেট মুসলিম দেশ।’ তাদের চক্ষু এখন চড়কগাছ! নৃশংসতা ও অসহিষ্ণুতায় বাংলাদেশ কম যায় না। তবে জঘন্য রেকর্ড করা থেকে এখনো বহু দূরে। টালমাটাল পদস্খলন সামলে নিলে আমরা আবার আকর্ষণীয় প্যারাডক্স হতে পারব। মন্দিরে মন্দিরে কাঁসর-ঘণ্টা বাজবে, নারীরা উলুধ্বনি দেবে। তারা শাঁখ বাজাবে। সামান্য প্রচেষ্টায় দিনবদলের এমন সুযোগ কোথায় পাওয়া যাবে? বাংলাদেশের লোক অন্ধ, মূক বা বধির নয়। জনসংযোগের সুফল হিসেবে এ দেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ সাফল্য লাভ করেছে, বনায়ন ঘটছে, লোকে গাছ লাগাচ্ছে। আঙুর, ড্রাগন ফ্রুট, স্ট্রবেরির মতো নতুন নতুন ফলফলারির চাষ হচ্ছে।
শিশুমৃত্যু রোধে বা শিশুদের বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ নাটকীয় অগ্রগতি সাধন করেছে। বাংলাদেশ নারীর শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সম্প্রসারণ করেছে, নারীর সামাজিক মর্যাদার উন্নতি ঘটিয়েছে, রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা বাড়িয়েছে, স্বাস্থ্যসচেতনতা ও স্থানীয় পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ করেছে।
নরওয়ের অর্থনীতিবিদ ফালান্ড এবং ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ পারকিনসন বাংলাদেশকে উন্নয়নের পরীক্ষাগার বলে তাঁদের বাংলাদেশ টেস্ট কেস ফর ডেভেলপমেন্ট-এ তাঁরা লেখেন, ‘এ রকম পরিস্থিতিতে যদি বাংলাদেশের উন্নয়নের উদ্যোগ সফল হয়, তবে পৃথিবীর যেকোনো দেশেই এ ধরনের উদ্যোগ সফল করা যাবে।’ ২০০৭ সালে তাঁরা বললেন, ‘তিন দশক এবং তার বেশি সময়ের সীমিত ও বর্ণাঢ্য অগ্রগতির ভিত্তিতে মনে হয় বাংলাদেশে টেকসই অর্জন সম্ভব।’
২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের দৈনিক ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল এ ব্যাপারে প্রথম সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে উল্লেখ করে, বাংলাদেশের ইতিবাচক অর্জনগুলো প্রশংসনীয় এবং এটি ক্রমেই অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে ধীরে ধীরে তাদের দারিদ্র্য ও অনুন্নয়ন অবস্থা কাটিয়ে ওঠার দিকে যাত্রা করেছে।
যশোরে ভবদহ এলাকায় জলাবদ্ধতা হয়েছিল ওয়াপদার ভুলে। কিন্তু এর সমাধান হয় স্থানীয় মানুষের আন্দোলন ও উদ্ভাবনার ফলে। জলবায়ু পরিবর্তনের দরুন যখন সমুদ্রের তলে জমি ডুবে যাওয়ার কথা, তখন দক্ষিণাঞ্চলে চাষিদের বুদ্ধিতে সমুদ্রের তল থেকে ভূমি জাগানো সম্ভব হচ্ছে।
এই সামাজিক শক্তির খবর না জানার জন্যই হয়তো ২০০৫ সালে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা তো ‘দ্য পাজল অব বাংলাদেশ’ নামে একটি প্রতিবেদন ছাপে। তার সারমর্ম ছিল, বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ তেমন নেই, নেই সুশাসন, নেই সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব, নেই দূরদর্শী ও জনমুখী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো। রাজনৈতিক ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশের ছায়াসঙ্গী। তারপরও গত দেড় দশকে বাংলাদেশ গড় প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের ওপর ধরে রেখেছে। ২০০৬-০৭ সালে জিডিপি সাড়ে ৬-এর ঘরেও উঠেছিল। মানে না হলেও পরিমাণে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা ভারতকে ছাপিয়ে গেছে। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষায় নারী-পুরুষের বৈষম্য কমানোয় ভারত থেকে এগিয়ে। পাঁচ রকম কারণে শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার ভারত বা চীনসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশের থেকে কম। দারিদ্র্য প্রতিবছর ১ শতাংশ করে হলেও কমছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আত্মবিশ্বাসী করার মতো। জিডিপিতে বিদেশি সাহায্যের ভাগ ৬ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ১ দশমিক ৮ শতাংশ।
