কোটা আন্দোলন থেকে সরকার পতন

আন্দোলনে নিহতদের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের সামনের রাস্তায় গায়েবানা জানাজা। ১৭ জুলাই ২০২৪ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

ছোটবেলা থেকেই রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বড় হয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে রাজনৈতিক পরিসরে নাহিদ ইসলাম, মাহফুজ আলমসহ বেশ কয়েকজনের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে। এরপর গুরুবার আড্ডায় রাজনীতি, অর্থনীতি, দর্শন, ইতিহাস—এসব নিয়ে যাত্রা শুরু হয়, লক্ষ্য ছিল নতুন রাজনীতি নির্মাণে রাজনৈতিক বোঝাপড়া তৈরি করা। একপর্যায়ে গুরুবার থেকে গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি। পরে চলতে চলতে কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে সরকার পতনের সাক্ষী হওয়া—বলা যায় একদম সামনে থেকে।

‘আর্ট অব মুভমেন্ট’

৫ জুন যখন কোটা নিয়ে হাইকোর্টের রায় আসে, সেদিনই সন্ধ্যায় শুরু হয় আন্দোলন। ৫, ৬ ও ৯ জুন আমরা আন্দোলনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগঠিত করি; ৯ থেকে ৩০ জুনের মধ্যে পরিপত্র বহালের আলটিমেটাম দেওয়া হয়। পুরো আন্দোলনের নেপথ্যে আলটিমেটামের এই ২১ দিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মূলত এই সময়ের ঈদের ছুটিতে দেশব্যাপী আন্দোলন সংগঠিত করা হয়। 

৯ জুন রাতেই রিফাত রশীদ ও হাসিবুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে বিস্তর পরিকল্পনা করি। সে রাতে আমরা যেসব পয়েন্ট মাথায় নিয়ে আমাদের ‘আর্ট অব মুভমেন্ট’ সাজিয়েছিলাম, সেই পয়েন্টেই পরে আন্দোলন জোরদার হয়। এ সময় ফেসবুক গ্রুপ ও ব্যক্তিগত যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে সারা দেশে শিক্ষার্থীদের সংগঠিত করতে থাকি। ঢাকার বাইরে আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে পাঁচ–সাতজনের একটা দল গঠন করা হয়েছিল। এর নেতৃত্ব ছিল আমার ওপরে। ১৬ জুলাই পর্যন্ত দেশের যতগুলো স্থানে আন্দোলন গড়ে উঠেছে, তার প্রায় প্রতিটিতেই যুক্ত ছিলাম। ওই সময়ই—১৩ জুন আবু সাঈদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। 

মূলত মাঠের রাজনীতিতে মানুষকে সংগঠিত করা এবং এর কৌশলের জায়গায় বেশি কাজ করতে হয়েছে আমাকে। এ ক্ষেত্রে সান জুর বই দ্য আর্ট অব ওয়ার মাঠের রাজনীতিতে কৌশল সাজাতে বেশ সাহায্য করেছে। আমি ভূতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী হওয়ায় বাংলাদেশের ভূগোল নিয়ে বোঝাপড়া, পাশাপাশি সান জুর কিছু ধারণা–কৌশল এবং মাঠের বাস্তবতা—সব একসঙ্গে করে সিদ্ধান্ত নিতে হতো। বাংলা ব্লকেডের সময় কোন কোন স্থানে ব্লকেড হবে, ঠিক করতাম। পয়েন্টগুলো এমনভাবে নির্বাচন করা হতো, যেন সর্বোচ্চ ফলাফল আসে। আন্দোলনের পয়েন্টগুলো আগে থেকেই ফেসবুক ও গণমাধ্যমে জানিয়ে দিতাম।

 ‘হাসিনাকে ফেলে দেব’

আবু বাকের মজুমদার। বৈষম্যবিবোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক

কোটা সংস্কার আন্দোলনে প্রথম গুলি চলে ১১ জুলাই—কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মিছিলে গুলি চালায় পুলিশ। প্রতিবাদে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক রাত ১১টা অবধি অবরোধ করে রাখেন শিক্ষার্থীরা। দুই পাশ মিলিয়ে প্রায় ২০০ কিলোমিটারে যানজটের সৃষ্টি হয় সেদিন। ঘটনার আগের দিন আমার সঙ্গে অনলাইনে তাঁদের একটা মিটিং হয়, পরদিন হামলা হতে পারে—তাঁরা এমন আশঙ্কা করছিলেন। এ নিয়ে তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করে কিছু কৌশল ঠিক করি। 

১৩ জুলাই সন্ধ্যায় আমার ভাতিজা ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। রাতে জানাজার উদ্দেশ্যে কুমিল্লা রওনা হই। ১৪ জুলাই সকালে জানাজা শেষে ফ্রিজিং ভ্যানেই ঢাকায় ফিরি। সেদিন ‘মার্চ টু বঙ্গভবন’ কর্মসূচিতে রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি দেওয়ার কথা। ঢাকায় পৌঁছে দেখি, মিছিল গুলিস্তান জিপিওর কাছে। স্টেডিয়াম মোড়ে ব্যারিকেড দিয়েছে পুলিশ; জিপিও ও পুলিশি ব্যারিকেডের মাঝখানে কিছু গাড়ি ইচ্ছাকৃতভাবে আটকে রেখেছে, যাতে মিছিল সামনে আসতে বাধা পায়। কিন্তু পুলিশ চাইলেই গাড়িগুলো সেদিন ছেড়ে দিতে পারত, তা না করে তারা বরং শান্তিপূর্ণ মিছিলটি বাধাগ্রস্ত করে। 

আমার মনে হয়েছিল, পুলিশ চাইছিল উত্তেজিত শিক্ষার্থীরা যেন বাস-গাড়িতে আঘাত করে তাদের ফাঁদে পা দেন। কিন্তু আমরা তা হতে দিইনি, যাঁরা যাঁরা মাইকের দায়িত্বে ছিলেন, দৌড়ে গিয়ে সবাইকে সতর্ক করি। শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি শেষ হয়।

কিন্তু না, সেদিন তৎকালীন ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলে সম্বোধন করেন। কথাটি আমাদের আত্মমর্যাদায় আঘাত করে। 

তখন আমি ছিলাম চানখাঁরপুলের একটি বাসায়। লুৎফর রহমান নামের এক বড় ভাইকে সেদিন বলেছিলাম, ‘ভাই, আমার কাছে মাত্র ১০ টাকা আছে। ৫০০ টাকা দেন, ফেস্টুন বানাতে হবে।’ তিনি বলেন, তাঁর কাছে খুব বেশি টাকা নেই। তখন বললাম, ‘আপনি ৫০০ টাকা দিলে হাসিনাকে ফেলে দেব। আর না দিলে পড়বে না।’ তিনি ১০০০ টাকা বের করে দিলেন। এ সময় সামনে নাহিদ ভাইও ছিলেন। তিনি বললেন, ‘আমার কাছে মাত্র ৫০–৬০ টাকা আছে। আমাকে ৫০০ দাও, তুমি ৫০০ নাও।’

লুৎফর ভাই ছাত্রলীগের হাতে নির্যাতিত। ওই দিন যেহেতু হাসিনার বক্তব্যের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের রাস্তায় নামার অবস্থা তৈরি হয়েছিল, এটা আমাদের আশা জুগিয়েছিল, তাই লুৎফর ভাইকে অমন করে বলেছিলাম। ভেবেছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যদি হাসিনাকে লাল কার্ড দেখিয়ে দেন, তাহলে তাঁর আর বেশি সময় নেই।

১৪ জুলাই রাতে নাহিদ, আসিফ ভাইসহ আমরা কয়েকজন চানখাঁরপুলের বাসা থেকে একটা হ্যান্ডমাইক নিয়ে হলপাড়ায় যাই। সেখানে গিয়ে সবার সঙ্গে স্লোগান ধরি। একপর্যায়ে বিজয় একাত্তর হলে ছাত্রলীগ বাধা দিলে আমি আর আসিফ ভাই সামনে দাঁড়িয়ে সমাধানের চেষ্টা করি। কিন্তু আমার আর আসিফ ভাইয়ের ওপর আক্রমণ চালায় ছাত্রলীগ। পরে হলপাড়া থেকে মিছিল নিয়ে সূর্য সেন, মুহসীন, এফ রহমান, জহুরুল হক ও রোকেয়া হল হয়ে টিএসসিতে আসি।

