দীর্ঘতম জুলাই
জুলাই অভ্যুত্থানের স্মৃতিচারণা করা বেশ কঠিন। কারণ, পুরো সময়টাকেই আমার কাছে ঘোরের মতো মনে হয়।
১৪ জুলাইয়ের আগপর্যন্ত আমার কাছে কোটা সংস্কার আন্দোলনের যেসব স্মৃতি, তা একেবারেই ‘রুটিন’ আন্দোলনের অভিজ্ঞতা। ওই দিন আন্দোলনের তরফ থেকে রাষ্ট্রপতিকে স্মারকলিপি দেওয়ার কর্মসূচি ছিল। এ কর্মসূচিতে আমি উপস্থিত ছিলাম। আমার উপস্থিতির উদ্দেশ্য ছিল আমার সংগঠনের ছেলেমেয়েরা যেন বেশি আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিয়ে না ফেলে, তা নিশ্চিত করা। কারণ, বামপন্থীরা উসকানি দিয়ে আন্দোলনকে পুলিশের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিতে চাইছে—এ বয়ান ইতিমধ্যে ছড়িয়ে গিয়েছিল।
আরেকটা চিন্তার জায়গাও ছিল, তখন পর্যন্ত পুলিশ কেন এ আন্দোলনের প্রতি সদয়। এমন আলাপ তখন বাজারে ছিল যে ভারতের সঙ্গে অসম ট্র্যনজিট চুক্তি করার সময় জনগণকে ব্যস্ত রাখতে সরকারই আন্দোলন জিইয়ে রাখছে।
তো সেদিন রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দিয়ে আসার পর আমি সমন্বয়ক ও আন্দোলনকারীদের কথা ও শরীরী ভঙ্গিতে একধরনের ক্লান্তি দেখতে পাচ্ছিলাম। ওই দিন সন্ধ্যায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ফেডারেশনের তৎকালীন নেত্রী উমামা ফাতেমা আমাকে ফোন করেন। ততক্ষণে ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলে ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছেন শেখ হাসিনা। উমামা আমাকে বলেন, ছাত্রছাত্রীদের মনে প্রচণ্ড ক্ষোভ জমেছে। এর বিরুদ্ধে কিছু করা উচিত।
উমামার সঙ্গে কথা বলার পরও আন্দোলন নিয়ে খুব বেশি ভাবিনি। উপরন্তু দ্রুত বাসায় ফিরে ঘুমিয়ে গিয়েছি।
বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে
১৫ জুলাই সব ওলট–পালট হয়ে গেল। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি ফোনে ২৫টির মতো মিসড কল। নিশ্চিত হলাম, কাল রাতে খুব বড় কিছু ঘটেছে। ফেসবুকে ঢুকেই বুঝতে পারি, রাতে শিক্ষার্থীরা ‘তুমি কে, আমি কে/ রাজাকার, রাজাকার’ স্লোগান দিয়েছে। সবার সঙ্গে যোগাযোগ করে বুঝলাম, বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা রাতে নেমে এসেছিল রাস্তায়; এখানে মেয়েদের হলগুলো ছিল অগ্রগামী।
ছাত্রছাত্রীদের স্লোগানের মধ্যকার শ্লেষ ছাত্রলীগ যে ইচ্ছা করেই বুঝতে চাইবে না, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না আমার। প্রসঙ্গত বলা দরকার, ওই রাতেই সমন্বয়কদের তরফে স্লোগানে খানিকটা পরিবর্তন এনে সেটিকে এমনভাবে দাঁড় করানো হয়েছিল, যাতে শ্লেষের দিকটা আরও স্পষ্ট হয়। এরা ছাড়াও দুজনের নাম আলাদা উল্লেখের দাবি রাখে—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মাঈন আহমেদ ও বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক জাবির আহমেদ জুবেল। ‘তুমি কে, আমি কে/ রাজাকার, রাজাকার/ কে বলেছে, কে বলেছে, স্বৈরাচার, স্বৈরাচার’ স্লোগানটা তাঁদের উপস্থিত বুদ্ধিতেই আন্দোলনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।
