কর্মীর লেখা
আমার কাছে হয়তো শুধুই সংখ্যা, অথচ তাঁরা কারও সন্তান বা স্বজন
প্রথম আলোর ২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কর্মীদের কাছে লেখা আহ্বান করা হয়েছিল। কর্মীদের নির্বাচিত কিছু লেখা নিয়েই এ আয়োজন।
গুলিতে মারা গেছে। আচ্ছা। গুলি লাগার সে সময়ের আলোচিত কোনো ভিডিও আছে? কোনো ছবি? অথবা একটু অন্য রকমের কোনো গল্প? আহত হওয়ার মাত্রাটা কেমন? শরীরে কয়টা গুলি লেগেছিল? গুলি বের করা গেছে? আসলে মারা যাওয়া বা আহত হওয়ার সংখ্যাটা তো অনেক, প্রতিবেদন করতে হলে একটু অন্য রকম কিছু লাগবে।
জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে মারা যাওয়া বা আহত হওয়াদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে এভাবে অনেক সময় কথা বলতে হচ্ছে। আহত বা মৃত্যুর মধ্যেও প্রায়োরিটি খুঁজে বের করার এ প্রক্রিয়াটা নিজের কাছেই অমানবিক লাগছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, আমার কাছে বা পত্রিকার পাতায় আন্দোলনে মারা যাওয়া শিশু-কিশোর-কিশোরী বা অন্য কোনো ব্যক্তি শুধুই একটি সংখ্যা। কিন্তু পরিবারের কাছে তাঁরা কেউ সন্তান বা স্বজন।
ফারহান ফাইয়াজের আত্মীয় নাজিয়া খান ফারহানের সঙ্গে হাসিখুশি একটি ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে সেদিন লিখেছিলেন, ‘দিস ইজ মাই ফারহান ফাইয়াজ। হি ইজ ডেড নাও। আই ওয়ান্ট জাস্টিস (এই আমার ফারহান আইয়াজ। সে এখন মৃত। আমি ন্যায়বিচার চাই)।’
গত ২৮ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে তখন পর্যন্ত ১ হাজার ৫৮১ জন নিহত হওয়ার তথ্য পেয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্বাস্থ্যবিষয়ক উপকমিটি এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি। ৭ অক্টোবর স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম গণমাধ্যমকে জানান, এ আন্দোলনে ২৩ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৪০০ জন চোখ হারিয়েছেন। দুই চোখই হারিয়েছেন ২০০ জন। আহত-নিহতের এ তালিকায় তথ্য বা সংখ্যা সংযোজনের বিষয়টি চলমান আছে।
আন্দোলনের শুরুতে মারা যাওয়া বা আহত ব্যক্তিদের গণমাধ্যমগুলো খুঁজে বের করেছে। তবে ৫ আগস্টের পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়।
নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টের ইন্ট্রোতে রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের ছাত্র ফারহান ফাইয়াজ ইংরেজিতে লিখেছিল, ‘এমন জীবন গড়ো, যাতে মৃত্যুর পর মানুষ মনে রাখে।’ ১৮ জুলাই, আন্দোলনে গুলিতে মারা গেল ফারহান। সেদিন অনলাইনে ফারহানকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন করলাম। ফারহান ফাইয়াজের আত্মীয় নাজিয়া খান ফারহানের সঙ্গে হাসিখুশি একটি ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে সেদিন লিখেছিলেন, ‘দিস ইজ মাই ফারহান ফাইয়াজ। হি ইজ ডেড নাও। আই ওয়ান্ট জাস্টিস (এই আমার ফারহান আইয়াজ। সে এখন মৃত। আমি ন্যায়বিচার চাই)।’
নাজিয়া খানের ফেসবুক পোস্ট বলতে গেলে এটুকু সূত্র ধরেই প্রতিবেদনের জন্য মাঠে নামতে হলো। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ১৭ জুলাই রাত থেকে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয় সাবেক আওয়ামী লীগ সরকার।
নাজিয়া খানের ফেসবুক পোস্ট বলতে গেলে এটুকু সূত্র ধরেই প্রতিবেদনের জন্য মাঠে নামতে হলো। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ১৭ জুলাই রাত থেকে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয় সাবেক আওয়ামী লীগ সরকার। ফলে ফেসবুক থেকে তথ্য পেতেও বেগ পেতে হচ্ছে। নাজিয়া খানের পোস্ট দেখে অফিসের প্রায় সবাই ভেবেই নিয়েছিলাম ফারহান নাজিয়া খানের ছেলে। এমন সিদ্ধান্তও হলো যে মায়ের (নাজিয়া খান) ফেসবুকের পোস্ট ধরেই একটি নিউজ অনলাইনে দ্রুত করতে হবে। তবে নিউজ করতে করতেই জানা গেল নাজিয়া খান মা নন। তাহলে এই নাজিয়া খান বা ফারহানের বাবা-মাকে কীভাবে খুঁজে পাওয়া যাবে। যাহোক, পরে নাজিয়া খানের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হলো এবং প্রতিবেদনটি অনলাইনে উঠল।
