অনুষ্ঠানে হাজারো পাঠক। একের পর এক প্রশ্ন। কখনো একসঙ্গে সাত–আটজন প্রশ্ন করতে চান। কাকে রেখে কাকে সুযোগ দেওয়া হবে? কেউবা আবার প্রশ্ন করতে দাঁড়িয়ে বললেন প্রত্যাশার কথা। প্রশ্নে কারও ছিল অভিযোগ, কেউবা করলেন অনুযোগ। একে একে প্রিয় পাঠকদের সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান। প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকেরাও এ সময় পাঠকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।
পাঠকদের প্রশ্নের জবাবে সম্পাদক মতিউর রহমান বলেছেন, ‘সত্য প্রকাশ করাই প্রথম আলোর উদ্দেশ্য। সত্য প্রকাশের কারণেই পাঠকেরা প্রথম আলোর সঙ্গে আছেন। সততার সঙ্গে সত্য প্রকাশ করি আমরা।’ প্রথম আলোকে আরও এগিয়ে নিতে এবং স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিবেশকে জোরদার করতে পাঠকদের সহযোগিতা চেয়েছেন তিনি।
দেশের শীর্ষ জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো ২৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্যাপন করেছে পাঠকদের সঙ্গে। আজ শুক্রবার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়োজিত ‘পাঠক উৎসব’–এর একটি পর্বে পাঠকের মুখোমুখি হন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানসহ পত্রিকাটির জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকেরা। ‘সত্যে তথ্যে ২৪’—আহ্বানে এবার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করছে প্রথম আলো।
আজ বিকেলে পাঠকের মুখোমুখি পর্বের শুরুতেই দর্শকসারিতে বসা অভিনেত্রী দিলারা জামান মঞ্চে উপস্থিত প্রথম আলো সম্পাদকসহ জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমার তো বয়স ৮০, নুয়ে গেছি। আর এই মঞ্চে যাঁরা, তাঁরা ২৪ বছরের দুরন্ত যৌবনে ছুটে চলা দল, সাধ্য কি প্রশ্ন করে কুপোকাত করা। সুতরাং দূর থেকেই স্যালুট!’
প্রশ্ন করতে গিয়ে প্রথম আলোর সম্পাদকের কাছে নিজের একটি দাবির কথা তুলে ধরেন ঢাকা কলেজের ছাত্র তানজিবুল আবিদ। তাঁর বাড়ি পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীতে। এই তরুণের অনুযোগ, বন্যা হলেই কেবল খবরের শিরোনামে আসে রাঙ্গাবালী। কিন্তু সেখানে অনেক ইতিবাচক কাজ যেমন হয়, তেমনি অনেক অনিয়মও হচ্ছে। তাঁর দাবি, রাঙ্গাবালী নতুন উপজেলা হওয়ায় ইতিবাচক কাজের চেয়ে অনিয়ম বেশি হচ্ছে। বিশেষ করে শিক্ষা খাতে ও অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে। এ বিষয়ে কোনো প্রতিবেদন করা যায় কি না, সে প্রস্তাব দেন তিনি।
এ প্রশ্নের জবাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, ‘আমরা খোঁজ রাখব, দেখব, যেন সত্যিকার অর্থে সত্য প্রকাশ করতে পারি।’
আরেক পাঠকের প্রশ্নের জবাবে মতিউর রহমান বলেন, ‘আমরা স্বাধীন সংবাদপত্র করতে চেয়েছি। একই সঙ্গে আত্মনির্ভর, নিজের আয়ে চলব—এমন একটি সংবাদপত্র করতে চেয়েছি। স্বাধীন থাকা এবং নিজের আয়ে চলা—এটি বাংলাদেশে অত্যন্ত কঠিন। কারণ, আমাদের দেশের সরকারগুলো স্বাধীন সংবাদপত্র মেনে নিতে পারে না, নেয় না, নিতে চায় না।’
সম্পাদক বলেন, প্রথম আলোকে টিকে থাকার জন্য ব্যবসায়িক দিকও বিবেচনা করতে হয়। আর শুরু থেকেই লক্ষ্য ছিল প্রথম আলো একটি স্বাবলম্বী খবরের কাগজ হবে, নিজের আয়ে চলবে। বলতে দ্বিধা নেই, প্রথম আলো একটি সৎ, স্বাধীন ও দলনিরপেক্ষ সংবাদপত্র। প্রথম আলোর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সত্য প্রকাশ করা। দেশের মানুষের মঙ্গলের জন্য, কল্যাণের জন্য কাজ করে যাওয়া। তিনি বলেন, ‘আমরা সততার সঙ্গে সত্য প্রকাশ করি। এটাই আমাদের শক্তি। আর সততার সঙ্গে সত্য প্রকাশ করি বলেই আপনারা (পাঠক) আমাদের সঙ্গে আছেন। আর আপনারা আছেন বলেই আজকে পর্যন্ত প্রথম আলো টিকে আছে এবং আরও সামনে এগিয়ে যাবে।’
অনুষ্ঠানে সঞ্চালকের ভূমিকায় থাকা প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ পাঠকদের উদ্দেশে বলেন, ‘সঠিক তথ্য দেওয়াই আমাদের কাজ। সব রকম সতর্কতা নেওয়ার পরও এই চলার পথে কখনো কখনো ভুলত্রুটি হয়। ভুল হলে আমরা সংশোধন করি। আপনারা আমাদের সঙ্গে থাকেন। কারণ আমাদের ইচ্ছাটা খাঁটি।’
প্রথম আলোয় ডাকনাম প্রকাশ না করা–সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক বলেন, সাধারণত সার্টিফিকেটে (সনদ) যে নামটি আছে, সেই নামটিই ব্যবহার করে প্রথম আলো।
পত্রিকায় মলাট বিজ্ঞাপন প্রকাশের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রথম আলোর কনসালটিং এডিটর কামাল আহমেদ বলেন, বিশ্বের নামকরা পত্রিকাগুলোও টিকে থাকার জন্য এ কাজ করে থাকে। পাঠক বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ জানাতে পারেন, সেই অধিকার রয়েছে। কিন্তু পত্রিকাকে ব্যবসা করে টিকে থাকতে হয়।
রাজধানীর সরকারি কলেজ অব অ্যাপ্লায়েড হিউম্যান সায়েন্সের ছাত্রী মাহবুবা জানতে চান, তাঁরা যখন ছোট ছিলেন, তখন দেখা যেত সাংবাদিকতা স্বপ্নময় পেশা ছিল। এখনো কারও কারও আছে। কিন্তু এখন যখন পেশা বেছে নেওয়ার পর্যায়ে এসেছেন, তখন দেখা যাচ্ছে, যাঁরা সাংবাদিকতায় পড়তে চেয়েছেন এবং সাংবাদিকতায় পড়েছেন, তাঁরাও সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে ভয় পাচ্ছেন বা সাহস পাচ্ছেন না। এর কারণ কী?
এ প্রশ্নের জবাবে প্রথম আলোর ফিচার সম্পাদক সুমনা শারমীন বলেন, সাংবাদিকতায় পড়ে বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরির পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে কাজ পাওয়ার সুযোগ আছে। তবে সাংবাদিকতায় পড়ে একেবারেই সাংবাদিকতায় আসছেন না, তা নয়। সাংবাদিকতা পড়ে আসা শিক্ষার্থীরা প্রথম আলোর বিভিন্ন বিভাগে সেরা সাংবাদিকদের মধ্যে আছেন। তবে সব প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থা সেই রকম থাকে না। প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থার জায়গাটি বাড়লে এই পেশার প্রতি আগ্রহ আরও বাড়ত।
অনুষ্ঠানে রাজধানীর মনিপুর উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া হাসান মুহিত নামের এক কিশোর জানতে চাইল, প্রথম আলোর যাঁরা নতুন পাঠক বা যাঁরা নতুন করে যুক্ত হচ্ছেন, তাঁদের জন্য কী ধরনের বার্তা দিতে চায় পত্রিকাটি? এ প্রশ্নে প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন শওকত হোসেন বলেন, সবচেয়ে বড় বার্তা হলো সঠিক সংবাদটি দেওয়া। আর শিক্ষা, প্রযুক্তি, চাকরিসহ যেসব খবর নতুন পাঠকেরা জানতে চান, সেগুলোও গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করা হয়। তাঁদের চাওয়া অনুযায়ী খবর প্রকাশের চেষ্টা করা হয় এবং সামনে এ চেষ্টা আরও জোরদার করা হবে।
অনুষ্ঠানে প্রথম আলোর ক্রীড়া বিভাগের (অনলাইন) প্রধান উৎপল শুভ্রর প্রতি এক পাঠকের প্রশ্ন ছিল ক্রিকেট বোর্ড নিয়ে। তিনি বোর্ডের কার্যক্রমে অসন্তুষ্টির কথা জানান। এর জবাবে উৎপল শুভ্র বলেন, ক্রিকেট বোর্ডের কার্যক্রম নিয়ে সামনে বড় পরিসরে প্রতিবেদন করার পরিকল্পনা রয়েছে প্রথম আলোর।
অনুষ্ঠানে সম্পাদকের সঙ্গে মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন প্রথম আলোর হেড অব ইংলিশ ওয়েব আয়েশা কবির, প্রথম আলোর উপসম্পাদক লাজ্জাত এনাব মহছি এবং এ কে এম জাকারিয়া, হেড অব রিপোর্টিং টিপু সুলতান ও উপবার্তা সম্পাদক রাজীব হাসান।
অনুষ্ঠানের শেষ দিকে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, ‘আপনারা (পাঠকেরা) আমাদের বন্ধু, আমাদের সহযোগী। আসুন, আমরা সবাই মিলে সত্যিকার অর্থে ভালো সাংবাদিকতার পরিবেশ ফিরিয়ে আনি, স্বাধীন সাংবাদিকতাকে জোরদার করি, শক্তিশালী করি। আমরা দেশকে ভালোবাসি। প্রথম আলোর লক্ষ্য, আমরা সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জয় দেখতে চাই।’