আক্রমণের মুখে

১৫ জুলাই দুপুরে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ছিল বিক্ষোভ সমাবেশ। দুপুর ১২টা থেকে শিক্ষার্থীরা জড়ো হতে থাকেন। আনুমানিক বেলা একটার দিকে খবর আসে, হলপাড়ায় শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ সমাবেশে আসতে বাধা দেওয়া হয়েছে। আমরা সিদ্ধান্ত নিই, হলপাড়ায় যথারীতি আগের মতো যেতে হবে, নিয়ে আসতে হবে শিক্ষার্থীদের। নাহিদ ও আসিফ ভাই আমাকে দায়িত্ব দিয়ে টিএসসিতে থাকলেন।

আনুমানিক দুই থেকে আড়াই শ শিক্ষার্থী নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে হলপাড়ায় যাই আমরা। মূল স্লোগান ছিল, ‘বাধা দিলে বাধবে লড়াই, এ লড়াইয়ে জিততে হবে।’ ছাত্রছাত্রীরা এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দেন। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল হয়ে আমরা যখন বিজয় একাত্তর হলে, তখন ছাত্রলীগের বাধার মুখোমুখি হলাম। 

আগের রাতেও এ হলের শিক্ষার্থীরা স্লোগান দিয়ে বের হওয়ার সময় ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা বাধা দিয়েছিল। উল্লেখ্য, ১৪ জুলাই রাতে আমি আর আসিফ ভাই ছাত্রলীগের বাধা পেরিয়ে শিক্ষার্থীদের হলের ভেতর থেকে নিয়ে আসার চেষ্টা করলে তারা আমাদের আক্রমণ করে, হ্যান্ডমাইক কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। যে ছেলেটা হ্যান্ডমাইক টান দেয়, তাকে আমি পাল্টা টানে পেছনে নিয়ে আসি। আমাদের সহযাত্রী শিক্ষার্থীরা তাকে জসীমউদ্​দীন হলের মাঠে নিয়ে যান। অন্যদিকে আসিফ ভাই হল গেটে একা হয়ে পড়লে আক্রমণ চলে তাঁর ওপর। তিনি মাটিতে পড়ে যান। 

‘জনগণ, নেমে আসুন’

১৬ জুলাই শহীদ মিনারে বিক্ষাভ ও ১৭ তারিখে গায়েবানা জানাজার আগে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি সহিংস পরিস্থিতি তৈরি করে। এ সময় স্লোগানে স্লোগানে সবার প্রতি আহ্বান রাখি, ‘বাংলাদেশের জনগণ, নেমে আসুন, নেমে পড়ুন।’ ভিসি চত্বরে তখন আমি টানা দেড় ঘণ্টা স্লোগান দিই।

১৯ জুলাই ধানমন্ডি থেকে তুলে নেওয়া হয় আমাকে। সেবার আমাকে তেমন কিছু করেনি। জিজ্ঞাসা করেছে, কীভাবে আন্দোলন সংগঠিত করেছি, জানতে চেয়েছে টাকার উৎস। তাদের বলেছি, মাইক ও রিকশাভাড়া, ব্যানার প্রিন্ট করা আর অল্প কিছু পানি ছাড়া আমাদের কোনো খরচ নেই। চাইলে মাইকের দোকানে খবর নিতে পারেন, এখনো টাকা বাকি আছে। মূলত আমাদের টাকার উৎস ছিল গণচাঁদা। 

২৪ জুলাই আমাকে ছেড়ে দেয়। এরপর ২৬ জুলাই গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল থেকে নাহিদ, আসিফ ভাইসহ আবার আমাদের তুলে নেওয়া হয়, ডিবি অফিসে।

‘হারুনের ভাতের হোটেলে’

