গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন প্রায় ক্ষেত্রেই প্রশংসিত। দেশটি প্রতিবছর ৬ থেকে ৮ শতাংশ স্থির জিডিপি বৃদ্ধির হার অর্জন করেছে, লাখো মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বের করে এনেছে, এর মানব উন্নয়ন সূচকগুলোকে উন্নত করেছে। তবে চিত্তাকর্ষক এ প্রবৃদ্ধির পেছনে একটি অন্ধকার দিক রয়েছে, আর সেটা হচ্ছে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান বেড়েই চলেছে।
দারিদ্র্য–বৈষম্য কমানোসহ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশের নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন লক্ষ্য। অথচ দুই দশক ধরে উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও বাংলাদেশ বৈষম্য সূচকে বৃদ্ধির সাক্ষী হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) গৃহস্থালি আয় ও ব্যয় জরিপ অনুসারে, আয়ের জিনি সহগ ( যা আয়বৈষম্যের একটি জনপ্রিয় পরিমাপ) ২০০০ সালে শূন্য দশমিক ৪৫০ থেকে ২০২২ সালে শূন্য দশমিক ৪৯৯-তে উন্নীত হয়েছে। সম্পদের বৈষম্যের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও খারাপ। অক্সফামের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২১ সালে সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশ বাংলাদেশি জাতীয় সম্পদের ১৬ দশমিক ৩ শতাংশের মালিক ছিলেন। আর সবচেয়ে দরিদ্র ৫০ শতাংশ মানুষের মালিকানা ছিল মাত্র ৮ দশমিক ৬ শতাংশ।
প্রকৃত অর্থনৈতিক বৈষম্যের চিত্র পরিসংখ্যান ব্যুরোর সমীক্ষার চেয়ে খারাপ বলে মনে করা হয়। কারণ এই গৃহস্থালি জরিপগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অতিধনী পরিবারের তথ্য সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়। যদিও তথ্য–সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ক্রমবর্ধমান বৈষম্য সূচকটি এ বাস্তবতাকে তুলে ধরে যে সমাজের ধনিক অংশ গত দুই দশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দ্বারা বেশি উপকৃত হয়েছে এবং দেশে সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রক্রিয়া সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে।
বাংলাদেশে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে অব্যাহতভাবে বেড়ে চলা আয়ের বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে উপযুক্ত নীতি গ্রহণের জন্য বৈষম্যের কারণগুলো বোঝার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আয়বৈষম্য বৃদ্ধির জন্য বেশ কিছু কারণকে দায়ী করা যেতে পারে।
এক. জমি ও সম্পদের অসম বণ্টন, যা উৎপাদনশীল সম্পদ ও সুযোগে দরিদ্রদের অধিকার সীমিত করে।
দুই. প্রগতিশীল কর এবং প্রয়োজনীয় সামাজিক সুরক্ষা নীতির অভাব, যা ধনী থেকে দরিদ্রদের মধ্যে আয় ও সম্পদ পুনর্বণ্টন করতে ব্যর্থ হয়।
তিন. কিছু অভিজাত শ্রেণির হাতে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা, যারা তাদের প্রভাব ব্যবহার করে অতি মুনাফা, ভর্তুকি, চুক্তি ও তাদের স্বার্থের অনুকূল নীতিগুলো দখল করে।
চার. শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানি, স্যানিটেশন ও অবকাঠামোর মতো সরকারি পরিষেবার প্রয়োজনের তুলনায় অভাব ও নিম্নমান, যা সামগ্রিক মানব উন্নয়ন ও দরিদ্রদের উন্নয়নকে ব্যাহত করে।
পাঁচ. নারী, জাতিগত সংখ্যালঘু, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও গ্রামীণ অধিবাসীর মতো প্রান্তিক গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে বৈষম্য, যারা অধিকার, ন্যায়বিচার ও সুযোগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হয়।
বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্য সামাজিক–অর্থনৈতিক উন্নয়নে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। এটি সামাজিক সংহতি ও বিশ্বাসকে ক্ষুণ্ন করে, অসন্তোষ ও সহিংসতাকে উসকে দেয়, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও জবাবদিহিকে ক্ষয় করে, দারিদ্র্য হ্রাস ও মানব উন্নয়নে বাধা দেয়, অর্থনৈতিক দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা হ্রাস করে এবং পরিবেশগত ভারসাম্যকে হুমকির মুখে ফেলে।
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, গত দুই দশকে রাজস্বনীতিকে আয়বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে যথাযথভাবে ব্যবহার করা যায়নি। সরকারের রাজস্বনীতির দুটি প্রধান দিক আয়বৈষম্য মোকাবিলার জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক। এগুলো হলো রাজস্ব আহরণ (বিশেষ করে কর এবং অ-কর রাজস্ব) এবং সামাজিক খাতে (বিশেষ করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা) জনসাধারণের জন্য ব্যয়।
উল্লেখ, গত এক দশকে জিডিপির অনুপাতে কর আদায়ের হার হ্রাস পেয়েছে, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের যথেষ্ট নিচে রয়ে গেছে। প্রকৃতপক্ষে, কর-জিডিপি অনুপাত এখন প্রায় ৮ দশমিক ৫ শতাংশ, যা বিশ্বের সর্বনিম্ন একটি। এত কম কর-জিডিপি অনুপাতের কারণে সরকারের সামাজিক খাতে উচ্চ ব্যয় করার ক্ষমতা খুবই সীমিত। তারপরও কয়েক বছর ধরে প্রত্যক্ষ কর (আয় ও মুনাফার ওপর কর) থেকে রাজস্ব বাড়ানোর জন্য সরকারের প্রচেষ্টা খুব বেশি সাফল্য পায়নি।
সরকারের রাজস্বের এক-তৃতীয়াংশের কম আসে প্রত্যক্ষ কর থেকে। বিপরীতে সরকারের রাজস্বের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসে পরোক্ষ কর থেকে (মূল্য সংযোজন কর, আমদানি শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক এবং অন্যান্য কর)। পরোক্ষ করের ওপর এই অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর অন্যায্য চাপ সৃষ্টি করে।
অন্যদিকে বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ আছে যে বিপুলসংখ্যক সম্ভাব্য করদাতা, যাঁদের মধ্যে অনেক অতিধনী ব্যক্তিও রয়েছেন, কর-জালের বাইরে থাকেন বা সামান্য পরিমাণ কর দেন। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি অর্থনৈতিক খাত, কর প্রদানে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও, হয় সম্পূর্ণভাবে কর প্রদান থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত বা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাসকৃত কর প্রদানের সুবিধা ভোগ করে। তাই প্রয়োজন প্রগতিশীল করব্যবস্থা ও সামাজিক সুরক্ষানীতি প্রবর্তন, যা ধনীদের থেকে কর রাজস্ব বৃদ্ধি করে এবং দরিদ্রদের জন্য পর্যাপ্ত আয়–সহায়তা ও সামাজিক পরিষেবা প্রদান করে।
এখন যদি আমরা রাজস্বনীতির ব্যয়ের দিকটি দেখি, বিশেষ করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা–সম্পর্কিত সরকারি ব্যয়, গত দুই দশকে জিডিপির অনুপাতে বরাদ্দের ক্ষেত্রে কার্যত কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়নি। ২০০০ সালে জিডিপির অনুপাতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ব্যয় ছিল যথাক্রমে ২ ও শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ, যা ২০২২ সালেও একই রয়েছে।
প্রকৃত সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে সরকারি ব্যয় জিডিপির মাত্র ১ শতাংশের কাছাকাছি রয়ে গেছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ওপর কম সরকারি ব্যয়ের একটি সুস্পষ্ট প্রভাব হলো বাংলাদেশে বেসরকারি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যয়ের উচ্চমাত্রা যা ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের পেছনে অন্যতম প্রধান অবদানকারী কারণ। বৈষম্য হ্রাসের জন্য প্রয়োজন সমাজের সব অংশের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অবকাঠামোর প্রাপ্যতা ও গুণমান উন্নত করে—এমন সরকারি পরিষেবাগুলোয় আরও বেশি বিনিয়োগ করা।
বৈষম্য সমস্যাটির পেছনে উন্নয়নে আঞ্চলিক বৈষম্যের চিত্রও রয়েছে। ঢাকা এবং কয়েকটি মেট্রোপলিটন শহর এখন পর্যন্ত উন্নয়নের প্রধান সুবিধাভোগী হয়েছে। দেশের অনেক অঞ্চল এখন বেশ পিছিয়ে রয়েছে। উদ্বেগের বিষয় হলো দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় ঢাকা এবং কয়েকটি অন্যান্য মেট্রোপলিটন শহরে সামাজিক খাত এবং ভৌত অবকাঠামোর জন্য বাজেটে বরাদ্দের ক্ষেত্রে বড় ধরনের বৈষম্য বিরাজ করছে। উন্নয়ন বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে এমন আঞ্চলিক বৈষম্যের ফলে দেশের বৈষম্য পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব নয়। এ ছাড়া, আঞ্চলিক বৈষম্য মোকাবিলায় সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি অপর্যাপ্ত। এই পিছিয়ে থাকা অঞ্চলগুলোর জন্য বর্ধিত বাজেট বরাদ্দের প্রয়োজন রয়েছে।
ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো দুর্নীতির প্রসার। ঋণখেলাপি, করখেলাপি, ব্যাংক কেলেঙ্কারি ও অর্থ পাচারের ঘটনার বৃদ্ধি দুর্নীতি দমনে ব্যর্থতার চিত্রকে তুলে ধরে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন গণতান্ত্রিক শাসন এবং দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপগুলো শক্তিশালী করা। কারণ এ পদক্ষেপগুলো অভিজাতদের দ্বারা রাষ্ট্রীয় সম্পদের দখলকে হ্রাস করে এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়ায়।
যদিও কঠিন, তবু দীর্ঘ মেয়াদে বৈষম্য কমানোর জন্য প্রয়োজন ভূমিসংস্কার এবং সম্পদ পুনর্বণ্টন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা, যা দরিদ্রদের জন্য নিরাপদ মেয়াদের অধিকার এবং ভূমি ও অন্যান্য উৎপাদনশীল সম্পদের ওপর তার অধিকার প্রদান করবে।
সেলিম রায়হান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সানেমের নির্বাহী পরিচালক।