কর্মীর লেখা
ভাড়ায় খবরের কাগজ
প্রথম আলোর ২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কর্মীদের কাছে লেখা আহ্বান করা হয়েছিল। তাঁরা লিখেছেন প্রথম আলোকে নিয়েই। কর্মীদের নির্বাচিত কিছু লেখা নিয়েই এ আয়োজন।
তিন বছর ধরে এই বিশেষ দিনটি ঘিরে আমার কিছু অনুভবের কথা লেখার চেষ্টা করে আসছি। লেখা হয়ে উঠলেও জমা দেওয়ার সাহস পেতাম না। বিব্রত বোধ করতাম, যদি গুণী বিচারকেরা বিরক্ত হন অ-লেখকের এ ধরনের লেখা পড়ে! অবশেষে এবার মনে হলো, সেই বাধা ডিঙিয়ে ওপারে কী আছে, তা দেখা উচিত। নতুবা আফসোস নিয়েই পার হয়ে যাবে সামনের দিনগুলো।
প্রথমে ভাবছিলাম, কী নিয়ে লিখব। প্রথম আলোর প্রতি আমার ভালো লাগার কথা, ভালোবাসার কথা; নাকি এখানে এসে আমার যে মানসিক ও নৈতিক পরিবর্তন হয়েছে, সেই কথা। কিন্তু এ ধরনের লেখা তো প্রতিবছরই লিখছেন কেউ না কেউ। আমি বরং অন্য গল্প বলি। কিছু স্মৃতিচারণা করি।
পরিণত বয়সের কাউকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, সুযোগ থাকলে কী ফেরত চাইতেন? আমার ধারণা, মধ্যবিত্ত প্রায় সবাই অকপটে বলবেন, কৈশোর থেকে প্রথম যৌবনের সময়টুকু।
সে সময় একটা নিয়ম ছিল, হয়তো এখনো আছে—সকালে পত্রিকা রেখে বিকেলে ফেরত দিলে দাম কম রাখতেন হকাররা। আমার টিউশনির টাকায় বাসায় প্রবেশ করল দৈনিক প্রথম আলো।
নব্বই-পরবর্তী মধ্যবিত্ত পরিবারের আভিজাত্যের প্রতীক ছিল দৈনিক পত্রিকা। বাড়ির বড়রা অফিসে বের হওয়ার আগে চায়ের কাপে শেষ চুমুকটুকু দিতে দিতে পত্রিকায় চোখ বুলিয়ে নিতেন। দাদুর দিনের একটা সময় কাটত দেশের খবরে চোখ বুলিয়ে। আর কৈশোর ও যৌবনের মাঝামাঝি ছেলেমেয়েরা খেলা, বিনোদন ও হাল ফ্যাশনের পাতায় ডুব দিত।
তবে আমার গল্পটা ভিন্ন। আমার ভাইবোনের সংখ্যা নেহাত কম নয়। তার ওপর সবাই তখন শিক্ষার্থী। বিপরীতে একমাত্র উপার্জন করা মানুষটি আমার বাবা। ফলে বাড়িতে দৈনিক পত্রিকা রাখা আমাদের জন্য ছিল বিলাসিতা। কিন্তু মন কি আর অত কিছু বুঝত! পত্রিকার দোকান, সেলুন কিংবা চায়ের দোকানে বসে বিভিন্ন পত্রিকা পড়তাম। কোনো কোনো পত্রিকায় টুকটাক লেখা পাঠাতাম। ছাপাও হতো মাঝেমধ্যে।
একদিন বাড়িতে পত্রিকা রাখার উপায় বের হলো। সে সময় একটা নিয়ম ছিল, হয়তো এখনো আছে—সকালে পত্রিকা রেখে বিকেলে ফেরত দিলে দাম কম রাখতেন হকাররা। আমার টিউশনির টাকায় বাসায় প্রবেশ করল দৈনিক প্রথম আলো। তবে বিকেলে ফেরত নেওয়ার শর্তে। কিন্তু এই পদ্ধতিতে সব সময় মিলত না প্রথম আলো। তাই সেদিন সেই পুরোনো ঠিকানায় যেতে হতো পত্রিকাটি পড়তে।
ইতিমধ্যে বেঁধে গেল লঙ্কাকাণ্ড। বাড়িতে পত্রিকা এলে যা হয় আরকি! বোন দেখে পোশাক, আমি খেলার পাতা ও বিনোদন, বড় দুই ভাই আর বাবা রাজনীতি ও দেশের খবর। কখনো হয়তো গোপনে নায়িকাদের খবর। ফলে পত্রিকার পাতা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যায়। মাঝেমধ্যে পাতা গুম হয়। কেউ হয়তো চুরি করে কাঁচি দিয়ে কেটে নিয়ে গেছে পছন্দের তারকার ছবি। সেই পত্রিকা তো আর ফেরত যাওয়ার নয়!