আন্দোলনে সন্তান বা স্বজন অংশ নিয়েছে, ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত সাবেক সরকারের ভয়ে পরিবারের সদস্যরা এ কথাও বলতে চাইতেন না। ছবি দিতে চাইতেন না। তাই তখন প্রতিবেদন করতে বাড়তি ভোগান্তি হয়েছে। অন্যদিকে ৫ আগস্টের পর পরিবারগুলোই যোগাযোগ করতে থাকে। প্রথম আলোতে একটি প্রতিবেদন হলে শহীদ হিসেবে সরকারের তালিকায় নাম তুলতে বা ক্ষতিপূরণ পেতে সুবিধা হবে, তাই তখন আর পরিবারগুলো সময় নষ্ট করতে রাজি নয়। ফলে চাপ বাড়তে থাকে। সে চাপ এখনো আছে।
আস্তে আস্তে আন্দোলনে মারা গেছেন বা আহত হয়েছেন, এমন খবরের মধ্যে একটু ব্যতিক্রম কোনো ঘটনা নিয়ে প্রতিবেদন করলে পাঠকের প্রতিক্রিয়া ছিল অন্য রকম। তাই ব্যতিক্রম ঘটনাগুলো খুঁজতে থাকলাম।
‘একজন ফোন ধরে বলল, “আপনার ছেলে মারা গেছে”, ‘গুলিবিদ্ধ কিশোরকে নিজের রিকশায় তুলতে গিয়ে দেখেন, এ তো তাঁরই ছেলে’, ‘পাদানিতে ঝুলতে থাকা গুলিবিদ্ধ নাফিজ তখনো রিকশার রড ধরেছিল’, ‘পুলিশের সাঁজোয়া যান থেকে একজন জীবন্ত মানুষকে এভাবে কোনো মানুষ ফেলে দিতে পারে না’, ‘পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান পুলিশ কর্মকর্তার ছেলে’, ‘অটোরিকশায় বসে কোলে করে ছেলের লাশ বাসায় আনি’, ‘আমার এক হাত নেই এটা মেনে নিতে হবে’, ‘পোড়া লাশ দাফনের পর মা-বাবা জানতে পারেন, ছেলে বেঁচে আছে, তবে...’, ‘আর হাঁটতে পারবে না, তা মানতে নারাজ গুলিবিদ্ধ তাহসিন’, ‘গুলিতে খোকনের ঠোঁট, মাড়ি, তালু, নাকের আর অস্তিত্ব নেই’—এমন শিরোনামে আমার করা প্রতিবেদনগুলো ছাপা হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে আরও অনেকেই জানিয়েছেন তাঁর সন্তান, ভাই বা অন্য কোনো স্বজন মারা গেছেন। সন্তানের রক্তাক্ত ছবি পাঠিয়েছেন। কিন্তু ওই যে সংখ্যার মারপ্যাঁচে সেগুলো কিছুটা দূরে সরিয়ে রাখতে হয়েছে।
সাভারে গেলাম সাফওয়ান আখতার সদ্যর বাসায়। সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণিতে পড়ত সে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর ৫ আগস্ট সাভারে আনন্দমিছিল দেখতে গিয়ে গুলিতে মারা গেছে সাফওয়ান। তানজিলা মোস্তাফিজের ফুপুর ছেলে সাফওয়ান। ছোটবেলা থেকে তানজিলাই এই ভাইকে বড় করেছেন। সাফওয়ানের বাসা থেকে কাজ শেষ করে ফেরার সময় তানজিলা বলছিলেন, ‘নিজের ভাই মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত পত্রিকার পাতায় দেখতাম আন্দোলনে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। আচ্ছা, আজ এত জন মারা গেছে, এভাবেই চিন্তা করতাম। তবে ভাই মারা যাওয়ার পর বুঝতে পারলাম, অন্যদের কাছে সংখ্যা হলেও সন্তান বা স্বজন হারানো পরিবারের কাছে তা কখনোই সংখ্যা নয়।’
তানজিলার কথাটা মাথায় ঘুরতে থাকলেও মুঠোফোনে জমতে থাকা নিহত ব্যক্তিদের ছবি দেখে ও মারা যাওয়ার গল্প শুনে আবার প্রায়োরিটি বা অগ্রাধিকারের তালিকা করি।
এই লেখা যখন লিখছি, তখন মাথায় ঘুরছে সায়েদাবাদের সেই দুই বোনের কথা।
একমাত্র ভাই গুলিতে মারা যাওয়ার পর এই দুই বোন হাসপাতাল থেকে কাঁধে করে ভাইয়ের লাশ নিয়ে মিছিল করেছিলেন। অথবা সেই যে সানজিদা, যাঁর ভাই গুলিতে মারা গেছেন। যাওয়ার পর সানজিদার মা-বাবাও মারা গেছেন। সানজিদার আরেক ভাই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। আর সানজিদাকে আশ্রয় নিতে হয়েছে দূরসম্পর্কের এক বোনের কাছে।
মানসুরা হোসাইন, বিশেষ প্রতিবেদক