অভ্যুত্থান বড় সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে
অভাবনীয় হত্যাযজ্ঞ এবং অভূতপূর্ব গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছে এমন এক বাংলাদেশ, যা এখন দাঁড়িয়ে আছে সম্ভাবনা ও উদ্বেগের মাঝখানে। বাংলাদেশে ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে যে ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, জুলাই-আগস্টের ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান তাকে অপসারণ করেছে, শেখ হাসিনা দেশ থেকে পলায়নে বাধ্য হয়েছেন। বহু প্রাণের বিনিময়ে যা অর্জিত হয়েছে, তা হচ্ছে সম্ভাবনা—বাংলাদেশ রাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের রাজনীতিকে ঢেলে সাজানোর সম্ভাবনা।
যেকোনো পরিবর্তন যেমন সম্ভাবনা তৈরি করে, তেমনি তৈরি করে অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগ। সারা বিশ্বের দীর্ঘ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে বিপ্লব এবং সাধারণ জনগণের অভ্যুত্থান, বিশেষ করে যেগুলো সাফল্য লাভ করেছে, সেগুলো স্থিতাবস্থাকে ভেঙে ফেলতে উদ্যত হয়। ফলে সেগুলো পরিবর্তনের অব্যবহিত পরেই, অবিলম্বে একধরনের স্থিতিশীলতা তৈরি করে না। পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি যত গভীর ও ব্যাপক, তাকে কেন্দ্র করে উদ্বেগ ও আশঙ্কা ততই ব্যাপক হয়। এর কারণ দুটি: প্রথমত, জনপ্রত্যাশা; দ্বিতীয়ত, এই পরিবর্তনের প্রতিপক্ষের ভূমিকা।
ব্যাপক পরিবর্তনে জনপ্রত্যাশা সৃষ্টি হয় দুভাবে। প্রথমত যাঁরা এই পরিবর্তনের নেতৃত্বে থাকেন, তাঁরা পরিবর্তনের আগে থেকেই এই ধারণা দেন যে তাঁরা কী ধরনের বদল চাইছেন। ফরাসি বিপ্লব তার অন্যতম উদাহরণ। তবে সবচেয়ে সহজবোধ্য উদাহরণ হচ্ছে বিংশ শতাব্দীতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবগুলো; যার অন্যতম হচ্ছে রাশিয়া, চীন ও ভিয়েতনাম। ফলে পরিবর্তনের প্রক্রিয়া যা–ই হোক—তা যত দীর্ঘ বা হ্রস্বই হোক না কেন—নাগরিকেরা জানেন, পুরোনো ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে বদলে যাবে। আর সেটাই জন–আকাঙ্ক্ষায় রূপ নেয়।
জনপ্রত্যাশা তৈরির আরেকটি পথ হচ্ছে যখন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা এতটাই বৈষম্যমূলক, জনবিচ্ছিন্ন এবং নিপীড়নমূলক হয়ে ওঠে যে এর পতনের পর সাধারণ মানুষের মধ্যে এই আশা তৈরি হয় যে যাঁরা দায়িত্বে আসীন হয়েছেন, তাঁরা পুরোনো ব্যবস্থাটাকে এমনভাবে বদলে ফেলবেন, যেন নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার স্থায়ী অবসান ঘটে। এ ধরনের পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হয় সাধারণত স্বতঃস্ফূর্ত গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীনদের অপসারণ ঘটলে।
এ ধরনের সম্ভাবনার মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ যেকোনো রাষ্ট্রের জন্যই বিরল। বাংলাদেশের জন্য ৫২ বছর পর সে সুযোগ ও সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
গত কয়েক দশকে বিভিন্ন দেশে এ ধরনের গণ–অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। তিউনিসিয়া (২০১১), মিসর (২০১১), আলজেরিয়া (২০১৯-২১), বেলারুশের (২০২১-২২) আন্দোলনগুলো এ ধরনের স্বতঃস্ফূর্ত গণ–অভ্যুত্থানের উদাহরণ। বেলারুশের ক্ষেত্রে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা থাকলেও এই আন্দোলনের ব্যাপকতা প্রমাণ করে যে এতে সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ ছিল প্রধান দিক। তিউনিসিয়া, মিসর ও আলজেরিয়ার আন্দোলনের সাফল্য বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের আলোচনা আছে, কিন্তু এটা লক্ষণীয় যে এসব অভ্যুত্থান ঘটেছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। এগুলো তৎকালীন ক্ষমতাসীন স্বৈরাচারী শাসকদের অপসারণ করতে সক্ষম হয়েছিল এবং রাষ্ট্রকাঠামো বদলের সম্ভাবনা তৈরি করেছিল। এ আশাবাদ পূরণ হয়নি; কিন্তু জন–আকাঙ্ক্ষা যে ব্যাপক ছিল, সেটা অনস্বীকার্য। চরিত্র ও প্রকৃতি বিবেচনায় এসব আন্দোলন ষাটের দশকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে ছাত্র আন্দোলন হয়েছিল, তার থেকে ভিন্ন। ষাটের আন্দোলনের লক্ষ্যকে এই বিবেচনায় সীমিত বলেই বলা যায়। বাংলাদেশে ১৯৯০ সালের গণ–অভ্যুত্থানও তুলনামূলকভাবে কম পরিবর্তনের প্রত্যাশা তৈরি করেছিল।
২০২৪ সালের গণ–অভ্যুত্থান এমন একটি আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে যে তা কেবল সাময়িকভাবে স্বৈরতন্ত্রকে পরাজিত করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। স্মরণ করা যেতে পারে যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের’ কথা বলেছিলেন। এ আহ্বানের কারণ হচ্ছে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার যে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন, তা দুএক বছরে তৈরি হয়নি। স্বৈরতন্ত্রের ব্যক্তিকরণ ঘটেছে ধীরে ধীরে, কিন্তু দৃশ্যমানভাবেই। একদিকে তা ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে এক ব্যক্তিকে স্থাপন করেছে, যার ক্ষমতার ভিত্তি হচ্ছে শক্তি প্রয়োগ। কিন্তু কেবল শক্তি প্রয়োগের দিকটি দেখলে এর গভীরতা বোঝা যাবে না। এই শাসন তৈরি করা হয়েছে একাদিক্রমে সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা এবং ক্লেপ্টোক্রেসি বা লুটপাটতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এই লুটপাটতন্ত্রের একটি বড় প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের সাম্প্রতিক বক্তব্যে, ‘শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা তাঁর শাসনামলে দেশটির একটি গোয়েন্দা সংস্থার কিছু সদস্যের সঙ্গে যোগসাজশ করে ব্যাংক খাত থেকে ১ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ সরিয়েছেন’ (প্রথম আলো, ২৮ অক্টোবর ২০২৪)।
সহজেই অনুমেয় যে এই হিসাব আংশিক। কিন্তু যেটা লক্ষণীয়, সেটা হচ্ছে কীভাবে রাষ্ট্রযন্ত্র এই লুটপাটের অংশীদার হয়েছে। এটা কেবল অর্থনীতির ক্ষেত্রে হয়েছে, তা নয়। রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গ এবং প্রতিষ্ঠানকেই ব্যবহার করা হয়েছে লুটপাটের জন্য—নাগরিকের ভোটাধিকার থেকে শুরু করে নাগরিকের বেঁচে থাকার অধিকার পর্যন্ত। এর ফলে রাষ্ট্রের চরিত্র আর ‘রাষ্ট্র’ বলেই দৃশ্যমান হয় না। অথচ এগুলোকে একধরনের আইনি এবং সাংবিধানিক বাতাবরণ দেওয়া হয়েছে।
এই পটভূমিতেই ২০২৪ সালের গণ–অভ্যুত্থানের জনপ্রত্যাশা হচ্ছে এই ব্যবস্থা যেন অব্যাহত না থাকে, এই রকম ব্যবস্থা যেন আবার ফিরে না আসে, তা রোধের স্থায়ী পথ তৈরি করা। সে জন্য দরকার প্রতিটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে পুনর্গঠন করা। গণ–অভ্যুত্থান সেই সম্ভাবনা তৈরি করেছে। অন্তর্বর্তী সরকার সেই আকাঙ্ক্ষার অংশ হিসেবেই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার করতে উদ্যোগী হয়েছে। রাষ্ট্রের ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠন জরুরি কাজ। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলো ‘সংস্কার’ ভবিষ্যতে আবার ফ্যাসিবাদ উত্থান রোধ করতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না গত ১৬ বছরের এই ব্যবস্থার আরও দুটি দিকের নজর দেওয়া হয়। একটি হচ্ছে এই ব্যবস্থা গড়ে ওঠার রাজনৈতিক বা আদর্শিক ভিত্তি; দ্বিতীয়টি হচ্ছে এই ধরনের শাসন বৈধকরণের আইনি ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়া। কীভাবে এগুলো বাংলাদেশের রাষ্ট্রকেই দুর্বল করে ফেলেছে, এক ব্যক্তির অধীন করেছে, সেটা বোঝা এবং সেগুলো মোকাবিলার বিষয় রাজনৈতিক শক্তির কাজ।