পরিবার নিয়ে কিংবা বন্ধুবান্ধবসহ মাত্র এক বেলায় রেস্টুরেন্টে যে বিল দিই আমরা, তা কয়েক মাসের পত্রিকার বিলের সমান।
মাঝখানে সময় গড়িয়ে গেছে অনেক। আজ ৪ নভেম্বর ২০২৪ তারিখে লেখাটি যদি মঞ্চে পড়া হয়, তাহলে জানবেন, ইতিমধ্যে পৃথিবী আরও ২৬ বার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে ফেলেছে। এর মধ্যে বদলে গেছে অনেক কিছু। সেই দুরন্ত শৈশব পেরিয়ে যৌবনের শেষ দশক পাড়ি দিচ্ছি আমি। আর কর্মসূত্রে চাকরি করছি সেই প্রথম আলোতে।
বাড়িতে আজও প্রথম আলো পৌঁছে যায় সকাল সকাল। বাড়ির বড় হিসেবে ঘুম থেকে উঠে পত্রিকাটি হাতে নিয়ে চোখ বোলাই। পত্রিকার ভেতরের লেখাগুলোতে খবর পাই, বদলে গেছে অনেক কিছু। বদলে গেছে মধ্যবিত্তের আচার, বদলে গেছে আভিজাত্যের ধরন আর সংজ্ঞা। কাগুজে পত্রিকার নয়, দামি রেস্তোরাঁয় বসে ছবি তুলে মানুষকে দেখানোটাই নাকি এখনকার মধ্যবিত্ত-আভিজাত্য। মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে নাকি দৈনিক পত্রিকা এখন নেহাতই অপ্রয়োজনীয় বস্তু। পড়ার লোক নেই কিংবা অপ্রয়োজনীয় খরচ। অথচ পরিবার নিয়ে কিংবা বন্ধুবান্ধবসহ মাত্র এক বেলায় রেস্টুরেন্টে যে বিল দিই আমরা, তা কয়েক মাসের পত্রিকার বিলের সমান।
লেখাটা শুরু করেছিলাম আপনাদের নস্টালজিয়ায় ভাসাতে। শেষে এসে মনে হচ্ছে, পথ ভুলে হতাশার কথায় ঢুকে গেছি। কিন্তু প্রথম আলো তো আলোর পথ দেখায়। তাই অভিমান নয়, বরং আপনাদের সময়ের কথা শোনাই। এই যে কাগজের বাইরে আপনারা মুঠোফোনে এখন ভিডিও মাধ্যমে যা দেখেন, সেই ডিজিটালেই আমার কর্ম। একজন সিনিয়র প্রডিউসার হিসেবে ডিজিটাল মাধ্যমে প্রথম আলোর কিছুটা অংশ আপনাদের কাছে পৌঁছে দেওয়াই আমার কাজ।
অফলাইন কিংবা অনলাইন, কাগজ কিংবা মুঠোফোন; যেখানে যাবেন, প্রথম আলোকেই পাবেন। আর হ্যাঁ, আমাকেও পাবেন।
মোহাম্মদ ইব্রাহীম : সিনিয়র কনটেন্ট প্রডিউসার, ভিডিও বিভাগ