কারফিউর দিনগুলোতে কার্টুন

৬ আগস্ট নিউ এজ–এ ছাপা হওয়া মেহেদী হকের এ কার্টুনে ছিল শেখ হাসিনার সপরিবার পলায়নের চিত্র

রাজনৈতিক কার্টুন শেষ হয়ে গেল কি না, এমন আলোচনা যখন চলছিল এবং নিউ এজসহ হাতে গোনা দু–একটা পত্রিকা ছাড়া যখন রাজনৈতিক কার্টুন নেই বললেই চলে, তখন জুলাইয়ের অগ্নিঝরা সময় যেন রাজনৈতিক কার্টুন, আর্ট ও গ্রাফিতির শত ফুলকি ছড়িয়ে উদয় হলো। জুলাই অভ্যুত্থানের অব্যবহিত পর জুলাই কার্টুনের সংকলনের কাজে থাকার সুবাদে বলতে পারি, এই এক মাসের কম সময়ে শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই তরুণেরা এঁকেছেন ছয় শতাধিক কার্টুন! 

এ সময় আমি নিজেও বিস্তর কার্টুন এঁকে আন্দোলনে শামিল হতে চেয়েছি। এঁকেছি ফেসবুকে, আবার নিউ এজ–এর জন্যও এঁকেছি। এই লেখা আমার কার্টুন আঁকার স্মৃতিচারণা। আর সেটা শুধু লেখায় বোঝানোর চেয়ে কবে কোন কাজ কী পরিস্থিতিতে এঁকেছিলাম, তার বিবরণ দিলে পাঠকের বুঝতে হয়তো সহজ হবে।

১৬ জুলাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জন্য আঁকা মেহেদী হকের কার্টুনটি ১০ হাজারের বেশি মানুষ শেয়ার করেছিলেন

জুলাই আন্দোলনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জন্য আমার প্রথম আঁকা ছিল এই কাজটি: ছাত্রদের বিক্ষোভ দমনে ‘ছাত্রলীগই যথেষ্ট’ বলে ওবায়দুল কাদেরের ঘোষণার পর ছাত্রলীগ ও পুলিশ মিলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করলে ১০ জনের বেশি শিক্ষার্থী নিহত হন। ১৬ জুলাই ঘটনার দিন ফেসবুকে আমার পেজেই আপলোড করি কার্টুনটি। এটি সম্ভবত আমার অন্যতম কাজ, যা ১০ হাজারের বেশি মানুষ শেয়ার করেছেন এবং কয়েক লাখ মানুষ দেখে রিঅ্যাক্ট করেছেন। মনে রাখা ভালো যে এ ধরনের কাজ আমি টানা এঁকে গেলেও শুধু ভয় থেকেই মানুষ শেয়ার করতেন না বহুদিন। এই কাজের এত বিস্তৃতি প্রমাণ করে, মানুষ কী ভয়ানক ক্ষিপ্ত ছিলেন সরকারের ওপরে।

আমার ক্যাম্পাসে রক্ত কেন—প্রশ্ন করায় আয়মান সাদিকের প্রতিষ্ঠান টেন মিনিটস স্কুলের পাঁচ কোটি টাকার অনুদান বাতিল করে দেয় তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, যেটা আবার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্​মেদ পলক নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে শেয়ারও করেন। এরপর সাংবাদিকদের তিনি জানান—দুর্জন বিদ্বান হইলেও পরিত্যাজ্য। এ নিয়েই ১৬ জুলাই ফেসবুকে এঁকেছিলাম একটি কার্টুন। 

শেষে করি এ কথা বলে যে আমরা যারা রাজনৈতিক কার্টুন আঁকি, তাঁরা জানি ন্যায়ের লড়াইটা কী; আমাদেরলড়াইটা আসলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, সেটা যে-ই করুক।
মেহেদী হক। আন্দোলনের সময় নিয়মিত কার্টুন এঁকেছেন; নিউ এজ–এর জ্যেষ্ঠ কার্টুনিস্ট

এই দিনেই রংপুরে প্রকাশ্যে নিরস্ত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আমি তা জানতে পারি রাতে। দুই হাত ছড়িয়ে দাঁড়ানো এক যুবককে একের পর এক গুলি করছে পুলিশ, একসময় তিনি লুটিয়ে পড়লেন। এই দৃশ্যই পুরো আন্দোলনে গণমানুষকে যুক্ত করে। এই পটভূমিতে ‘ছাত্রলীগ আনলিশড’ নামে কার্টুনটি ১৭ জুলাই নিউ এজ–এ ছাপা হয়।