প্রথমটি করার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের বাধা প্রায় অলঙ্ঘনীয়; যতক্ষণ পর্যন্ত না দেশের নতুন এবং পুরোনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তি তা উপলব্ধি করবে, এই আদর্শিক লড়াই ততই দুর্বল হয়ে পড়বে। অন্তর্বর্তী সরকার দ্বিতীয়টির সূচনা করতে পারে, দিকনির্দেশনা দিতে পারে, প্রস্তাব করতে পারে, অংশত বাস্তবায়নও করতে পারে, কিন্তু এগুলো বাস্তবায়নের জন্য দরকার হবে একধরনের গাইড বা ভিশন, দরকার হবে অংশীদার হিসেবে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর প্রত্যক্ষ ও সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব।
এ ধরনের সম্ভাবনার মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ যেকোনো রাষ্ট্রের জন্যই বিরল। বাংলাদেশের জন্য ৫২ বছর পর সে সুযোগ ও সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। আপাতদৃষ্টে আমাদের জীবনযাপনের যে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, তাতে প্রতিদিন এই সম্ভাবনা হয়তো মূর্ত হয়ে উঠছে না, কিন্তু সেই বাস্তবতাকে অস্বীকার করা জাতির ভবিষ্যতের জন্যই ক্ষতিকর। যাঁরা সরকারের প্রাত্যহিক কাজে ব্যস্ত এই দায়িত্ব কেবল তাঁদের নয়; গত দশকগুলোতে যাঁরা গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন, এই দায়িত্ব তাঁদেরই বেশি।
এই সম্ভাবনাগুলো যেমন আছে, তেমনি আছে উদ্বেগ। উদ্বেগের কিছু বিষয় প্রাত্যহিক, সেটার মধ্যে আছে দৈনন্দিন জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া যাচ্ছে কি না, দ্রব্যমূল্য কমছে কি না, নাগরিকেরা নিরাপদ বোধ করছেন কি না, সেগুলো গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বড় আকারে উদ্বেগের জায়গা হচ্ছে পরাজিত শক্তির ভূমিকা। রাজনৈতিক দল হিসেবে কেবল আওয়ামী লীগই যে এই সম্ভাবনার বাস্তবায়নে বাধা, তা নয়। ক্লেপ্টোক্রেটিক ব্যবস্থার যাঁরা সুবিধাভোগী ছিলেন—রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের বাইরে ও ভেতরে—তাঁরাও একই উদ্দেশ্যে সক্রিয় থাকবেন, সেটাই স্বাভাবিক। এগুলো সহজেই চিহ্নিত করা যায়। এর সঙ্গে সহজেই দৃষ্টিগ্রাহ্য হচ্ছে ভারতের ভূমিকা। বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে চলা সম্পর্কের অসমতা এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার কারণে ভারতের এস্টাবলিশমেন্ট যে দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে, তাকে বিরূপ বলাও ছোট করে বলা।
কিন্তু সম্ভাবনা বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হতে হলে যে উদ্বেগের জায়গাটি মোকাবিলা করতে হবে, তা হচ্ছে যারা জুলাই-আগস্টের অভাবনীয় হত্যাযজ্ঞে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন, হুকুম জারি করেছেন তাঁদের এবং যাঁরা ১৬ বছর ধরে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের কীভাবে জবাবদিহির আওতায় আনা হবে। এই ক্ষেত্রে প্রকৃত অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করার প্রশ্ন আছে, আবার অন্যদিকে আছে বর্তমানে এবং ভবিষ্যতে প্রতিহিংসার পথ রুদ্ধ করে দেওয়া। যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের স্বজনদের এবং যাঁরা নিপীড়ন ভোগ করেছেন তাঁদের ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা পূরণ করা ছাড়া অগ্রসর হওয়ার পথ সীমিত।
* আলী রীয়াজ : সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান ও যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর