পাঠচক্র থেকে গণ-অভ্যুত্থানে
ভাবিনি কখনো সামনের সারিতে এসে রাজনীতি করব। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের শুরু থেকে রাজনীতিতে আগ্রহ ছিল। যুক্ত ছিলাম প্রথম কোটা আন্দোলনে। সামাজিক একটা পরিবর্তন চাইতাম। যখন প্রথম বর্ষে পড়ি, ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলনে আমার এক সহপাঠীকে আটক করা হয়। ঘটনাটি আমাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে।
২০১৯ সালে নুরুল হকের প্যানেল থেকে ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিই। কিন্তু প্রথাগত ধারার রাজনীতি কখনো সেভাবে আমাকে আকর্ষণ করেনি। তাই নুরুল হকের সংগঠনে পরে আর যুক্ত হইনি। তবে ক্যাম্পাসের যেকোনো ন্যায্য আন্দোলনে সব সময় সোচ্চার ছিলাম। ২০১৯ সালে আবরার ফাহাদ হত্যার প্রতিবাদে যে আন্দোলন হয়, সেখানে ছিলাম। সন্ত্রাসবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আমার ভূমিকা ছিল। ২০২০ সালে সীমান্ত হত্যার প্রতিবাদে রাজু ভাস্কর্যের সামনে নাসিরউদ্দিন পাটোয়ারী ৫৫ দিন কর্মসূচি পালন করেন। সেখানে আমরা আড্ডা দিয়েছি, মাহফুজ ভাইয়ের (মাহফুজ আলম) সম্পাদনায় কাঁটাতার নামে পত্রিকা বের করেছি। ওই সময় আমার ভেতরে একটা পরিবর্তন আসে। বুঝতে পারি, নতুনভাবে শুরু করতে হবে। তবে কী করব, তা জানতাম না। এ সময় পৃথিবীতে করোনা শুরু হলো।
করোনার পর ক্যাম্পাসে ফিরে দেখলাম, আবরার হত্যাসহ আরও কিছু নিপীড়নমূলক ঘটনায় ছাত্রলীগের ভাবমূর্তি যেভাবে নাজুক হয়েছিল, তারা সেটা কাটিয়ে উঠেছে—ছাত্রবান্ধব কর্মসূচি দিচ্ছে, লাইব্রেরি করছে ইত্যাদি। অনুভব করলাম, ছাত্র আন্দোলন হারিয়ে যাচ্ছে। তাই একটু পড়াশোনার মধ্যে ঢুকলাম। এই পর্যায়ে মাহফুজ ভাইয়ের নেতৃত্বে অনেকটা গোপনেই শুরু হলো গুরুবার আড্ডা। রাজনৈতিক সংস্কৃতি, ছাত্র আন্দোলন, ধর্ম প্রভৃতি বিষয় নিয়ে পড়াশোনা আর তর্ক—এভাবেই আড্ডাটা চলছিল।
২০২২ সালে আবরারের স্মরণসভায় হামলা হয়। এ ঘটনায় সে সময় ছাত্রদের পাশে কেউ দাঁড়ায়নি। একপর্যায়ে ২০২৩ সালের ৪ অক্টোবর গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি নামে নতুন সংগঠন করলাম। এর মধ্যে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি কোনো বাধা ছাড়াই ভোটারবিহীন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এল। সবার মধ্যেই হতাশা।
আমি তখন টিউশনি করতাম, কোচিংয়ে ক্লাস নিতাম। তবে মূল লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে ছাত্রশক্তির সাংগঠনিক বিস্তার ঘটানো। আমরা হাল ছাড়িনি। নানা ইস্যুতে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছি। সংগঠনের ব্যানারে না করে সাধারণ ছাত্রদের ব্যানারে বিভিন্ন অনুষ্ঠান, ইফতার মাহফিল, ফিলিস্তিনের সঙ্গে সংহতি, নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে কর্মসূচি—এসব করেছি। আমাদের চিন্তা যত না ছিল সংগঠন করা, তার চেয়ে বেশি ছিল সংগঠনের হাত ধরে একটা রাজনৈতিক পরিসর রচনা এবং ছাত্রদের সেখানে যুক্ত করা। এ জন্য আমরা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ওপর জোর দিই। মাহফুজ ভাই, আসাদ ভাই (ভূঁইয়া মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান) মিলে পূর্বপক্ষ ও রণপা নামে পত্রিকা বের করেন। পাশাপাশি চলে গুরুবার আড্ডা, রসিক আড্ডা নামের পাঠচক্র এবং ছয়চক্র নামের একটি একাডেমিক আড্ডা। আরও ছিল রাষ্ট্রকল্প লাইব্রেরি। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে এগুলো আদতে ছিল লড়াই।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সূচনা
