ঢাকা মেডিকেলে সেসব দিন
২০২৪ সালের ১৮ জুলাই, সন্ধ্যা সাতটা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চারটি নিথর দেহ পড়ে আছে। চিকিৎসকেরা পরীক্ষা করে জানালেন, তাঁরা আর বেঁচে নেই। চারটি মরদেহই এসেছে যাত্রাবাড়ী থেকে।
ঠিক ১০ মিনিট পর এক তরুণী সেখানে এলেন। যে চারটি নিথর দেহ পড়ে আছে, সেগুলোর মধ্যে একটি তাঁর স্বামীর। তিনি জানতে চাইলেন, স্বামী বেঁচে আছেন কি না। সবাই নীরব। তরুণী বুঝে গেলেন, তাঁর স্বামী বেঁচে নেই। চিৎকার করে বললেন, ‘আমার স্বামী মরতে পারে না। আমি লাশ নেব না।’
বিলাপ করতে করতে মূর্ছা যাচ্ছিলেন ওই তরুণী। একপর্যায়ে জানালেন, দুপুরে খাবার খাওয়ার পর স্বামীকে আম কেটে দিয়েছিলেন। সেই আম খেয়েই যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ থেকে পুরান ঢাকার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে যাচ্ছিলেন তিনি। পথে সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর স্বামীর নাম কাজী নাজমুল হোসেন। পেশায় বেসরকারি চাকরিজীবী।
অপরাধবিষয়ক সাংবাদিকতা করার কারণে এমন অনেক ঘটনায় স্বজনদের আহাজারি দেখেছি। পেশাগত কারণেই নিজেকে মানসিকভাবে শক্ত রেখে এ ধরনের ঘটনায় সংবাদ পরিবেশন করা আমার জন্য স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু সেদিনের ওই ঘটনায় আমি স্বাভাবিক থাকতে পারিনি। ওই নারী যখন তাঁর স্বামীর মৃত্যুতে আহাজারি করছিলেন, আমি ভাবছিলাম, আমারও এমন পরিণতি হতে পারত অথবা হতে পারে। যদি এমন হয়, তাহলে আমার স্ত্রীও (তাকিয়া সুলতানা) নিশ্চয়ই এমন আহাজারিই করত।
সেদিন আমার মনে এই ভাবনা এসেছিল দুটি কারণে। প্রথমত, সেদিন আমার স্ত্রী তাকিয়া সকালে খাওয়ার পর আম কেটে দিয়েছিল। আমিও আম খেয়ে বাসা থেকে বের হয়েছিলাম। দ্বিতীয়ত, বাসা থেকে ১০০ মিটার দূরে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সামনে শিক্ষার্থী ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ চলছিল। সেই পথ পেরিয়ে আমাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেতে হয়েছিল। সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে বা গুলিতে আমারও মৃত্যু হতে পারত। সেদিন আমার স্ত্রী আমাকে বাসা থেকে বের হতে দিতে চায়নি।
১৮ জুলাই ঢাকাসহ সারা দেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যাপক বলপ্রয়োগ করছিল। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে নির্বিচার গুলি চলেছে। দুপুর থেকে নিহত ও আহত ব্যক্তিদের নিয়ে ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগের সামনে একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স, অটোরিকশা ও রিকশা এসে থামছিল। মানুষগুলোর অধিকাংশই ছিলেন গুলিবিদ্ধ। তাঁদের কেউ মারা গেছেন, আবার কেউ ছিলেন আশঙ্কাজনক অবস্থায়। ওই দিন শুধু ঢাকা মেডিকেল কলেজে ২৩ জনের লাশ এসেছিল।
১৮, ১৯, ২০ ও ২১ জুলাই—এই চার দিন ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে একইভাবে গুলিতে নিহত ও আহত মানুষকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে আনা হয়েছিল। চার দিনই আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজে আসা মরদেহ এবং আহত মানুষের খবর সংগ্রহ করেছি। আমি দেখেছি মানুষের আহাজারি। আমি নিজেও হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম। তবু মরদেহ গুনেছি।
একটি হৃদয়বিদারক ঘটনার সাক্ষী হলাম ২০ জুলাই সন্ধ্যায়। পুলিশ কর্মকর্তা ময়নুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী ছেলের লাশের খোঁজে বিকেল পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজে ছোটাছুটি করছিলেন। নিহত ব্যক্তিদের তালিকায় ছেলের নাম আছে কি না, সেটি খুঁজতে থাকেন। সন্ধ্যা সাতটার দিকে একজন তাঁকে পরামর্শ দেন লাশঘরে (জরুরি বিভাগের মর্গ) খুঁজে দেখতে। তিনি সেখানে গিয়ে ছেলের মরদেহ খুঁজে পান।
ময়নুল ইসলাম সন্তানের শরীরে শত শত ছররা গুলির চিহ্ন দেখে মুঠোফোনে অপর প্রান্তে থাকা এক ব্যক্তিকে বলতে থাকেন, ‘একজনকে মারতে কত গুলি লাগে, স্যার।’ পরে জানা যায়, অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তি একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা।
মৃত্যুভয় এবং উৎকণ্ঠার ২০ দিন
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরু হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে। আন্দোলনকারীদের দমন করতে শুরুতেই বলপ্রয়োগের পথ বেছে নিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। ১৫ জুলাই দুপুরের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি চত্বর এলাকায় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ বহিরাগতরা। ওই হামলার সময় সেখানেই ছিলাম। দেখেছি, কী নির্মমভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পেটানো হয়েছে। বাদ দেওয়া হয়নি ছাত্রীদেরও।
১৬ জুলাই দেশের বিভিন্ন জেলায় নিহত হন ছয়জন। ওই দিনই রংপুরে আবু সাঈদকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার পর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও মাঠে নামেন। এর মধ্যে মেরুল বাড্ডায় ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সামনে শিক্ষার্থীরা অবরোধ করেন। পুলিশের বলপ্রয়োগের কারণে এই এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। আমার বাসা ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ঠিক উল্টো দিকে একটি ভবনের সাততলায়। সেখান থেকে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সামনে কী হচ্ছে, সব দেখা যায়। ১৮ থেকে ২১ জুলাই এবং পরে ৪ ও ৫ আগস্ট ওই এলাকায় ব্যাপক গুলি ছোড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এসব দৃশ্য দেখে আমার স্ত্রী তাকিয়া সুলতানা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। সে আমাকেও বাইরে যেতে দিতে চাইত না। কিন্তু আমি তাকে নানা কৌশলে বুঝিয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য বের হতাম। বিভিন্ন জায়গা থেকে খবর পাচ্ছিলাম ছাত্র–জনতাকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে ছোড়া গুলিতে বারান্দা, ছাদ, এমনকি ঘরে থাকা মানুষ গুলিবিদ্ধ হচ্ছেন, মারা যাচ্ছেন। আমার স্ত্রীকে বলেছিলাম, ‘তুমি বারান্দায় যেয়ো না।’
১৯ জুলাই দিবাগত রাত থেকে সারা দেশে কারফিউ জারি করা হয়। ওই সময় কারফিউ পাস (অনুমোদনপত্র) নিয়ে বিভিন্ন স্থানে গিয়েছি। সেই সময় বাইরের পরিবেশ ছিল ভীতিকর।
১৮ থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত বাসায় বসে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সামনের ঘটনাগুলো দেখে আমার স্ত্রী মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। অন্যদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দৃশ্যগুলো দেখে আমিও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। এর মধ্যেই ২২ থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত মৃত্যুর তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করি। আমার ও আমার স্ত্রীর মানসিক অবস্থা বিবেচনায় প্রথম আলো আমাকে কয়েক দিনের ছুটি দেয়।
৫ আগস্ট সকালে মেরুল বাড্ডায় ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সামনের এলাকায় পুলিশ ও ছাত্র–জনতার মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হচ্ছিল। সাড়ে ১০টার দিকে আমি বাসা থেকে বের হওয়ার আগে আমার স্ত্রী বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কোনোভাবেই সে আমাকে বাইরে যেতে দেবে না। আমি তাকে বুঝিয়ে অফিসের উদ্দেশে রওনা দিই। বেলা দুইটার পর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের খবর ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্র–জনতার বিজয় হয়, তা বহু মানুষের রক্তের বিনিময়ে।
* আহমদুল হাসান: নিজস্ব প্রতিবেদক, প্রথম আলো