অভিজ্ঞতার কারণে নিশ্চিত ছিলাম, ১৫ জুলাই অবশ্যই ছাত্রলীগ আন্দোলনে হামলা করবে। ঘুম থেকে ওঠার এক ঘণ্টার মধ্যে ক্যাম্পাসে উপস্থিত হই। দুপুরে রাজু ভাস্কর্যের সামনে আন্দোলনকারীরা সমবেত হলে সেখানে আমরাও আলাদাভাবে স্লোগান দিতে থাকি।
একটু পরে খবর আসে, হলে ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের আটকে রেখেছে। সমন্বয়কেরা সিদ্ধান্ত নেন, মিছিল নিয়ে গিয়ে তাদের মুক্ত করবেন। আমরাও মিছিলের সঙ্গে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।
হলপাড়ায় দুই দফা পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা ভিসি চত্বরের সামনে অবস্থান নেয়। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রসহ তাদের ধাওয়া করে। পরিস্থিতি বিবেচনায় এ সময় সিদ্ধান্ত নিই, সবাই চলে যাওয়ার পর আমি উল্টো দিকে এগোব, যত লোককে সম্ভব বাঁচানোর চেষ্টা করব।
এর মধ্যে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা রড ও হকিস্টিক দিয়ে এলোপাতাড়ি আক্রমণ করলে পিঠ ও মাথায় আঘাত পাই। মাথার আঘাতটা জোরালো না হওয়ায় মাথা সেদিন ফাটেনি—এই সৌভাগ্য।
পিঠের আঘাত নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে উপস্থিত হই। আক্রমণের নারকীয়তার মাত্রাও বুঝতে পারি। আন্দোলনকারীরা রক্তাক্ত হয়ে হাসপাতালে ঢুকছে আর ঢুকছে...এর যেন শেষ নেই।
সমন্বয়কেরা তখন ছত্রভঙ্গ। মেডিকেলের সামনে উপস্থিত গণমাধ্যমেকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার কেউ নেই। এই সময় আমি দায়িত্ব নিয়ে পুরো পরিস্থিতি জানাই তাদের।
কিছু সময় পর নাহিদ ইসলাম, রিফাত রশীদসহ কয়েকজন সমন্বয়ক হাসপাতালে আসেন। নাহিদ বলেন, আক্রমণের প্রতিবাদে ওই দিনই একটা প্রতিবাদ কর্মসূচি করতে চান। তাঁকে আশ্বাস দিই, তাঁদের যেকোনো কর্মসূচিতে আমরা সর্বশক্তি দিয়ে থাকব।
১৬ জুলাই সকালে আবারও ক্যাম্পাসের দিকে যাই। ততক্ষণে লাঠিসোঁটা নিয়ে ছাত্রলীগের মহড়া শুরু হয়ে গেছে। তাই ওই পথে না গিয়ে আমরা রমনা কালীমন্দিরের সামনে সমবেত হতে শুরু করি। এর মধ্যে খবর এল, টিএসসির দোতলায় দুজন শিক্ষার্থীকে রক্তাক্ত করেছে ছাত্রলীগ। যে বামপন্থী ছেলেমেয়েরা সেদিন আন্দোলনে ক্যাম্পাসে এসেছিল, সবাইকে এখানে আসতে বলি। পরে জনা ষাটেকের একটা জমায়েত নিয়ে শহীদ মিনারের দিকে রওনা হই। যেকোনো মুহূর্তে পথে আক্রমণ হতে পারে—এমন আশঙ্কার মুখেও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের যে সাহস সেদিন দেখেছিলাম, তাতে এ বিশ্বাস প্রগাঢ় হয়েছিল, এবার বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে। তত দিনে প্রতিটি ঘটনা ভীতির বদলে উল্টো সাহস সঞ্চার করতে শুরু করেছে।