৫ জুন মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করে জারি করা পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট।
এই বাস্তবতায় আমরা ওই দিন সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে জড়ো হই। সবাই মিলে গ্রন্থাগারের ভেতরে গিয়ে বিসিএসপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ডাকলাম। স্বতঃস্ফূর্তভাবে সবাই-ই এল। আমরা একটা দলের মতো হলাম। গ্রন্থাগারের সামনে মিছিল করে কোটা পুনর্বহালের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দিলাম। তখন কিন্তু আমাদের কোনো ব্যানার ছিল না। ব্যানারবিহীনভাবে মাত্র তিনটি কর্মসূচির পর কোরবানি ঈদের বন্ধ শুরু হলো। আন্দোলনে ঈদের আগে অল্প কয়েকজন মেয়ে ছিল, পরে অনেকে যোগ দেয়। আমরা আলটিমেটাম দিলাম।
ঈদের মধ্যে সাংগঠনিকভাবে গোছালাম। সারা দেশে তৈরি করলাম প্রতিনিধি নেটওয়ার্ক। সব বিশ্ববিদ্যালয়ে একই সময়ে অভিন্ন কর্মসূচি দেওয়া হলো। জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, বরিশাল, রংপুরের বেগম রোকেয়া—বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় স্বতঃস্ফূর্তভাবে শুরু হলো আন্দোলন। ঈদের ছুটিতে আমরা বিভিন্ন সার্কেলে গিয়েছি, বুদ্ধিজীবীদের কাছে গিয়েছি। তেমন সাড়া পাইনি।
ঈদের পর ১ জুলাই আন্দোলন শুরু হলেও ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে যাত্রা শুরু হয় ৫ তারিখ। ‘কোটা পুনর্বহাল চাই না’ ফেসবুক গ্রুপে নাম আহ্বান করলে এই নামের পক্ষে বেশি ভোট পড়ে। আর এমন নাম দেওয়ার কারণ হলো, কোটা নিয়ে ২০১৮ সালের আন্দোলনটা ছিল ব্যক্তিগত স্বার্থের জায়গা থেকে। ফলে এমন একটা নাম আমরা দিতে চেয়েছি, যাতে নামের মধ্যেই একটা নীতি প্রতিফলিত হয়। শুধু চাকরি নয়, এ আন্দোলনের মাধ্যমে দুর্নীতির বিতাড়ন, ভালো আমলাতন্ত্র—এসবও যুক্ত করতে চেয়েছিলাম। করা যায়নি। মাঠে শুধু বৈষম্যবিরোধীটাই টিকে গেছে।
আন্দোলনের কৌশল
আন্দোলনে সব সময় ভিন্ন ধরনের নামে কর্মসূচি দেওয়ার চেষ্টা করেছি আমরা। হরতাল-অবরোধ—এসব খুব প্রচলিত। মানুষ জানে এখানে কী হয়—একটা বাধা আসে, পুলিশ বা ছাত্রলীগ হামলা করে। তাই আমরা ‘বাংলা ব্লকেড’ নাম দিলাম এই চিন্তা করে যে শহুরে মধ্যবিত্ত এখানে যুক্ত হোক। আবার জেন-জি প্রজন্মও যেন যুক্ত হয়, তা-ও আমাদের লক্ষ্য ছিল। এই ভিন্নধর্মী কর্মসূচির প্রভাব কিন্তু আন্দোলনে বেশ ভালোভাবেই পড়েছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করার মধ্য দিয়ে আন্দোলন যখন দমনের চেষ্টা হলো, তখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছেন। আবার দোয়া-মোনাজাত, গায়েবানা জানাজা—এ ধরনের কর্মসূচিও ছিল আমাদের। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা এতে সংযুক্ত হয়েছেন। আদতে আমরা ডান-বাম, শহর-গ্রামসহ নানান মতাদর্শের মানুষ যেন একটা জায়গায় দাঁড়াতে পারে—এমন এক পরিসর তৈরি করতে চেয়েছি।