ডিবি অফিস মানেই ছিল ‘হারুনের ভাতের হোটেল’। ডিবি হেফাজতের দ্বিতীয় দিন নাহিদ, আসিফ ভাই ও আমার সঙ্গে হারুনের দেখা হলো, তখন তিনি খাচ্ছিলেন, আমাদের বললেন, ‘আমি নেতা ছোট করি, নেতা বানাই না! দেখোস নাই, নুরুরে কী করে ছেড়ে দিছি! নুরু এখন রিমান্ডে কান্নাকাটি করে।’ হারুনের ব্যবহার ছিল অত্যন্ত বাজে।

আমরা দৃঢ়ভাবে কথা বলছিলাম তাঁর সঙ্গে। একপর্যায়ে আমাকে বললেন, ‘তুই শিবির’! আমি বললাম, ‘না, আমি শিবির না।’ তখন একটু উচ্চ স্বরে বললেন, ‘না, তুই শিবির।’ এ সময় আমি তাঁর চেয়ে আরও একটু গলা চড়িয়ে বললাম, ‘না…।’ তখন তিনি আমাকে দেখিয়ে নাহিদ–আসিফ ভাইকে বললেন, ‘দেখ, সে কীভাবে কথা বলে!’

হারুনের কথার মাঝখানে গলা আরেকটু উঁচিয়ে বলতে থাকি, ‘আমার পুরো বাড়ির মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। আমাদের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্প করেছিলেন। আমি সেই বৃহত্তর পরিবারের সন্তান।’

ডিবি হারুনের সঙ্গে উচ্চ স্বরে কথা বলব—এটা তিনি মানতে পারেননি। খাবার থালাটি ছুড়ে ফেলে এক অফিসারকে ইশারায় বললেন আমাদের নিয়ে যেতে। তিনজনকে তিনটি আলাদা রুমে নেওয়া হলো। 

রুমে যাওয়ার তিন–চার মিনিট পর দুজন লোক এসে দরজায় আসতে বলল আমাকে। তাদের হাতে ছিল জমটুপি ও হাতকড়া। বুঝে গেলাম, হারুনের সঙ্গে উচ্চবাচ্য করার ফল খারাপ হতে যাচ্ছে।

খারাপ হয়েছিলও। আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো অন্য এক রুমে। ওদের কথায় বুঝতে পারছিলাম, ওরা মোটামুটি আমাদের সবই জানে। শুরুতেই আমাকে বলল, ‘তুই তো জুনের ৯ থেকে ৩০ তারিখ পর্যন্ত সারা দেশকে সংগঠিত করতে লিড দিছস, তোর তো আন্দোলন বড় করার অনেক খায়েশ! তোরে এগুলো কে শিখাইছে?’ কথাবার্তার একপর্যায়ে আমার হাত ওপরে ঝুলিয়ে বাঁধা হয়। আমি বলি, পিঠে মারলে মরে যাব, বাঁ পায়ে একটু সমস্যা আছে, বাঁ পা–টা ভেঙে যাবে। ওরা কিছু বলে না। নিতম্বে মোটা শক্ত লাঠি দিয়ে একের পর এক আঘাত করে, করতেই থাকে। চিৎকার করে উঠি। ওরা বলে, ‘প্রাইম মিনিস্টারকে ধন্যবাদ দিয়ে বিবৃতি দিবি?’ বলি, ‘না।’ চলতে থাকে এভাবেই। বেধড়ক মার। হাত ওপরে ঝোলানো হলেও পায়ের আঙুল মেঝেয় লাগিয়ে একটুখানি ভর দেওয়া যাচ্ছিল।

প্রথম দফা মারার পর আমাকে দীর্ঘ সময় ঝুলিয়ে রাখা হয়। স্বাভাবিকভাবে ঝোলানো অবস্থা থেকে বসালে ব্যথা আরও বেড়ে যায়, ঝোলানো থেকে হাত খোলার পর হাঁটতে তাই খুব কষ্ট হচ্ছিল, হাঁটতে গিয়ে দেখি পারছি না। এমন পরিস্থিতিতে দুজনের কাঁধে দুই হাতের ভর দিয়ে অনেক কষ্টে রুমে গেলাম। ওখানে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের একজন বললেন, ‘সুস্থ একটা মানুষকে নিয়ে দেখো কী করে দিছে, এদের আল্লাহ মাফ করবে না!’

* আবু বাকের মজুমদার: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক