যাত্রাবাড়ীর প্রতিরোধে

আসাদুজ্জামান

ইটের টুকরা হাতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাজলায় স্লোগান দিচ্ছিল কিশোরটি। তখন যাত্রাবাড়ী থানার সামনে থেকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে নির্বিচার গুলি ছুড়ছিলেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনীর সদস্যরা। ইট হাতে দাঁড়িয়ে থাকা কিশোরের বুকের বাঁ পাশে হঠাৎ এসে গুলি লাগে। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে। তখন আরেকজন আন্দোলনকারী তাকে কাজলার অনাবিল ও সালমান হাসপাতালে নিয়ে যান।

কাজলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ছোড়া গুলি মিনিটে মিনিটে আন্দোলনকারীদের শরীরে বিঁধছিল। আহত আন্দোলনকারীদের হাসপাতালে রেখে আবার কাজলার রোডে ফিরছিলেন সহযোদ্ধারা। ছাত্র–জনতা জীবনবাজি রেখে রাস্তায় গিয়ে গুলিতে হতাহতের ঘটনার শুরু ১৭ জুলাই সকাল ১০টায়। জুলাই (১৭ জুলাই-২২ জুলাই) ও আগস্টের (৩ আগস্ট থেকে ৫ আগস্ট) দুই দফায় আট দিনে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চার কিলোমিটার এলাকায় অস্ত্র ও গুলির মুখে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন ছাত্র-জনতা।

রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় নিহতদের নাম-পরিচয় সংবলিত স্মৃতিফলক ‘শহীদী ঐক্য চত্বর’-এর উন্মোচন করেছে জুলাই বিপ্লব পরিষদ। স্মৃতিফলকে প্রাথমিকভাবে ৪৮ শহীদের নাম স্থান পেয়েছে
ছবি: সংগৃহীত

এই ছাত্র–জনতার মধ্যে শিক্ষার্থীরা যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের নেতা–কর্মীরা। ছিলেন জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা–কর্মীরা। ইসলামী আন্দোলন এবং হেফাজতে ইসলাম–সমর্থিত বিভিন্ন ইসলামি দলের কর্মী ও সমর্থকেরা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। বিপুলসংখ্যক মাদ্রাসার শিক্ষার্থী যাত্রাবাড়ীতে প্রতিরোধে অংশ নেন। পুলিশের নির্বিচার গুলিতে (১৭ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট) সাধারণ মানুষের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের নেতা–কর্মী, সাধারণ শিক্ষার্থী ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা শহীদ হন। শুধু যাত্রাবাড়ী নয়, আন্দোলনের এই চিত্রটি ছিল অনেক জায়গায়। 

যাত্রাবাড়ীতে প্রতিদিনই মানুষের মরদেহ সড়কে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। গলিতে থেকেও গোয়ালবাড়ী মোড়সহ কয়েকটি স্থানে গুলিতে নিহত অন্তত ১০ জনের মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেছেন স্থানীয় লোকজন।

যেন যুদ্ধ 

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যাত্রাবাড়ী হচ্ছে ঢাকার প্রবেশদ্বার। যাত্রাবাড়ী থানা ঘেঁষে রয়েছে দেশের বৃহত্তম মাছ ও ফলের আড়ত। ফলের আড়তের উল্টো দিকে বেশ কয়েকটি মাদ্রাসাও রয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ঢাকাসহ সারা দেশে গত ১৬ জুলাই ছয়জন নিহত হন। পরদিন সকাল ছয়টার পর দনিয়া কলেজের শিক্ষার্থীরা প্রথমে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের শনির আখড়া ও কাজলা অংশ অবরোধ করেন। সকাল ১০টা পর্যন্ত কাজলা থেকে সাইনবোর্ড পর্যন্ত ছাত্র-জনতার দখলে ছিল।

সন্ধ্যার পর কাজলায় হানিফ উড়ালসড়কের টোল প্লাজা থেকে সিদ্ধিরগঞ্জ পর্যন্ত মহাসড়কের অন্তত ৪০টি স্থানে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। শুরু হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ছাত্র-জনতার পাল্টাপাল্টি ধাওয়া। সন্ধ্যার দিকে একদল পুলিশ সদস্য অনাবিল হাসপাতালের গলিতে ঢুকে এলোপাতাড়ি গুলি করেন। ওই সময় সেখানে দাঁড়ানো ইমরান বাবুর্চির মাথায় গুলি লেগে ঘটনাস্থলেই মারা যান। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে রাতভর পুলিশের সংঘর্ষ হয়।

১৮ জুলাই শুরু হয় ভয়াবহ পরিস্থিতি

যাত্রাবাড়ী থানার সামনে ১৮ জুলাই বিপুলসংখ্যক পুলিশ, র্যাব ও এপিবিএন সদস্য সশস্ত্র অবস্থায় মোতায়েন। আন্দোলনকারীরা থানার কাছে সড়ক দখল করে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। মাছের আড়তে ঘুমিয়ে থাকা এক কর্মচারীর মাথায় গুলি লাগে। ঘুমের মধ্যে চিরঘুমে চলে যান তিনি।

পুলিশের গুলি আর সাউন্ড গ্রেনেডের মুহুর্মুহু শব্দে পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সন্ধ্যার পরপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ শুরু হয়। তখন পুলিশের এলোপাতাড়ি গুলিতে কাজলার উড়ালসড়কের কাছে পেশাগত দায়িত্ব পালনরত ঢাকা টাইমস-এর সাংবাদিক মেহেদি হাসানের বুক ঝাঁজরা হয়ে যায়। গুলিতে হতাহত মানুষের ঠাঁই হয় হাসপাতালে। ১৮ ও ১৯ জুলাই কেবল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পড়ে ছিল অনেকের মরদেহ।

সড়কে মরদেহ

আবার ৩ আগস্ট ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চার কিলোমিটার মহাসড়ক দখল করে নেন ছাত্র-জনতা। শুরু হয় র্যাব-পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের তুমুল সংঘর্ষ। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দিন সকাল ১০টার দিকে হাজারো ছাত্র-জনতা কাজলায় অবস্থান নেন। বেলা ১টার পর পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের তুমুল সংঘর্ষ শুরু হয়। একপর্যায়ে যাত্রাবাড়ী থানার সামনের সড়কে এক পাশে লুকিয়ে থাকা ৩০ থেকে ৩৫ জন আন্দোলনকারীকে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, এসব মরদেহ অনেকক্ষণ যাত্রাবাড়ী থানার সামনের সড়কে পড়ে ছিল। পরে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়লে বিকেল চারটার পর আন্দোলনকারীরা মরদেহগুলো ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যান। 

এত মরদেহ, এত মৃত্যু, এত আহাজারির কথা আজও যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া, রায়েরবাগ এলাকার মানুষের মুখে মুখে। এসব এলাকার সড়ক-গলিতে কত মানুষের মৃত্যুর গল্প জমে আছে!

* আসাদুজ্জামান: জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, প্রথম আলো