প্রাণপণ ডেকেও আবু সাঈদ ভাইকে ফেরাতে পারিনি
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম আন্দোলন হয় ৩০ জুন। বাংলা বিভাগের শামসুর রহমান সুমন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের গোলাম শাওন, ইংরেজি বিভাগের মো. শফিকুল ইসলামসহ আরও কয়েকজন প্রথম উদ্যোগী হয়ে আন্দোলনের ডাক দেয়।
এ সময় বাংলা বিভাগের আয়োজনে একটি আন্তর্জাতিক সেমিনার চলছিল। সেমিনারে অংশ নেওয়ায় প্রথম দিনের আন্দোলনে যুক্ত হতে পারিনি। ১ জুলাইয়ের আন্দোলনে আবু সাঈদ ভাইসহ যুক্ত হই আমরা অনেকে। সেদিন গণমাধ্যমকে আমি জানাই, ‘যখন আমাদের ব্যস্ত থাকার কথা শিক্ষা-গবেষণা-খেলাধুলায়, সেখানে কোটাব্যবস্থার পুনর্বহাল আমাদের একটি ভাত দে টাইপের আন্দোলনের দিকে ঠেলে দিয়েছে।’
জুলাইয়ের শুরু থেকে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন যখন বড় হচ্ছে, তখন আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে ছাত্রলীগের ব্যাপক প্রভাব লক্ষ করি। তারা মূলত আন্দোলনের গতিপথ নির্ধারণ করে দিচ্ছিল। তবে ৭ জুলাইয়ের একটি ঘটনা সব ঘুরিয়ে দেয়।
সেদিন সারা দেশের সঙ্গে সমন্বয় রেখে আমরা ঢাকা-কুড়িগ্রাম মহাসড়কের মডার্ন মোড়ে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি পালন করছিলাম। কর্মসূচি চলাকালে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি পোমেল বড়ুয়া হঠাৎ ওই স্থানে আসেন এবং তৎক্ষণাৎ কর্মসূচি তুলে নিতে বলেন। তখন গতানুগতিকভাবে ছাত্রলীগের অন্যায় নির্দেশ মেনে অনেকে কর্মসূচি শেষ করতে চাইলে আমি দৃঢ় কণ্ঠে তার প্রতিবাদ জানাই। এই প্রতিরোধের ফলে অন্য শিক্ষার্থীরাও ধীরে ধীরে কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে দাঁড়িয়ে যায়। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ছাত্রলীগ সভাপতি স্থান ত্যাগ করেন।
৭ জুলাইয়ের এই প্রতিরোধ সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভয় ভেঙে দেয়। ১০ জুলাই আসতে আসতে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠে আন্দোলনের অন্যতম দুর্গ।
১০ জুলাই অভিযোগ আনা হয়, ছাত্রলীগ সভাপতির সঙ্গে বিরোধ বাধিয়ে আমি সবার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গেছি। ‘বিভেদ সৃষ্টিকারী’ আখ্যা দিয়ে নেতৃত্বের একটি অংশ আমাকে আন্দোলন পরিচালনার কেন্দ্রীয় গ্রুপ থেকে বহিষ্কার করে। আমি সাময়িকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি।
১১ জুলাই পূর্বঘোষিত কর্মসূচিতে ছাত্রলীগ অকস্মাৎ দলবদ্ধভাবে হামলা করে। ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে বুক আগলে দাঁড়ান আবু সাঈদ ভাই। অন্যান্য শিক্ষার্থীর সঙ্গে সেদিন তিনি আক্রমণ ও লাঞ্ছনার শিকার হন। আকস্মিক এ হামলা আন্দোলনকারীদের মনোবল ভেঙে দেয়। আমি ফেসবুক পোস্ট দিই, ‘বেরোবির (বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়) আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের বিভিন্ন সময়ের আপসকামী ও নতজানু ভূমিকা নিয়ে আমাদের সমালোচনা রয়েছে। তাদের এই আপসকামী ও নতজানু মনোভাবের জবাব বেরোবির সাধারণ শিক্ষার্থীদের দিতে হবে।’
