আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্বদেরও মনোযোগ আকর্ষণ করেছে প্রথম আলো। প্রথম আলোর জন্য তাঁরা লিখেছেন বিশেষ শীর্ষ রচনা, দিয়েছেন একান্ত সাক্ষাৎকার। সেসবের কিছু নির্বাচিত একটি অংশ রইল এখানে।
মতিউর রহমান: ১৯৭৩ সালে আপনাদের সামরিক শাখা শান্তিবাহিনী গঠিত হলো। তখনকার অবস্থায় এটা কি খুব দ্রুত গঠিত হয়ে গেল না?
সন্তু লারমা: ১৯৭২ সালের পুরোটাই আমরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে অধিকার আদায়ের চেষ্টা করেছি। শুধু আমাদের জনসংহতি সমিতির নেতারা নন, আরও অনেকেই চেষ্টা করেছেন। মং সার্কল চিফ মংপ্রু সাইন দাবিদাওয়া নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়েছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগ করতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় রামগড় এলাকার সেক্টর কমান্ডারও ছিলেন। কিন্তু প্রতিবারই তাঁদের সবাইকে উপেক্ষিত হতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত যখন সংবিধান প্রণয়ন করা হলো, তখন দেখা গেল আমাদের দাবিগুলো মানা হয়নি। আমরা বুঝলাম, নিয়মতান্ত্রিকভাবে আন্দোলন করে আমরা আর কিছু পাব না; এভাবে আর কিছু হতে পারে না। পাহাড়িদের ওপর অত্যাচার-উত্পীড়নের মাত্রা উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে।
১৯৭৩ সালের ৭ জানুয়ারি আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, সশস্ত্র সংগ্রাম করতে হবে। তার পরও আমরা সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করিনি। এ প্রস্তুতি কিন্তু আগেও আমাদের ছিল। যখন মুক্তিযুদ্ধ চলছে, তখনো আমরা অস্ত্র সংগ্রহ করেছি গোপনে। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন আত্মসমর্পণ করল, তখনো আমরা অস্ত্র জোগাড় করেছি। এ ধরনের একটা মানসিক প্রস্তুতি ছিল যে আমাদের তো মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি, ফলে এরপর তারা ক্ষমতায় এলেও আমাদের অধিকার দেবে না। কিন্তু তার পরও আমরা চেষ্টা করেছি। ’৭৩ সালের নির্বাচনে আমরা অংশ নিয়েছি এবং দুটি আসনে জিতেছি। একটিতে মানবেন্দ্র লারমা, অন্যটিতে সাইথোয়াই রোয়াজা। ১৯৭৫ সালে আমরা বাকশালেও যোগ দিয়েছি। বঙ্গবন্ধু ওই সময়ে মানবেন্দ্র লারমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছিলেন, তোমরা বাকশালে যোগ দাও, আমি পার্বত্য অঞ্চলের একটা ব্যবস্থা অবশ্যই করব। তার অল্পকাল পরে তো তিনিই নিহত হলেন।
মতিউর রহমান: সত্যিকার অর্থে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হলো কোন সময়ে?
সন্তু লারমা: ১৯৭৬ সালে। আমাদের প্রথম আক্রমণ ছিল বিলাইছড়িতে। আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের একটা বড় ক্যাম্প ছিল সেখানে।
মতিউর রহমান: আমরা দেখতে পাচ্ছি, ১৯৭৫ সালের ২৬ অক্টোবর আপনি গ্রেপ্তার হলেন।
সন্তু লারমা: বাড়ি থেকে আমি গোপন আস্তানায় ফিরে যাচ্ছিলাম, গোপনে। আস্তানা বলতে একটা গ্রামের মধ্য দিয়ে ব্যারাকে ফিরছি। মহালছড়িতে পূর্ব দিকে একটা গভীর জঙ্গল ছিল, ওখানে আমাদের আস্তানা। ওই পথ ধরে আমি শর্টকাটে যাচ্ছিলাম। তখন পুলিশের মুখোমুখি হয়ে ধরা পড়ে যাই।
মতিউর রহমান: আপনি জেলে থাকার সময় সশস্ত্র সংগ্রামের কী অবস্থা ছিল?
সন্তু লারমা: তখনো প্রস্তুতি চলেছে, কিন্তু ১৯৭৬ সালে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়নি। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর তো আমার চোখের সামনে দেখা। তখন আমি ঢাকায় পুলিশ হেফাজতে। আমার জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। গ্রেপ্তারের পর পুলিশের আচরণ ভালো ছিল না। যত দিন গেছে, কথা বের করার জন্য অত্যাচার ততই বেড়েছে। আমাকে আকাশপথে চট্টগ্রামে আনার কথা ছিল। কেন হয়নি, জানি না। আমাকে আনা হলো রাঙামাটিতে। রাঙামাটি থেকে চট্টগ্রামে নিয়ে গিয়ে আবার শুরু হলো জিজ্ঞাসাবাদ। তবে ঢাকায় বেশি নির্যাতন করা হয়েছিল। এর মধ্যেই ভেতর থেকে আমি নানাভাবে যোগাযোগ রেখেছি আমাদের নেতৃত্বের সঙ্গে।
মতিউর রহমান: ১৯৮০ সালে আপনি ছাড়া পেলেন। আপনাকে ছাড়ল কেন? তখন তো সেনাশাসন চলছে।
সন্তু লারমা: জানুয়ারিতে আমাকে ছাড়া হলো। ওই যে বললাম, যোগাযোগ ছিল। তখন জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় ছিলেন। মশিউর রহমান জাদু মিয়া ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। জিজ্ঞাসাবাদের সময় আমি আমার মতামত দিয়েছি। কীভাবে সমস্যার উদ্ভব হয়েছে, কীভাবে এর সমাধান করা যায়—সেসব। আমার নিঃশর্ত মুক্তি হয়েছিল। তারা আশা করেছিল, আমাকে ছেড়ে দিলে সংলাপের একটা পথ উন্মুক্ত হবে। কার্যত তা-ই হয়েছিল। একটা সংলাপ উন্মুক্ত হয়েছিল। ওই সময় মেজর জেনারেল মঞ্জুর বেঁচে ছিলেন। তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয়টা দেখার জন্য। তখন একটা চেষ্টা হয়েছিল। ওই সময় সশস্ত্র আন্দোলনও চলছে। আমাদের সে দায়িত্বের লিখিত অনুলিপি দেওয়া হয়নি। ফলে সংলাপটা করা যায়নি। উপেন্দ্রলাল চাকমা এমপি সংলাপ শুরু করার ভূমিকায় ছিলেন। শেষ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক সংলাপ হতে পারেনি।
প্রথম আলো ঈদসংখ্যা, ২০০৫ (সংক্ষেপিত)