শহীদ মিনারে পৌঁছে দেখি পুরো এলাকা আন্দোলনকারীদের দখলে। এখানেই সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদের সঙ্গে দেখা। তিনি বললেন, ‘দাদা, ওরা বেগম রোকেয়ায় আমাদের এক সমন্বয়ককে খুন করেছে।’ সে সময় স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলেছিলাম, এবার আর পেছন ফেরার সুযোগ থাকল না।
পরে জেনেছি, এই সমন্বয়কের নাম আবু সাঈদ।
বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হলে আমরা সিদ্ধান্ত নিই, এখন থেকে সবাই এক জায়গায় হওয়ার চেষ্টা না করে বরং যে যেখানে রাতে থাকব, এর নিকটতম পয়েন্টে গিয়ে আন্দোলন সংগঠিত করার চেষ্টা করব।
বিধ্বস্ত জনপদে অসহায়
১৮ জুলাই ছিলাম লালমাটিয়া এলাকায়। মোহাম্মদপুরের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা এখানে আগে থেকেই অবস্থান করছিল। এদের কয়েকজন আমাকে চিনত। আমার কাছে তারা পরামর্শ চাইল। তাদের বললাম, কোনোভাবেই জমায়েত যেন বিভক্ত না হয়। কারণ, মিরপুর ও সাতমসজিদ সড়ক—দুই দিক থেকে আক্রমণ হলে চিড়েচ্যাপটা হয়ে যেতে হবে। এ সময় একটা দোকানে গিয়ে তাদের ওয়াই–ফাই নিয়ে একটা লাইভ করে আশপাশের সবাইকে এখানে আসার আহ্বান জানাই। এরপর টিয়ার শেল ও রাবার বুলেটের মুখে ধানমন্ডিতে আটকা পড়ি।
১৯ জুলাই সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন কিছু শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমে মিছিল করার সিদ্ধান্ত নেন। আমরা যারা ধানমন্ডিতে অবরুদ্ধ ছিলাম, তাঁরা আমাদের এতে যুক্ত হতে বলেন। এ সময় তাঁদের বলি যে নিরস্ত্র অবস্থায় পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার জন্য আমার একজন কর্মীকেও পাঠাব না। এতে কর্মীরা আমার ওপর খুব ক্ষুব্ধ হয়। বলে রাখি, সেদিনের ওই মিছিলেই আলোকচিত্রী তাহির জামান প্রিয় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন।
সন্ধ্যায় ধানমন্ডিতে মুহুর্মুহু গুলির শব্দকে বৃষ্টির শব্দ বলেই মনে হচ্ছিল। পরে মানুষের চিৎকার শুনে ভুল ভাঙে। একের পর এক পরিচিত-অর্ধপরিচিত মানুষের গুলি খাওয়ার সংবাদে অদৃশ্য রক্তে ভরে আছে মন। এ সময় রাইয়ান আজমাইন নামের এক সহযোদ্ধা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে। তাকে কী বলে সান্ত্বনা দিই—আমি নিজেও তো অসহায়, বিধ্বস্ত।
দায়িত্ব নেওয়ার পালা
কারফিউর প্রথম দুই দিন আত্মগোপনে থাকার পর বের হতে শুরু করি। সে সময় মুক্তি ভবনের ছাদে কমিউনিস্ট পার্টির ঢাকা দক্ষিণের অফিসটা আমাদের অঘোষিত কমান্ড সেন্টারে পরিণত হয়। ২৬ জুলাইয়ের ‘গানের মিছিল’-এর পরিকল্পনা ও আয়োজন এখান থেকেই।
সমন্বয়কদের কাউকে কাউকে তখন ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, বাকিরা আত্মগোপনে। এই বাস্তবতায় সিদ্ধান্ত নিলাম, এবার আমাদের দায়িত্ব নিতে হবে।
২৬ জুলাই কারফিউ ভেঙে গানের মিছিল করার সিদ্ধান্ত মূলত গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের উদ্যোগে প্রতিবাদী সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো নিয়েছিল। কারফিউ ভেঙে মিছিল করাটা জনমনে সাহসের সঞ্চার করেছিল, কেউ যদি বামপন্থীদের সৎ সমালোচক হন, তাকে ব্যাপারটা স্বীকার করতে হবে।