আমাদের রাজনৈতিক অবস্থান ছিল মধ্যপন্থী। বামপন্থী-ইসলামি-বিএনপিপন্থী—সবার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। এ অবস্থানের কারণে সবার সঙ্গেই আমরা মিশতে পারতাম, এখনো পারি।
আন্দোলনের আরেকটি কৌশলগত দিক ছিল একক নেতৃত্ব না রাখা এবং পরিচিত কাউকে সামনে না আনা। আমি যেহেতু পরিচিত ছিলাম না, তাই সামনে ছিলাম। এমনকি প্রথম দিকে জুনিয়ররা সামনে ছিল। প্রতিদিনই গান-কবিতা হচ্ছে। অপরিচিতদের দেখে সবাই যুক্ত হচ্ছে। কেউ বুঝতেই পারেনি, এখানে নেতৃত্বটা দিচ্ছে কে।
শেখ হাসিনা তখন দেশে ছিলেন না, চীনে গিয়েছিলেন। আমরা ভেবেছি, দেশে ফিরে তিনি ইতিবাচক কিছু একটা বলবেন। কিন্তু ১৪ জুলাই তিনি আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলে কটূক্তি করলেন। কথাটি সবার আত্মমর্যাদায় আঘাত করল। ওই রাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে হল থেকে বেরিয়ে এলেন ক্যাম্পাসের সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা।
১৫ জুলাই মেয়েদের ওপর ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা হামলা করল। ক্যাম্পাস থেকে আমরা বিতাড়িত হলাম। ১৫ তারিখ রাত থেকে একটু একটু পালিয়ে থাকতে শুরু করি। মুঠোফোন বন্ধ রাখি। ১৬ জুলাই রংপুরে আবু সাঈদসহ ছয়জন শহীদ হন। এদিন বিকেলে শহীদ মিনারে আমাদের কর্মসূচি ছিল। সবাই লাঠি নিয়ে শহীদ মিনারে এলেন। আমি ঘোষণা করলাম, আবু সাঈদ শহীদ হয়েছেন। মারা যাওয়ার আগের দিনও বাকেরের (আবু বাকের মজুমদার) সঙ্গে তাঁর কথা হয়।
আবু সাঈদ শহীদ হওয়ার পর থেকেই মূলত আন্দোলন সর্বব্যাপকতা লাভ করে। গণজোয়ার শুরু হয়। জাহাঙ্গীরনগর, ঢাকা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধ করে তাদের বিতাড়িত করেন শিক্ষার্থীরা। মেয়েদের হলে শুরু হয় প্রতিরোধ। এ আন্দোলনে মেয়েদের ভূমিকা ছিল ব্যাপক। আন্দোলনের বড় শক্তিও তাঁরা।
যেভাবে গোয়েন্দাদের ধোঁকা দিয়েছিলাম
আমাদের আন্দোলনের সফলতার আরেকটি বড় কারণ হলো, গোয়েন্দাদের ধোঁকা দিতে পারা। ১৬ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো বন্ধের ঘোষণা দেয় ইউজিসি। ১৭ জুলাই ছিল কফিনমিছিল। ওই দিন আবার মহররম। আমরা এত প্রচারণা করতে পারিনি। সেদিনও পুলিশ, র্যাব, বিজিবি সম্মিলিতভাবে আমাদের আক্রমণ করে। এর মধ্যে ডিজিএফআইয়ের লোকজন কথা বলতে চায় আমাদের সঙ্গে। তারা চেয়েছিল আমরা যেন সবাইকে নিয়ে ওদের সঙ্গে বসি, যাতে ওদের পক্ষে সবাইকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়। কিন্তু সবাইকে নিয়ে ওদের সঙ্গে আমরা বসিনি, আমাদের কেউ কেউ বসেছে আর পরিকল্পনা করেই কাউকে কাউকে বাইরে রাখা হয়েছে। ক্যাম্পাসের মধ্যে ওদের সঙ্গে যখন বসেছি, তারা আমাদের বলেছে, ‘তোমরা সংলাপ করো। তোমরা যার সঙ্গে বসতে চাও, তার সঙ্গেই বসতে পারো।’ বিপরীতে আমরা বলেছি, ‘ঠিক আছে আপনাদের কথা মানলাম।’ আমি হয়তো গোয়েন্দাদের সঙ্গে মিটিংয়ে বসেছি, আর আসিফকে (আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া) রাখা হয়েছে বাইরে। আমাদের মিটিং শেষ হওয়ার আগেই সে পরের দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করে দিয়েছে। গোয়েন্দারা বারবার এভাবে বিভ্রান্ত হয়েছে। ওরা বুঝতে পারত না, কাকে বললে কী হবে? কে মূল নেতৃত্বে?