কীভাবে এই গতিশীলতা সম্ভব হচ্ছে, তা সমাজবিজ্ঞানীদের কাছে একটা ধাঁধা। তাঁদের বিস্ময়ের কারণ, এ দেশের সাধারণ মানুষ আসলে কৃষির মানুষ, মাটির মানুষ। দুই হাত আর মাটির ওপর বিশ্বাস রেখে প্রতিবছর খাদ্য উত্পাদন ৩ শতাংশ করে বাড়িয়ে যাচ্ছে। এই বৃদ্ধি জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারকে ছাপিয়ে যাওয়ায় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা এসেছে। অথচ একদিকে সার-বিদ্যুৎ-পানি-বীজ-ঋণের জন্য মনুষ্যশক্তির সঙ্গে, অন্যদিকে বন্যা-খরা-মড়কের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক শক্তির সঙ্গে কী প্রাণান্ত লড়াই-ই না করতে হয় কৃষকদের।
যেসব সামাজিক ক্ষেত্রে দেশের সাফল্য এসেছে, রাজনীতিবিদেরা সেখানে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াননি। দেশটা চলছে সাধারণ মানুষের উদ্যোগ আর জীবনীশক্তির বদৌলতে। সামাজিক এই পুঁজিই আমাদের প্রধান সম্বল। বাংলাদেশ নামক ধাঁধার উত্তর।
রাজনীতিতেও দেখা যাবে যে সাধারণ মানুষ ক্ষমতার কামড়াকামড়ি চায় না, দুর্নীতির বিরুদ্ধে তারাই কখনো কখনো সবচেয়ে বেশি সোচ্চার। কানসাট, ফুলবাড়ী, শনির আখড়া ও আড়িয়ল বিলে জনমানুষের প্রতিবাদ অন্যায় ও দুর্নীতি ঠেকিয়েছে। সন্ত্রাস ও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাড়তে থাকা সামাজিক আন্দোলনও নাগরিক চেতনার আর এক প্রমাণ।
বাংলাদেশের রয়েছে ১৬ কোটির এক বিশাল জনগোষ্ঠী। এর মধ্যে কর্মক্ষম জনসংখ্যা আছে ৫ কোটি ৬০ লাখ। জনসংখ্যা বাড়ছে ১ দশমিক ৫ শতাংশ হারে, কিন্তু কর্মক্ষম জনসংখ্যা বাড়ছে ২ দশমিক ৮ শতাংশ হারে। দেশে তরুণদের সংখ্যা বয়স্কদের তুলনায় অনেক দিন বেশি থাকবে। বিশ্বব্যাংকের মতে, এই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতিক লভ্যাংশকে কাজে লাগাতে হলে জনশক্তিকে আরও দক্ষ করতে হবে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের প্রবৃদ্ধি হতে হবে কর্মসংস্থানমুখী। কারণ, এ দেশের মূল সম্পদই হলো জনশক্তি। সৌভাগ্যক্রমে মোট জনসংখ্যার বড় অংশই যুবক। একে কাজে লাগাতে হবে অধিকতর প্রবৃদ্ধি অর্জনের। কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন কৌশল অনেক বেশি কার্যকর হবে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে এবং প্রবৃদ্ধির সুফল বিরাট জনগোষ্ঠীর মধ্যে বণ্টিত হবে। সার্বিকভাবে যেসব খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে, যেমন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত। উচ্চতর প্রবৃদ্ধি ও এর সুষ্ঠু বণ্টনের স্বার্থে এসব খাতকে আরও গতিশীল করতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে তথ্যপ্রযুক্তি, ছোট-মাঝারি ও কৃষিপণ্যভিত্তিক শিল্পে স্বল্প বিনিয়োগের মাধ্যমে দ্রুত কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধি ও আর্থসামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।
নানা প্রতিকূলতা, যেমন মাথাপিছু জমি ও সম্পদের অপ্রতুলতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণতা, সুশাসনের অভাব এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা অতিক্রম করেও এতখানি উন্নতি সম্ভব হয়েছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সুশাসনের অনুপস্থিতিতে শুধু কৃষক, শ্রমিক ও ব্যক্তি উদ্যোগে কত দূর উন্নয়ন সম্ভব, বাংলাদেশ তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
১৪ এপ্রিল ২০১৩ (সংক্ষেপিত)