কর্মীর লেখা
ক্ষোভের আগুনে হৃদয়ও পোড়ে
প্রথম আলোর ২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কর্মীদের কাছে লেখা আহ্বান করা হয়েছিল। তাঁরা লিখেছেন প্রথম আলোকে নিয়েই। কর্মীদের নির্বাচিত কিছু লেখা নিয়েই এ আয়োজন।
চারদিকেই জনকোলাহল। রাজধানী ঢাকার সব অলিগলিতেই চলছে মিছিলের আয়োজন। আর এত এত মানুষ মিশে যাচ্ছে রাজপথে গণভবনমুখী জনস্রোতে। কারও কারও হাতে সগৌরবে উড়ছে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা। আর অধিকাংশের হাতেই লাঠিসোঁটা। বেশির ভাগ ছাত্র-জনতার কণ্ঠেই বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে স্লোগান। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশিবার উচ্চারিত হচ্ছে, ‘হাসিনা পালাইছে।’
ক্যালেন্ডারের পাতায় সেদিন ৫ আগস্ট। আর প্রকৃতিতে তখন সকাল হারানো দুপুরের আভাস। এদিকে অন্দরে প্রথম আলোর ১২তলায় (নিউজরুম) সরগরম অবস্থা। নানা তথ্য আসছে। এই উত্তেজনার মধ্যেও সেখানে বসে বাইরের জনকোলাহল টের পাওয়া যাচ্ছিল। হঠাৎ চোখ গেল টিভির পর্দায়।
নিউজ রুম ছেড়ে বাড়ির পথে পা বাড়াতেই প্রগতি ভবনের নিচে কারওয়ান বাজারে চোখ আটকে গেল। এলাকাটিতে সচরাচর এমন দৃশ্য দেখা যায় না।
গণভবন থেকে প্রচারিত এমন অপেশাদার লাইভ প্রোগ্রাম বোধ হয় আগে কোনো দিন দেশের জনগণ দেখেনি। অস্থির ক্যামেরার চোখে ধরা পড়ছে মানুষের উচ্ছ্বাস, আনন্দ আর ক্ষিপ্র উন্মাদনা। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনটিতে ঢুকে পড়েছেন তাঁরা। সেখানে মানুষ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরার গতি-নড়াচড়াও যেন বাড়ছিল বহুগুণে। টিভির পর্দায় এমন দৃশ্যের সরাসরি সম্প্রচার কেউ দেখবে বলে ভেবেছিল কি?
এরই মধ্যে বিশ্বব্যাপী প্রচার হয়ে গেছে, পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়েছেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
নিউজ রুমে ঘটনাটির আকস্মিকতা নিয়ে ভাবার কিংবা আলোচনার জন্য খুব বেশি সময় পাওয়া গেল না। মুহূর্তেই তুমুল ব্যস্ততা ঘিরে ধরল সবাইকে। দেশের এই পরিস্থিতিতে সঠিক তথ্য জানতে ও জানানোর এই ব্যস্ততা কমবে বলে মনে হয় না।
তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে বাইরে কী হচ্ছে, তা কেবল আন্দাজই করা যাচ্ছিল। কিন্তু অনুভব আর উপলব্ধির বিষয়টি টের পাওয়া গেল বাইরে বের হওয়ার পরই। নিউজ রুম ছেড়ে বাড়ির পথে পা বাড়াতেই প্রগতি ভবনের নিচে কারওয়ান বাজারে চোখ আটকে গেল।
এলাকাটিতে সচরাচর এমন দৃশ্য দেখা যায় না। ফুটপাতে নেই ব্যবসায়ীদের চিরায়ত ভিড়, ক্রেতা–বিক্রেতার চেনা হাঁক–ডাক শোনা যাচ্ছে না, কুলিদের ব্যস্ততাও নজরে পড়ছে না। অনাকাঙ্ক্ষিত নীরবতায় যেন আতঙ্ক নেমে এসেছে শহরের ব্যস্ততম বাজারটিতে। কুমড়োপট্টির দিকটায় দৌড়াদৌড়ি করছিল কয়েকজন। অদূরেই দাউ দাউ করে জ্বলছিল একটি মাইক্রোবাস। এর কালো ধোঁয়ায় কারওয়ান বাজারের আকাশ ছেয়ে গেল মুহূর্তেই।
সড়কের জনস্রোতে মিশে গিয়ে মন ভালো হয়ে গেল। এত এত আনন্দ সবার চোখে-মুখে যে মন ভার করে রাখার উপায় নেই।
হঠাৎ একটি ব্যক্তির সঙ্গে ধাক্কা লাগতেই মনোযোগ সরে গেল। তিনিসহ আরও কয়েকজন মিলে মসজিদের পাশের একটি রেস্তোরাঁর দৌড়ে প্রবেশ করল। মুহূর্তেই দ্বিতীয় তলায় পৌঁছে গেল তাঁরা। এরপর সেখান থেকে কাচ ভাঙার আওয়াজ আসছিল। মাটিতে ঝরে পড়ছিল সদ্য ভাঙা কাচের দেয়াল। পাশেই কেউ একজন বিড়বিড় করে বলছিলেন, ‘জানি না, এই ক্ষোভ কিসের জন্য আর কার ওপর।’
সড়কের জনস্রোতে মিশে গিয়ে মন ভালো হয়ে গেল। এত এত আনন্দ সবার চোখে-মুখে যে মন ভার করে রাখার উপায় নেই। তবে মন ভেঙে গেল এটিএন নিউজের ভবনটি দেখে। রীতিমতো লুটতরাজ চলছে। কলাপসিবল গেট বন্ধ থাকা সত্ত্বেও দেয়াল বেয়ে দ্বিতীয় তলায় উঠছিল অনেকেই। কাচের দেয়ালের বাধা ভেঙে অনেকেই ততক্ষণে পৌঁছে গেছেন সংবাদমাধ্যমটির কার্যালয়ে। তাণ্ডব চলছে ফ্লোরে ফ্লোরে। এদের মধ্যে অনেকেই হাতের কাছে যা যা পেয়েছেন, ইচ্ছেমতো সেগুলো নিয়ে আবার নিচে নেমেছেন। একজন তো আস্ত একটা এসি হাতে নামলেন! আরেকজনের হাতে দেখলাম মস্ত টেলিভিশন। অন্যজনের শখ হয়েছে একটি চেয়ার নিয়ে বাড়ি ফিরবেন। এরপর আরাম করে বসবেন এতে।
ওর চোখে-মুখে ভয়ের কোনো ছাপ নেই, নেই ক্ষোভের আগুনও। আছে শুধু মুক্তির অনাবিল আনন্দ। শিশুটির এই উচ্ছলতা দেখে অদূরে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছিলেন মা।
‘হায়রে বাঙালি! চেয়ারের লোভই সামলাতে পারে না এরা!’ পাশ থেকে তাচ্ছিল্যের সুরে কথাটি বললেন একজন তরুণ। তবে আরেক তরুণকে দেখলাম কয়েকজনকে ডেকে ডেকে লুটপাট না করার অনুরোধ করছেন। কিন্তু ওই দিন কেউ কী কারও বারণ শুনেছেন?
এসব দৃশ্যের সাক্ষী হওয়াটা ঠিক হচ্ছে না। অনেককেই দেখলাম, দেয়ালে দেয়ালে লিখছে ‘স্বাধীন’। আচ্ছা, যারা এসব বিচ্ছিরি দৃশ্যের কারিগর, তাঁরা কী জানেন, স্বাধীন শব্দটির অন্তর্গত অর্থ কিংবা গভীরতার মাত্রা?
তবে আমার কাছে স্বাধীন মনে হয়েছিল বিজয় সরণির মোড়ে এক শিশুকে দেখে। বয়স আর কত হবে, বড়জোর ৪ কিংবা সাড়ে ৪। মায়ের কোল ছেড়ে সে-ও নেমে এসেছিল অভ্যুত্থানের রাজপথে। ছোট্ট হাতে একটি কাঠের লাঠি নাড়তে নাড়তে দুর্দান্ত প্রতাপে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। ওর চোখে-মুখে ভয়ের কোনো ছাপ নেই, নেই ক্ষোভের আগুনও। আছে শুধু মুক্তির অনাবিল আনন্দ। শিশুটির এই উচ্ছলতা দেখে অদূরে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছিলেন মা।
আল-আমিন, সহসম্পাদক, বিশাল বাংলা বিভাগ