পরিকল্পনা কাজকে অর্ধেক এগিয়ে নেয়
ঘটনা ঘটার সারা দিন পর একটি প্রতিবেদন লেখা, আর পরদিন শুধু পত্রিকায় তা প্রকাশিত হওয়া—সাংবাদিকতা এখানে সীমাবদ্ধ নেই। প্রথম আলোতে এখন প্রতি মুহূর্তে সংবাদ, ছবি, ভিডিও অনলাইনে দিতে হয় দ্রুত। প্রতিক্রিয়া ও বিশ্লেষণ পাঠকের সামনে তুলে ধরতে হয়। দিন শেষে ছাপা পত্রিকার জন্য বাড়তি তথ্য-উপাত্ত বা বিশ্লেষণসহ নতুন করে প্রতিবেদন তৈরি করতে হয়।
এর জন্য দরকার কোনো বড় ঘটনা বা ইভেন্টকে ঘিরে আগাম পরিকল্পনা। ২০২২ সাল শুরুর আগে আমরা ধরে নিয়েছিলাম, এ বছর রাজনীতিতে চাঞ্চল্য থাকবে। শুরুটা হবে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন ঘিরে। ২০২২ সালের বার্ষিক কর্মপরিকল্পনার (এওপি) শুরুতেই ছিল নারায়ণগঞ্জ নির্বাচন। ভোটের এক সপ্তাহ আগেই ঢাকা থেকে একজন প্রতিবেদক সেখানে গিয়ে নানা দিক নিয়ে প্রতিবেদন করেছেন। ১৬ জানুয়ারি ভোটের দিনের পরিকল্পনা ছিল বিস্তৃত—অনলাইন ও ছাপা পত্রিকার জন্য। ঢাকার ছয়জন প্রতিবেদক ও আলোকচিত্রী এবং নারায়ণগঞ্জের দুজন প্রতিবেদক ও একজন আলোকচিত্রী ছিলেন সেখানে। ভোটের দিন শুধু অনলাইনে উঠেছে ৩৩টি প্রতিবেদন। পরদিন ছাপা পত্রিকায় ভোটের নানা চিত্র ও ভোটের ফল নিয়ে বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদন।
একইভাবে জুনে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন কাভার করা হয়। কুমিল্লার ভোটের দিন অনলাইনে ৩৭টি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এই দুটি ‘ইভেন্ট’ আগে থেকে জানা, তাই পরিকল্পনা করা গেছে। কিন্তু হঠাৎ করে যা ঘটে, তার জন্য দরকার তাৎক্ষণিক পরিকল্পনা।
২০২২ সালটি শুরু হয়েছিল নতুন করে করোনাভাইরাসের প্রকোপ দিয়ে। ২০২০ ও ২০২১ সাল করোনার মধ্য দিয়েই কেটেছে। প্রথম আলোও এই পরিস্থিতির বাইরে ছিল না। তবে ২০২২ সালের শুরুতে নতুন করে আমাদের সহকর্মীদের ভুগিয়েছে করোনা। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে যায় যে রিপোর্টিং টিমের একসঙ্গে ১২ জন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছিলেন। এ রকম নিজের বা পরিবারের সদস্যদের অসুস্থতা ও দুর্ঘটনার কারণে জুন পর্যন্ত রিপোর্টিং বিভাগের পুরো টিমকে একসঙ্গে পাওয়া যায়নি।
২০২২ সালটি ঘটনাবহুল। বড় ঘটনার একটি পদ্মা সেতু উদ্বোধন। প্রথম আলোতে এই উদ্বোধন ঘিরে আয়োজন ছিল বিস্তৃত ও কিছুটা অভিনব। জুন মাসজুড়ে পরিকল্পিতভাবে অনলাইন, ছাপা পত্রিকা ও ভিডিও রিপোর্টিং করা হয়। এ জন্য আগের মাস থেকে দফায় দফায় বৈঠক করে অনলাইন, ছাপা পত্রিকা, ছবি ও ভিডিও বিভাগের জন্য আলাদা আলাদা আধেয় পরিকল্পনা ও কর্মী ব্যবস্থাপনা করা হয়। কিন্তু ২৫ জুন উদ্বোধনের দিন কাভার করা নিয়ে নতুন চিন্তায় পড়তে হয়। কারণ, আগে থেকে আমাদের সহকর্মীরা গিয়ে কোথায় উঠবেন? ওই এলাকায় আবাসিক হোটেল নেই, রেস্তোরাঁ নেই। তখন সম্পাদক নির্দেশনা দিলেন, পদ্মা সেতুর দুই পারে দুটি বাড়ি ভাড়া এবং রান্নার ব্যবস্থা করতে। আমাদের প্রতিনিধিদের সহায়তায় বিশাল বাংলা বিভাগ খালি ঘর পেল, কিন্তু সেখানে কোনো আসবাব নেই। প্রশাসন বিভাগের সহায়তায় অতি দ্রুত নতুন বিছানাপত্র ও রান্নার ব্যবস্থা করা হয়। পদ্মার দুই পারের জন্য রাখা হয় আলাদা আলাদা গাড়ি। সব মিলিয়ে বড় কর্মযজ্ঞ ছিল সেটা। সেতু উদ্বোধনের দিন এবং এর আগে-পরে বিশেষ আয়োজন, ক্রোড়পত্র তো ছিলই; তার আগে জুনের শুরু থেকে প্রায় মাসব্যাপী পত্রিকায় ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে তথ্যবহুল প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, অভিমত ও সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। পদ্মা সেতুর নানামুখী প্রতিবেদন করার ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা ছিল বিশেষ প্রতিনিধি আনোয়ার হোসেনের।
সম্পাদকের তদারকিতে বার্তা ব্যবস্থাপনা বিভাগের নেতৃত্বে সমন্বিত ডেস্ক, বিশাল বাংলা, ভিডিও এবং ফটোগ্রাফি বিভাগ, আশপাশের এলাকার প্রতিনিধি ও বিজ্ঞাপন বিভাগকে নিয়ে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন ঘিরে পুরো কাজের সমন্বয়, ব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন—একটি ভালো উদাহরণ হয়ে থাকবে। বড় ঘটনাগুলো কাভার করার ক্ষেত্রেই প্রয়োজন অনুযায়ী প্রশাসন, মানবসম্পদ, তথ্যপ্রযুক্তি বা আইটি, হিসাব বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিভাগের সহায়তা নিতে হয়েছে।
এ বছর বড় ঘটনা কাভার করার ক্ষেত্রে যে অভিজ্ঞতা আমাদের হলো, আগামী বছর সেই অভিজ্ঞতায় আরও ভালোভাবে বড় ‘ইভেন্ট’ কাভার করার পরিকল্পনা করা যাবে, সেটা অনলাইন ও ছাপা পত্রিকা—দুদিকে জোর দিয়ে। পরিকল্পনা ভালো হলে কাজ অর্ধেক এগিয়ে যায়।
লেখক: হেড অব রিপোর্টিং, প্রথম আলো