‘দ্রুত আসেন, লাইভ করতে হবে তো’
‘রাসেল, কোথায়, বাসায় চলে গেছেন নাকি? ইন্টারনেট আসছে, দ্রুত আসেন, নিউজ লাইভ করতে হবে তো।’ প্রথম আলো অনলাইন প্রধান শওকত হোসেন ভাই ফোন করে তাড়া দিলেন আমাকে।
৫ আগস্ট পরিস্থিতি থমথমে। সকাল সকাল অফিসে আসার পর চলছিল লাইভ নিউজের প্রস্তুতি। বেলা ১১টার দিকে তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে ‘ইন্টারনেট টোটাল শাটডাউন’-এর কথা জানানো হয়। অনলাইনে সংবাদসেবার সব কাজ তো ইন্টারনেট ছাড়া অচল। আমরা নিচে নেমে গেলাম। এমন সময় শওকত হোসেন ভাইয়ের সেই ফোন। দ্রুত অফিসের নির্দিষ্ট ফ্লোরে ফিরেই কাজ শুরু মানে লাইভ করার জোর প্রস্তুতি শুরু। অনেক সহকর্মী সেদিন বাসায় চলে গেলেও ইন্টারনেট সচল হওয়ায় আবার অফিসে এসে সংবাদের কাজ শুরু করেন। আর ওই কারফিউয়ে এবং ইন্টারনেট বন্ধের সময়ও আমরা ছাপা পত্রিকার কাজ চালিয়ে গেছি।
সেদিন (৫ আগস্ট) আওয়ামী লীগের সভাপতি ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে চলে যাওয়া; গণভবন, সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে (এখন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়) সাধারণ মানুষের ঢুকে পড়াসহ রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় আগুন ও হামলার খবর আমরা পাঠকের কাছে লাইভ ব্লগের (লাইভ নিউজ) মাধ্যমে যথাযথভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করে গেছি।
জুলাই ও আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উত্তাল সময়ে পাঠককে হালনাগাদ সব তথ্য সঠিকভাবে জানানোর জন্য লাইভ ব্লগে সরাসরি সংবাদ পরিবেশন করতাম। গত ৫ আগস্ট সকালের দিকে ইন্টারনেট বন্ধের পর বাসায় যাওয়ার প্রস্তুতির সময়ে এল ‘নতুন খবর’। জানতে পারলাম, পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যাচ্ছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আকর্ষণের অন্যতম কারণ হলো ছবি, পোস্টে ও ভিডিওতে দ্রুত সাড়া (রিঅ্যাকশন) পাওয়া যায়। লাইক, কমেন্টস ও শেয়ারের কারণেই মানুষের আগ্রহ থাকে বেশি। মানুষ ডুবে থাকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। চলমান গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ চটজলদি পাঠকের কাছে তুলে ধরতেই প্রথম আলো বিভিন্ন সময় নানা ঘটনার লাইভ করেছে। তবে এবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় কোটা–বিতর্ক থেকে শুরু করে সরকার পতনের এক দফা পর্যন্ত এবং অন্তর্বর্তী সরকার গঠনপ্রক্রিয়া পর্যন্ত আমরা টানা বেশ কিছুদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত লাইভ করেছি। পাঠকের সাড়াও পেয়েছি ব্যাপক। আগস্টে প্রথম আলো অনলাইনের সব সেকশনের নিউজ ও লাইভ মিলিয়ে পেজভিউ ছিল ৩৫ কোটির বেশি। বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় ২০০ দেশ থেকে লাইভে কখনো একসঙ্গে ৫০ হাজারের মতো পাঠক পড়ছিল। দেশের বাইরে থেকে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, আয়ারল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে পাঠকের সাড়া ভালো ছিল।
লাইভের মধ্য ‘ইন্টারনেট টোটাল শাটডাউনের নির্দেশ’—ভিউ ২০ লাখ ১ হাজার ৭৯৫’ (৫ আগস্ট), ‘খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে’—ভিউ ১৭ লাখ ৬৫ হাজার ৮৮৯’ (৬ আগস্ট), ‘ছাত্র–জনতার অভ৵ত্থান ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’, এ স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে: ড. ইউনূস’— ৮ লাখ ৪১ হাজার ৮৯২ (৮ আগস্ট), ‘পাসপোর্ট পেলেন খালেদা জিয়া’—৫ লাখ ৫৬ হাজার ১৩০ (৬ আগস্ট), ‘দিল্লিতে শেখ হাসিনা, যাবেন লন্ডনে: ইন্ডিয়া টুডে’—২ লাখ ৪ হাজার (৫ আগস্ট)।
লাইভে ৪ ও ৫ আগস্ট ছিল সবচেয়ে কঠিন সময়। কঠিন ছিল যাচাই-বাছাই করে সংবাদ প্রচার। ‘দেশ ছাড়লেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা’, ‘ইন্টারনেট টোটাল শাটডাউনের নির্দেশ’, ‘গণভবনে ঢুকে পড়েছেন অসংখ্য মানুষ’, ‘প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন, হবে অন্তর্বর্তী সরকার: সেনাপ্রধান’, ‘দিল্লিতে শেখ হাসিনা, যাবেন লন্ডনে: ইন্ডিয়া টুডে’, ‘মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশ, বন্ধ ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপও, সচল ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট’, ‘রাত ৮টায় জাতীয় সরকারের রূপরেখা ঘোষণা করবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’, ‘নতুন সরকারের শপথ ৮ আগস্ট’—এমন খবর প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে পাঠক হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন। মন্তব্যও করেছেন।
এখন মনে হতে পারে ‘লাইভ নিউজ’, ‘লাইভ সংবাদ’, ‘সরাসরি খবর’ আসলে কি? কোনো ঘটনার ঘটার সঙ্গে সঙ্গে সব সঠিক তথ্য পাঠকের কাছে বা সামনে তাৎক্ষণিক তুলে ধরা।
লাইভে বা সরাসরি সংবাদ প্রচারের সময় রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা নানা তথ্য হালনাগাদ করে ঢাকা অফিসে পাঠাচ্ছিলেন। আমরা নিজেদের প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আরও যাচাই–বাছাইয়ের পর পাঠকের সামনে তুলে ধরছিলাম।
আসলে এই পুরো লাইভ ব্লগ বা সরাসরি সংবাদ প্রচারে প্রথম আলোর সব কর্মীর সহায়তা ছিল। ওই যে সবাই মিলে ‘আমরা’ শব্দটির মতো।
*রাশেদুল আলম রাসেল : সহকারী বার্তা সম্পাদক, প্রথম আলো