দ্রোহযাত্রায়
২৬ তারিখের সাফল্য আমাদের উজ্জীবিত করে। এরপর ২ আগস্ট ‘দ্রোহযাত্রা’ আয়োজনের উদ্যোগ নিই। ৩১ জুলাই থেকেই সর্বশক্তি নিয়োগ করে আয়োজনটি সফল করার চেষ্টা করি।
চেষ্টা বৃথা যায়নি। এতে ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে মানুষ এক হয়েছিল। মানুষ তখন আর কোটা নিয়ে সন্তুষ্ট ছিল না, চেয়েছিল শেখ হাসিনার পদত্যাগ।
১ আগস্ট দ্রোহযাত্রা নিয়ে রিফাত রশীদের সঙ্গে অনলাইনে যোগাযোগ করি। বলি যে তাঁরা যেন এতে সবাইকে যুক্ত হতে বলেন আর বলেন এক দফার কথা। তবে আমাদের কর্মসূচিতে সংহতি জানিয়ে রিফাত বলেন, ‘আমরা যেহেতু ৯ দফা দিয়ে রেখেছি, এখনই প্রকাশ্যে এক দফার পক্ষে কিছু বলা সম্ভব নয়।’
অবশ্য তাতে ক্ষতি-বৃদ্ধি হয়নি। কারণ, মানুষ ততক্ষণে এক দফাতে পৌঁছে গেছে। ২ আগস্ট দ্রোহযাত্রায় ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে প্রায় ১০ হাজার মানুষ দ্রোহযাত্রায় সম্পৃক্ত হয়। আমার ধারণা, বামপন্থীদের ডাকে যে এত মানুষ সাড়া দিয়ে রাস্তায় নামবে, সরকার তা ভাবতেই পারেনি। পুরো আন্দোলনে আমার যদি কোনো সুখস্মৃতি থাকে, তা দ্রোহযাত্রা।
একরকম বিনা বাধায়ই শহীদ মিনার পর্যন্ত পৌঁছে যায় মিছিল। এর আগপর্যন্ত ক্যাম্পাসের আশপাশে কাউকে দাঁড়াতেই দেওয়া হচ্ছিল না। দ্রোহযাত্রার মধ্য দিয়ে সেই বাধা দূর হয়। সেখানে ছাত্রদের পক্ষ থেকে ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাগীব নাঈম শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবি জানান। আর শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের পক্ষে আনু মুহাম্মদও দেন একই ঘোষণা। ওই রাতেই জানতে পারি, ৩ আগস্ট সমন্বয়কেরা শহীদ মিনারে সবাইকে সমবেত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
পতনের দিন গোনা
৩ আগস্ট নাহিদ এক দফার ঘোষণা দেন। নিশ্চিত হয়ে যাই, সরকার এবার উৎখাত হবেই।
৪ আগস্ট সকাল থেকে পুরানা পল্টনে অবস্থান নিই আমরা। সেখানে আওয়ামী লীগের সশস্ত্র মিছিল আমাদের দিকে ধেয়ে আসে। একটা গুলি আমার কানের পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। দ্রুত আবার মুক্তি ভবনে আশ্রয় নিই।
বিকেলে মিছিল নিয়ে শাহবাগে যাই। আহত-নিহত মানুষ নিয়ে একটার পর একটা রিকশা আসছে আর আমরা স্লোগান তুলছি, ‘কারফিউ ভেঙে ফেলো, শেখ হাসিনা গেল গেল।’ ভয় ভেঙে চারপাশে সে সময় মুক্তির প্রতীক্ষা।
৫ আগস্ট বিজয়ের যে আনন্দ, তা অবশ্য অনুভব করতে পেরেছিলাম ঘণ্টাখানেক। এর পর থেকে যে নাগরদোলায় সামষ্টিকভাবে আমরা চড়ে আছি, তা আর স্মৃতি রোমন্থনের ফুরসত দিচ্ছে না।
হয়তো একদিন সত্যিই মুক্ত মানুষের মুক্ত সমাজে বসে খুনি হাসিনার আমল, দীর্ঘতম জুলাই নিয়ে আলাপের অবকাশ মিলবে। কিন্তু দিল্লি খুব কাছে হলেও আবার অনেকই দূরে।
* মেঘমল্লার বসু: সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা