রাজা এবং তাঁর তিন কন্যার গল্প আমাদের অনেকের জানা। লোককথার সেই গল্পে রাজার ছোট মেয়ে তাঁকে বলেছিল, সে রাজাকে নুনের (লবণ) মতো ভালোবাসে। রাজা তাকে ভুল বুঝে বনবাসে পাঠিয়েছিলেন। পরে অবশ্য রাজা তাঁর মেয়ের কথা ও লবণের গুরুত্ব—দুটোই বুঝতে পেরেছিলেন।
লবণ আসলে ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা বুঝতে হলে বিশেষ কোনো পরীক্ষার প্রয়োজন হবে না। একদিন লবণ ছাড়া খাবার খেলেই তা খুব পরিষ্কার হয়ে যায়। খাবার ছাড়াও বিভিন্ন শিল্পে এই লবণের ব্যবহার করা হয়। তবে সাগরের নোনাজল থেকে এই লবণ কীভাবে মানুষের ঘরে এল, তার ইতিহাস অনেক পুরোনো।
বিভিন্ন ইতিহাস প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, হাজার হাজার বছর আগে থেকে মানুষ খাদ্যে লবণের ব্যবহার করে আসছে। তবে সেই লবণ এখনকার মতো সমুদ্রের পরিশোধিত ছিল না। তখন লবণ সংগ্রহ করা হতো খনি থেকে। পোল্যান্ড, তুরস্ক, বলিভিয়াসহ আরও বেশ কিছু দেশে এখনো লবণের খনির দেখা মেলে।
সাধারণ লবণ দেখতে সাদা হলেও খনি থেকে তোলা লবণ বিভিন্ন রঙের হতে পারে। সাদা লবণ মূলত সমুদ্রের পরিশোধিত লবণ। ধারণা করা হয়, খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ৬০০০ সালের দিকে বর্তমান রোমানিয়া অঞ্চলে বসবাসকারী লোকেরা লবণ আহরণের জন্য সাগরের পানি সেদ্ধ করে লবণ উৎপাদন করত।
সেই প্রাচীন আমল থেকেই পৃথিবীতে লবণের ব্যবহার শুরু হয়েছে। আর ভারতীয় উপমহাদেশে লবণশিল্পের বিকাশের শুরু মোগল আমলে, যার শুরুটা সমুদ্রে ঘেরা চট্টগ্রাম থেকেই। আর সমুদ্রের পাড়ে এই চট্টগ্রামে শুরুর দিকে লবণের চাষ শুরু করেছিল ‘মুলঙ্গী’ সম্প্রদায়ের লোকেরা।
‘মুলঙ্গী’দের হাতে যাত্রা শুরু: মোগল আমলে চট্টগ্রাম ও সন্দ্বীপের উপকূলীয় এলাকায় ‘মুলঙ্গী’ সম্প্রদায়ের লোকেরা বসবাস করত। তারা সমুদ্রের পানি সেদ্ধ করে লবণ উৎপাদন করত। তাদের লবণ উৎপাদনের ক্ষেত্রকে বলা হতো ‘তোফল’।
সে আমলে এই লবণশিল্প নিয়ন্ত্রণ করত ‘নিমক জায়গির মহাল’ ও ‘নিমক এয়জ মহাল’ নামের দুটি সরকারি বিভাগ। নিজামপুর, জুলদিয়া ও বাহারছড়া—এই তিনটি চাকলার অধীনে মোট ৩৯টি লবণ সংগ্রহক্ষেত্র ছিল। ষোড়শ শতকে লবণ উৎপাদনকারীদের সরকারি খাতে মাশুল দিতে হতো বলে জানা যায়।
মোগল আমল পর্যন্ত লবণশিল্পে সরকারের একচেটিয়া আধিপত্য ছিল। এর ব্যবস্থাপনা ছিল জমিদার শ্রেণির অধীনে। জমিদাররা লবণচাষিদের দিয়ে লবণ উৎপাদন করার জন্য স্থানীয় ব্যবসায়ীদের দাদন দিতেন। তবে ১৭০০ সালের মাঝামাঝি সময়ে এই শিল্পে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। সে সময় এই ব্যবসায় যোগ দেন ইংরেজ শাসকেরা।
ইংরেজদের হস্তক্ষেপ ও আন্দোলন: ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৫ সালের মধ্যে এই লবণশিল্পের সঙ্গে পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে ইংরেজরা। ইংরেজদের উদ্যোগে ১৭৬৫ সালে লবণের বণিক সমিতি গঠিত হয়। এতে লাভবান হন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তারা। ইংল্যান্ডের লিভারপুল শহর থেকে লবণ আমদানি শুরু করে ইংরেজরা।