একপর্যায়ে ভাবতে থাকি, যেকোনো মুহূর্তে আমাদের গ্রেপ্তার করবেন গোয়েন্দারা। তাই তাঁদের সঙ্গে বৈঠকের সময় নিজেদের মুঠোফোন নিয়ে যাইনি। এ সময় তাঁরা আবারও আমাদের বলেন, ‘তোমাদের সবাইকে লাগবে, তোমরা সংলাপে বসো।’ আমরা বলেছি, ‘আমাদের হল থেকে বের করে দিচ্ছেন, মন্ত্রীরা নেতিবাচক বক্তব্য দিচ্ছেন, ক্যাম্পাস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, এভাবে তো সংলাপ হয় না। এগুলো ঠিক করেন, বসব।’ তাঁদের এভাবে বুঝ দিয়ে বের হতাম। কথা দিলেও তা বাস্তবায়ন করতাম না, অন্য কিছু একটা করতাম।
১৮ জুলাই কমপ্লিট শাটডাউনের ঘোষণা দিলাম। এ সময় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মাঠে নামলেন, শহীদ হলেন অনেকে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যখন মারা হচ্ছিল, সে সময় শুরু হয়েছে আমাদের পলাতক জীবন—মাঠে ছিলাম না—সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছিলাম। ভিডিও–বক্তৃতা দিচ্ছি, ঘন ঘন জায়গা পাল্টাচ্ছি। কাছে কখনো মুঠোফোন ছিল, কখনো ছিল না। সবই করেছি গোয়েন্দাদের ধোঁকা দেওয়ার জন্য। জানতাম আমাদের গ্রেপ্তার করা হবে। এক রাতে ধানমন্ডির একটা বাসায় ছিলাম। হঠাৎ মনে হলো, আমি এখানে নিরাপদ না। কাউকে না বলে খালি পায়ে বের হয়ে গেলাম। ওই রাতে ধানমন্ডির একটা মসজিদে ছিলাম। পরদিনই সেই বাসার মালিককে তুলে নিয়ে গেছে। সে রাতে ওখানে থাকলে গ্রেপ্তার হতাম নিশ্চিত।
তুলে নিয়ে গেল
১৯ জুলাই ১০-১২ দিন পর বাসায় গেলাম। তত দিনে ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেছে। আসিফ ও বাকেরের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে পারলাম না। সরকার সে সময় একদিকে নির্বিচার মানুষ মারছে, অন্যদিকে ধরছে আন্দোলনকারীদের। আওয়ামী বয়ান ছিল, মৃত্যুর জন্য ছাত্ররা দায়ী, আন্দোলনকারীরা দায়ী। সরকারবিরোধীরা সুযোগ পেয়েছে, তাই এত মানুষ মারা গেছে।
এদিকে এভাবে পালিয়ে বেড়াতে আমার আর ভালো লাগছিল না। ভাবলাম, যা হওয়ার হবে, এবার প্রকাশ্য হব। ১৯ জুলাই সন্ধ্যায় নন্দীপাড়ায় এক বন্ধুর বাসায় গেলাম। রাত ১১টায় কারফিউর সংবাদ দেখলাম। তবে ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমে আন্দোলনের কোনো সংবাদ নেই। তখন আমি বিবিসি, এএফপি ও নেত্র নিউজের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। বার্তা পাঠালাম, শাটডাউন অব্যাহত থাকবে।
রাত বোধ হয় তখন আড়াইটা-তিনটা বাজে। ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ ডেকে তোলা হলো আমাকে। শুনলাম, ডিবি পুলিশ এসেছে। ছাদে চলে গেলাম। আমাকে অনুসরণ করে পুলিশও উঠে এল ছাদে। তাদের বললাম, ‘আমিই নাহিদ ইসলাম।’ চোখ বেঁধে আমাকে নিয়ে চলে গেল তারা। পরে আমাকে একটা রুমে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করল, কার কার সঙ্গে যোগাযোগ আছে, কে টাকা দেয় ইত্যাদি।
২০ জুলাই বিকেল থেকে আমাকে ওরা দাঁড় করিয়ে হাতে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে মারতে থাকে। কেউ এসে মারে, কেউ বোঝায়। কেউ আবার ইমোশনাল কথাবার্তা বলে। বলে, ‘আন্দোলন স্থগিত করো।’
আমাকে ওরা খাবারের সঙ্গে কিছু মিশিয়ে দিয়েছিল কি না জানি না, ডিবিতে সব সময়ই হ্যালুসিনেশনের মতো হতো আমার। একসময় তারা বলল, ‘তোমাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। কাল কোর্টে রায় হবে। তুমি গিয়ে সংবাদ সম্মেলন করবে, আন্দোলন স্থগিত করবে। কোটা সংস্কার হয়ে যাবে। তোমরা চাইলে আন্দোলন থেকে এভাবে এক্সিট নিতে পারবে।’ আমি হ্যাঁ-না কিছুই বলিনি।