রাস্তায় তখন সেনাবাহিনী নেমে গেছে, ট্যাংক ঘুরছে আশপাশে। অদ্ভুত একটা পরিস্থিতি। আমার হঠাৎ মনে হলো, হত্যাকাণ্ড আর দমনে এই সরকার এরশাদকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এখন নব্বইয়ের দশকের এরশাদবিরোধী আন্দোলনকারীরা হয়তো বলতে বাধ্য হবেন যে এরশাদ এর চেয়ে ভালো ছিল। এমন চিন্তা থেকেই আরেকটি কার্টুন এঁকেছিলাম নিউ এজ–এর জন্য। এটি প্রকাশের পরদিন সম্পাদক নূরুল কবীর আমাকে ডেকে বললেন, এর বিরাট বিরাট প্রতিক্রিয়া পেয়েছেন তিনি। আমরা নাকি একটু বেশি বেশি করে ফেলেছি, এরশাদের সঙ্গে তুলনা! তবে আজ এসে বুঝতে পারি, বাড়াবাড়িটা আমরা করিনি।

৫ আগস্ট সকাল। সবকিছু থমথমে। নিউজ চ্যানেলও একই খবর লুপে ফেলে রিপিট করছে। বাইরে কারফিউ, ছাত্রলীগ নেতারা রক্তের হোলি খেলার ঘোষণা দিয়েছেন। শুট অ্যাট সাইট বিদ্যমান। হঠাৎ আমার বন্ধুদের ফোন, উত্তরা থেকে। তারা সবাই রাস্তায় নামছে কারফিউ অমান্য করে। এই আন্দোলনের মূল যে শক্তি, তার মূলে আছেন এমন গণমানুষ। কোনোভাবেই যাঁর আন্দোলনে নামার কথা নয়, তিনিও ভয়ানক সিরিজ হত্যাকাণ্ড দেখে রাস্তায় নেমে গেছেন। ওদিকে টেলিভিশনে দেখা যাচ্ছে, বেলা দুটোয় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান। তখনই বুঝে ফেললাম, শেখ হাসিনা আর নেই। খুব সম্ভবত এ মুহূর্তে তাঁর নিরাপদে দেশ ছাড়ার ব্যবস্থা চলছে। সে সময়ই একটি কার্টুন আঁকি এবং ফেসবুকে আপলোড করি। আশ্চর্য, বিকেল নাগাদ সত্য হয় আমার কথা! 

৬ আগস্ট নিউ এজ–এ ছাপা হয়েছিল ‘য পলায়তি, স জীবতি’। এটি সংস্কৃত শ্লোক। তবে এখানে এ বাক্য দিয়ে আমি নেতা–কর্মীকে ফেলে শেখ হাসিনার সপরিবার পলায়ন বুঝিয়েছি। ৫ আগস্ট কাজটি যখন করছিলাম, রাস্তায় তখন আনন্দমিছিল; শাহবাগ, বাংলামোটর, মিরপুর রোডে মানুষের ঢল। তবে সেখানে শামিল না হয়ে সরাসরি আমি চলে এসেছিলাম অফিসে। বেশ তাড়াহুড়ো করেই কাজটি করেছিলাম, যা পরবর্তী সময়ে দেয়ালে দেয়ালে অনেকবার নতুন করে এঁকেছেন তরুণেরা। এমনকি জুলাই অভ্যুত্থানের কার্টুন নিয়ে ড. শহিদুল আলমের সম্পাদনার বইটির (জুলাই আপরাইজিং: স্যাটায়ার অ্যান্ড রিডিকুল কার্টুন দ্যাট ডিমলিশড আ ডিক্টেটর) প্রচ্ছদ হিসেবেও এটি নির্বাচিত হয়েছে।

শেষে করি এ কথা বলে যে আমরা যারা রাজনৈতিক কার্টুন আঁকি, তাঁরা জানি ন্যায়ের লড়াইটা কী; আমাদেরলড়াইটা আসলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, সেটা যে-ই করুক।

৫ আগস্ট সকাল। সবকিছু থমথমে। নিউজ চ্যানেলও একই খবর লুপে ফেলে রিপিট করছে। বাইরে কারফিউ, ছাত্রলীগ নেতারা রক্তের হোলি খেলার ঘোষণা দিয়েছেন। শুট অ্যাট সাইট বিদ্যমান। হঠাৎ আমার বন্ধুদের ফোন, উত্তরা থেকে। তারা সবাই রাস্তায় নামছে কারফিউ অমান্য করে।

*মেহেদী হক: আন্দোলনের সময় নিয়মিত কার্টুন এঁকেছেন; নিউ এজ–এর জ্যেষ্ঠ কার্টুনিস্ট