এরপর আবু সাঈদ ভাই আবার আমাকে আন্দোলন পরিচালনার কেন্দ্রীয় গ্রুপে যুক্ত করেন। গ্রুপের একজন অ্যাডমিনও করেন। পরে তিনিই আমাকে সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ‘সমন্বয় সারাদেশ’ গ্রুপে যুক্ত করেন।
১২ জুলাই আন্দোলনে ফেরার পর মনে হয়, সমন্বয়ক প্যানেল প্রকৃত আন্দোলনকারীদের দিয়ে ঢেলে সাজাতে না পারলে আন্দোলনে গতি আসবে না। আবু সাঈদ ভাইয়ের সঙ্গে পরামর্শ করি। একটি সভায় সবার সিদ্ধান্তে বিভিন্ন বিভাগের জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থীদের যুক্ত
করা হয়। দুজন নারী, ইংরেজি বিভাগের সাবিনা ইয়াসমিন ও ব্যবস্থাপনা অধ্যয়ন বিভাগের সাবিনা আক্তারকে সমন্বয়ক হিসেবে যুক্ত করে প্যানেলটি ঢেলে সাজানো হয়।
১১ জুলাই রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলা ও গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে শিক্ষার্থীদের নিয়ে ক্যাম্পাসে আমরা বিক্ষোভ মিছিল করি। মূলত এদিনই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা আন্দোলন ছাত্রলীগের ‘ছায়া আন্দোলন’ থেকে বেরিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন হয়ে ওঠে। শিক্ষার্থীরা সাহসী হয়ে ওঠে। ১৩ ও ১৪ জুলাই আন্দোলন কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেয়।
১৩ জুলাই জানতে পারি, তাজহাট থানায় কয়েকজন আন্দোলনকারীর নাম তালিকাভুক্ত হয়েছে। তাতে আবু সাঈদ ভাই, আমিসহ আরও কয়েকজনের নাম আছে।
আন্দোলনের বাঁকবদল
১৪ জুলাই শেখ হাসিনা ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলে ব্যঙ্গ করলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও ক্ষোভে ফেটে পড়ে। রাতে এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ডাক দেওয়া বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নিতে মেয়েরা হলের তালা ভেঙে বের হয়ে আসে। ক্যাম্পাস পরিণত হয় জনসমুদ্রে। বঙ্গবন্ধু ও শহীদ মুখতার ইলাহী হলের সন্ত্রস্ত ছাত্রলীগ কর্মীরা দেশি অস্ত্র নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’ এই দিনে ‘রাষ্ট্রসংস্কার আন্দোলনে’ রূপ নেয়।
ছাত্রলীগের সশস্ত্র হামলার কারণে নেতৃত্বস্থানীয় অনেকে আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ায়। যখন চরম নেতৃত্বশূন্যতায় ভুগছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, তখন নেতৃত্বে এসে যুক্ত হন ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের আশিকুর রহমান আশিক ও আকিব ভাই।
১৫ জুলাই আবু সাঈদ ভাই ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করতে চাচ্ছিলেন, তখনই কোনো কর্মসূচি দিতে সম্মত ছিলেন না। তবে আন্দোলনের পটপরিবর্তনের সময় ধারাবাহিক কর্মসূচি জারি রাখার গুরুত্ব অনুধাবন করে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের জাব্বার, সাংবাদিকতা বিভাগের দীপ্ত তালুকদার, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শাওনসহ আমরা কয়েকজন আবু সাঈদ ভাইয়ের ছাত্রাবাসে যাই। তাঁর সম্মতি নিয়ে কর্মসূচি হাতে নিই।
কর্মসূচি ঘোষণার পর নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে দেখি, দেশি অস্ত্র হাতে আমাদের জমায়েতের স্থান ছাত্রলীগ আগেই দখলে নিয়েছে। আমরা কর্মসূচি পালন করতে পারিনি। আমরা তাৎক্ষণিক জরুরি সভা ডাকি। অবস্থা সেদিন এতটা ভয়াবহ ছিল যে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে কোথাও একত্র হতে পারছিলাম না। তাই কারমাইকেল কলেজের কাছে গিয়ে সভা করি। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী রিনা মুর্মুর সভাপতিত্বে জেলা পর্যায়ের বিভিন্ন স্কুল-কলেজের সমন্বয়কদের যুক্ত করা হয়। গোয়েন্দা পুলিশ আমাদের ওপর নজর রাখছিল।
আন্দোলনের কিছু কৌশলে পরিবর্তন আনা হয়। সিদ্ধান্ত হয়, ১৬ জুলাই কারমাইকেল কলেজের সামনে কর্মসূচির জমায়েত করব। তবে ১৬ জুলাই আসতে আসতে পরিস্থিতি কঠিন হয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীদের কেউ সাউন্ড সিস্টেম ভাড়া দিচ্ছিলেন না। দিলে গ্রেপ্তার বা জরিমানা করা হচ্ছে।
অনেকটা উপায়হীন অবস্থায় গণসংহতি আন্দোলন রংপুরের নেতা তৌহিদুর রহমানের সঙ্গে কথা হয়। তিনি শুরু থেকেই আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে আসছিলেন। তিনি সব ব্যবস্থা করে দেন।
ডেটলাইন ১৬ জুলাই
১৬ জুলাই সকালে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। বৃষ্টি মাথায় করে আমি, আশিক ভাই ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মুনতাসীর বেরিয়ে পড়ি সব সংগ্রহ করতে। সাউন্ড সিস্টেম ভাড়া না পেয়ে টাউন হলের সামনে থেকে দুটি হ্যান্ডমাইক কিনে নিই। আত্মরক্ষার জন্য তৌহিদ ভাইয়ের নির্ধারিত দোকান থেকে ৫০টি এসএস পাইপ কিনে সেগুলোর সঙ্গে পতাকা বেঁধে নিই। আমাদের পরিকল্পনা ছিল, ৫০ জন পতাকাধারী মিছিলের সামনে ও পেছনে অবস্থান নেবে, যাতে ছাত্রলীগ অস্ত্র নিয়ে হামলা চালালে আমরা অন্তত আত্মরক্ষা করতে পারি।
আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, যেখানেই জমায়েতের স্থান দিই না কেন, ছাত্রলীগ আগেই তার দখল নেবে। তাই কর্মসূচি বেলা তিনটায় থাকলেও তাৎক্ষণিকভাবে কয়েকজন মিলে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে ঘোষণা দিই যে আজকের কর্মসূচি শুরু হবে বেলা ১১টায়।
সিদ্ধান্তটি খুবই কার্যকর ছিল। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, কারমাইকেল কলেজ, রংপুর কলেজ, পুলিশ লাইনস স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ শহরের সব স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরা পুলিশ ও ছাত্রলীগের বাধা উপেক্ষা করে কারমাইকেল কলেজের সামনে সংগঠিত হয়। এরপর জনসমুদ্র এগোতে থাকে বিশ্ববিদ্যালয় অভিমুখে।
এরপর যে ঘটনাটি ঘটে, তা এই আন্দোলনকে একেবারে পাল্টে দেয়। দুই বাহু মেলে দেওয়া আবু সাঈদ ভাইকে যে বুলেটগুলো বিদ্ধ করল, সেগুলো যেন একেকটি পেরেক হয়ে বিঁধল ফ্যাসিস্টদের কফিনে।
আবু সাঈদ ভাই বা আমিসহ আরও শতাধিক শিক্ষার্থী-জনতা গুলিবিদ্ধ হই। সাঈদ ভাইয়ের ঠিক পেছনেই মাইক হাতে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। প্রাণপণ ডেকেও তাঁকে ফেরাতে পারিনি। তিনি আত্মহুতি দিলেন। কিন্তু সারা দেশের জন্য হয়ে উঠলেন মুক্তির উজ্জ্বল প্রতীক!
* শাহরিয়ার সোহাগ: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সমন্বয়ক