২১ জুলাই ভোর চারটার দিকে আমাকে তারা পূর্বাচলে ফেলে যায়। বলেছিল, ‘তোমাকে যে তুলে এনেছি, এটা কেউ জানে না। কাউকে জানাবে না। জানালে আবার তুলে নিয়ে যাব।’ তারা আমার পকেটে এক হাজার টাকাও দিয়ে যায়, যাতে বাড়ি ফিরতে পারি। গোটা দিন গোয়েন্দারা আমাকে নির্যাতন করেছিল। আন্দোলনের পরিস্থিতি কিছুই জানতাম না। ২১ তারিখ ভোরে প্রথম আলো, নিউ এজসহ ৮-১০টি পত্রিকা কিনে বাসায় এলাম। পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা পেলাম।
তারপর চিকিৎসার জন্য গেলাম গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে। সেখানেও গোয়েন্দা সংস্থা পিছু ছাড়ল না। আদতে ২২ জুলাই থেকেই গণস্বাস্থ্যে আমরা ওদের কাছে জিম্মি ছিলাম। দরজার সামনে সব সময় সাত-আটজন গোয়েন্দা থাকত। ইন্টারনেট সংযোগ কেটে দিয়েছিল। দর্শনার্থীদের আসতে দিত না। এমনকি আমার মুঠোফোনও নিয়ে গিয়েছিল। তখন সহযোদ্ধা অনেকের খোঁজ পাচ্ছি না। এদিকে গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন ক্রমাগত আমাদের চাপ, প্রলোভন, সবশেষে হুমকি দিচ্ছে। ওদের এসবের উদ্দেশ্য ছিল আন্দোলন দমন করা। আমাদের বলল, ‘সংবাদ সম্মেলন করো।’ কী কী বলতে হবে, তা তারা শিখিয়ে দিল।
তবে ২৩ জুলাই ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) মিলনায়তনে যে সংবাদ সম্মেলন হলো, সেখানে আমরা ওদের শেখানো কথা বললাম না। ওরা কোনোভাবেই আমাকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। কারণ, ওদের আমি এক কথা বলি, আবার গণমাধ্যমে বলি সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা।
এর মধ্যে আসিফ, বাকেরও গণস্বাস্থ্য হাসপাতালবাসী হয়। একপর্যায়ে হাসপাতাল থেকে আসিফ, বাকেরসহ আমাকে ওরা আবার তুলে নেয়। এবার ডিবি অফিসে। পরে আরও কয়েকজন সমন্বয়ককে তুলে আনা হয়। চলতে থাকে মানসিক-শারীরিক নির্যাতন। ওরা বলে, মেয়েদের ধরে নিয়ে আসবে। যেসব সমন্বয়ক এখন বাইরে আছে, তাদেরও গুম করা হবে। নানা রকম চাপ দিয়ে আমাদের কাছ থেকে বিবৃতি আদায় করে তারা।
বলা দরকার, ডিবি অফিসেই পুলিশের নিম্নপদস্থ দু-একজন আমাদের সাহায্য করত। রাতে পত্রিকা দিতে চেষ্টা করত।
৩০ তারিখ ছাড়া পেলাম আমরা। নির্যাতনের ধকলে আমি তখন খুব অসুস্থ। কী হচ্ছে বুঝতে পারছি না। ডিবিতে বাধ্য হয়ে বিবৃতি দিয়েছি, মানুষ ভুল বোঝে কি না—এসব নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলাম। পরে বুঝলাম, না, সবাই বুঝতে পেরেছে কোন পরিস্থিতিতে আমরা সেদিন বিবৃতিটি দিয়েছিলাম।
অতঃপর এক দফা
ব্যক্তিগতভাবে ১-২ আগস্টেই আমি বুঝেছি, এবার এক দফার ঘোষণা দিতে হবে। ৩ জুলাই বলেছিলাম, আমাদের চোখ গণভবনের দিকে। এরপর তো ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ভীত হয়ে ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেন। বেলা দেড়টার দিকে শুনলাম, হাসিনা পালিয়েছেন। প্রথমে বিশ্বাস করিনি। পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, ঘটনা সত্যি।
মানুষ মুক্তি খুঁজছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে সেই মুক্তি ঘটেছে। সব সময় আমি পেছনেই থাকতে চেয়েছি। কিন্তু নিয়তি আমাকে সামনে নিয়ে এসেছে।
নাহিদ ইসলাম: তথ্য ও সম্প্রচার এবং ডাক ও টেলিযোগ উপদেষ্টা; বৈষম্যবিবোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক নেতা