একসময় লবণের ওপর বাড়তি কর আরোপ করতে থাকে তারা। এরপর ব্রিটিশ সরকার সামুদ্রিক লবণ উৎপাদন করা দণ্ডযোগ্য অপরাধ বলে ঘোষণা করে। এ সময় মুলঙ্গী সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ লুকিয়ে স্বল্প পরিমাণে লবণ উৎপাদন করত। লবণের ওপর অতিরিক্ত কর, বিদেশ থেকে লবণ আমদানি ও ভারতে লবণ উৎপাদন নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে দেশীয় লবণশিল্পকে ধীরে ধীরে ধংস করা হয়।
১৯ শতকের শুরুর দিকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন অনেকটা তীব্র। সে সময় লবণ ব্যবসায় ব্রিটিশদের একচেটিয়া আধিপত্য ও লবণনীতির বিরুদ্ধে একটি পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যা লবণ পদযাত্রা বা ‘লবণ সত্যাগ্রহ’ নামে পরিচিত। ইংরেজিতে একে ‘সল্ট মার্চ’ বলা হয়ে থাকে।
১৯৩০ সালের ১২ মার্চ হওয়া এই পদযাত্রা ছিল ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আর এর নেতৃত্ব দিয়েছেন স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর লবণশিল্প আবার বিকশিত হতে শুরু করে।
মোগল-ব্রিটিশ পেরিয়ে চট্টগ্রামের লবণ: নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বাংলাদেশের লবণশিল্পে এখনো নেতৃত্ব দিচ্ছে চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম বিভাগের চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলা থেকেই বাংলাদেশের ৭০ থেকে ৮০ ভাগ লবণ সরবরাহ করা হয়। বাংলাদেশে লবণশিল্পের শুরুটা চট্টগ্রাম নগরের স্ট্যান্ড রোড থেকে। ব্যবসায়ী ও লবণ মিল মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ১৯৫০ সালের দিকে প্রথম এই স্ট্যান্ড রোড এলাকায় লবণের মিল স্থাপন করা হয়। তবে সে সময়কার কেউ এখন বেঁচে নেই। তাঁদের বংশধরেরা এখন এই ব্যবসা পরিচালনা করছেন। তাঁদের একজন এম এন কবির অ্যান্ড ব্রাদার্স সল্ট মিলের স্বত্বাধিকারী মো. নুরুল কবির। বর্তমানে চট্টগ্রাম লবণ মিল মালিক সমিতি ও বাংলাদেশ লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতির দায়িত্বও পালন করছেন তিনি।
‘সে সময় এত আধুনিক প্রযুক্তি ছিল না। সমুদ্রের পানি সেদ্ধ করে লবণ তৈরি করা হতো। এরপর সেগুলো পরিশোধন করা হতো। প্রথম দিকে এভাবেই খাবার লবণ তৈরি হতো। এরপর আসে জাঁতাকল; সময়ের পরিক্রমায় এখন আধুনিক প্রযুক্তির ভ্যাকুয়াম পদ্ধতি।’ কথাগুলো বলছিলেন চট্টগ্রাম নগরের লবণ ব্যবসায়ী মো. নুরুল কবির। চট্টগ্রাম নগরের মাঝিরঘাট স্ট্যান্ড রোড এলাকায় তাঁর লবণের কারখানা। কক্সবাজার ও বাঁশখালীর লবণচাষিদের কাছ থেকে অপরিশোধিত লবণ সংগ্রহ করে তা পরিশোধন করা হয় তাঁর কারখানায়।
নুরুল কবির জানান, তাঁর বাবা ১৯৫৮ সালের দিকে এই লবণের মিলটি স্থাপন করেছিলেন। সে সময় হাজী সল্ট নামে কারখানাটি চালু হয়েছিল। এরপর ১৯৮০ সালের দিকে দায়িত্ব নেন মো. নুরুল কবির। এরপর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় এম এন কবির অ্যান্ড ব্রাদার্স সল্ট মিল।
নগরের পাশাপাশি চট্টগ্রাম পটিয়া উপজেলার ইন্দ্রপুলে পরিশোধন করা হয় লবণ। পটিয়া সদরের ইন্দ্রপুলের মধ্য দিয়ে আঁকাবাঁকা ধীরগতিতে বয়ে গেছে চানখালী খাল। এই খালকে কেন্দ্র করে ইন্দ্রপুল এলাকায় লবণশিল্প গড়ে ওঠে।
১৯৫০ সালের শুরুর দিকে চানখালী খালের পাড়ে লবণশিল্পের সূচনা হয় বলে জানা যায়। তখনকার দিনে এই এলাকায় কোনো লবণের কারখানা ছিল না। সাম্পানে করে বাঁশখালী এলাকা থেকে কালো লবণ এনে তা ইন্দ্রপুলে বিক্রি করা হতো। পটিয়া লবণ মিল মালিক সমিতির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও মোহাম্মদী সল্ট কারখানার স্বত্বাধিকারী মুহাম্মদ জসিম উদ্দিন জানান, ১৯৫০ সালেরও আগে ইন্দ্রপুলে এলাকায় লবণের কেনাবেচা শুরু হয়। সে সময় জাঁতাকলের মাধ্যমে লবণ পরিশোধন করা হতো।
বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তি এসেছে। জানা গেছে, চট্টগ্রাম নগর ও পটিয়া উপজেলা মিলিয়ে প্রায় ১২০টি পরিশোধন কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে পুরোনো কারখানার পাশাপাশি নতুন যুগের কনফিডেন্স, মোস্তফাসহ আরও বেশ কিছু ভ্যাকুয়াম সল্টের কারখানাও রয়েছে।
বর্তমানে যে অবস্থানে এই শিল্প: চট্টগ্রাম বিভাগে যেটুকু লবণ চাষ হয়, তার অধিকাংশই হয় কক্সবাজার জেলায়। আবার কিছু লবণ চাষ হয় চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায়। আর এই পুরো বিষয়টি তদারক করা হয় বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) পক্ষ থেকে। বিসিক জানায়, প্রায় ৩৯ হাজার চাষি বাঁশখালী ও কক্সবাজার জেলায় লবণ চাষের সঙ্গে জড়িত। ২০২১-২২ অর্থবছরে এই অঞ্চলে লবণ উৎপাদন ছিল ১৮ লাখ ৩২ হাজার টন। চাষ হয়েছিল প্রায় ৫৪ হাজার ৬৫৪ একর জমিতে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে জমির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৬ হাজার ৪২৪ একর। আর উৎপাদিত লবণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২ লাখ ৩৩ হাজার টন।
কক্সবাজার বিসিকে অবস্থিত লবণশিল্পের উন্নয়ন কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক মো. জাফর ইকবাল ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, দিন দিন চাষির সংখ্যা বাড়ছে। উৎপাদনও বেড়েছে। বিসিকের পক্ষ থেকে লবণচাষিদের ঋণ, তথ্য ও সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।
সেই মোগল আমল থেকে শুরু হওয়া চট্টগ্রামের লবণশিল্প এখনো টিকে আছে মাথা উঁচু করে। চট্টগ্রামের মুলঙ্গীদের হাত ধরে আসা লবণ চাষ এখন ছড়িয়ে গেছে বাংলাদেশের অন্যান্য জেলাতেও। নানা চড়াই-উতরাই পার করে বাংলাদেশের অন্যতম একটি শিল্প এই লবণ। তবে খাবার টেবিলে কিংবা রান্নায় লবণ ছিটানোর সময় হয়তো এর বিশাল ইতিহাস টের পাওয়া যায় না। বলা যায়, লবণের ইতিহাস লবণের সৃষ্টিক্ষেত্র সেই সমুদ্রের মতোই বিশাল।