আমি নিজেও তো মা
কিশোর ছেলে আমিনুল ইসলামকে (আমিন) ঘুমে রেখে ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে বের হয়েছিলেন ওবায়দুল ইসলাম। দিনটি ছিল ২১ জুলাই। যাত্রাবাড়ী এলাকায় ওই দিন কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ চলছিল। শনির আখড়ায় যাওয়ার পথে রিকশার যাত্রীরা আগেই নেমে গেলে কাজলার অনাবিল হাসপাতালের সামনে যান তিনি। একটু পর দুই ব্যক্তি এসে বললেন, এক কিশোরের গুলি লেগেছে, হাসপাতালে নিতে হবে। ওবায়দুল দেখতে পান, সেই কিশোর আর কেউ নয়, তাঁর ছেলে আমিনুল ইসলাম (আমিন)। মুঠোফোনে ওবায়দুল নিজেই ছেলের মা সেলিনা বেগমকে জানিয়েছিলেন, ‘ছেলে মরে গেছে’। আমিনের বুকের বাঁ পাশে গুলি লেগে পিঠ দিয়ে বের হয়ে গিয়েছিল।
আগস্ট মাসের শুরুতে যাত্রাবাড়ীর দক্ষিণ দনিয়ায় এক কক্ষের ছোট ঘরটিতে বসে বাবা ওবায়দুল ইসলাম সেদিনের ঘটনা বলতে গিয়ে কেবলই ছেলের স্মৃতির কাছে ফিরে যাচ্ছিলেন। তাঁর এই ছেলেই হতে চেয়েছিল ফুটবলার। ফুটবল খেলে এলাকা থেকে একটি ক্রেস্টও পেয়েছিল। বিছানায় রাখা ছেলের ক্রেস্টটির দিকেই বারবার অদ্ভুত চোখে তাকাচ্ছিলেন তিনি। সেই চোখে ছিল কান্না, ক্রোধ আর আক্ষেপ।
আমিনুলের মা সেলিনা বেগম ছেলে মারা যাওয়ার পর মুঠোফোনে তোলা ছেলের কয়েকটি ছবি প্রিন্ট করে এনেছেন। বললেন, ‘ছেলের মুখ তো আর দেখতে পারুম না। তাই ছবিগুলা ওয়াশ করে আনছি। কালা গেঞ্জি পরা যেকোনো ছেলেরে দেখলে মনে হয়, এ আমার ছেলে। আমার যে কী জ্বালা, তা খালি আমি বুঝি।’
জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের ঘটনায় নিহতদের নিয়ে, তাঁদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে এবং আহতদের নিয়ে এ পর্যন্ত ২০টির বেশি প্রতিবেদন করেছি (বেশির ভাগই নিহতদের পরিবার ধরে)। প্রতিবেদন করতে গিয়ে নানা ধরনের অভিজ্ঞতা হয়। কিন্তু সেদিন অফিসে ফেরার পথে বাবা কীভাবে ছেলের লাশ রিকশায় তুলছেন, সে দৃশ্যই যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম।
আগস্ট মাসের শেষের দিকে গেন্ডারিয়ার সাধনা ঔষধালয়ের গলির বাসায় বসে কথা হয় শাহারিয়ার খান আনাসের মা সানজিদা খানের সঙ্গে। ৫ আগস্ট চানখাঁরপুলে গুলিতে মারা গেছে ১৬ বছর ৯ মাস বয়সী আনাস। আন্দোলনে যাওয়ার আগে আনাস তার মায়ের জন্য একটি চিঠি লিখে গিয়েছিল। মা চোখের পানি ফেলতে ফেলতে চিঠিটি পড়লেন। জানালেন, আনাসের বাবার সঙ্গে অটোরিকশায় বসে কোলে করে মিটফোর্ড হাসপাতাল থেকে ছেলের রক্তাক্ত লাশ নিয়ে বাসায় ফিরেছিলেন। আনাসের বুকের বাঁ পাশে গুলি লেগেছিল।
সন্তানহারা মা–বাবা যখন স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসেছেন, আলগোছে ছেলের পড়ার টেবিলের বই–খাতা, গিটার বা অন্য কিছু দেখাচ্ছেন, তখন মনের অজান্তেই চোখের সামনে নিজের দুই মেয়ের চেহারা ভেসে উঠেছে। আনাস বা সন্তান হারানো অন্য মায়ের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করে আতঙ্কে শিউরে উঠেছি বহুবার। এমনও হয়েছে যে কোনো কোনো মা ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছেন। মনে মনে ভেবেছি আমিও তো মা। আর সব মায়ের কান্না আসলে একই রকম।
নিহতদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলার পর অফিসে এসে প্রতিবেদন জমা দিয়ে বাড়ি ফিরে মেয়েদের দেখে মনে শান্তি লেগেছে, একই সঙ্গে সন্তানহারা মায়েদের চেহারা মনে হয়েছে। আহা, মায়েদের সেকি কষ্ট!
বাসায় আমার ঘুম একটা ঠাট্টার বিষয়। কারণ, বিছানায় যাওয়ার আগে থেকেই নাকি আমি ঘুমাতে থাকি। সেই আমার চোখ থেকে কদিন ঘুম উধাও হয়ে গিয়েছিল। আবার ঘুম এলেও স্বপ্নে কেবল গুলি আর মৃতদেহ দেখি। ঘুম ভেঙে গেলে ভাবনায় আসে, ওই মা বা বাবা রাতে কি আর কখনো ঘুমাতে পারবেন?
অক্টোবরের শুরুতে যাত্রাবাড়ীতে গিয়েছিলাম ৫ আগস্ট গুলিতে মারা যাওয়া শাহাদাত হোসেনের বাসায়। মৃত্যুর সময় তার বয়স ১৪ বছরও হয়নি। শাহাদাতের মা শামসুন নাহার পুরো সময় প্রায় কোনো কথাই বললেন না। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় কেবল নিজে থেকেই বললেন, ‘জানেন, আমার ছেলেটা কী যে সুন্দর ছিল। পোস্টমর্টেমের সময় আমার এই সুন্দর ছেলের শরীরটাই কাটাকাটি করছে। আহা, না জানি আমার ছেলেটা তখন কত কষ্ট পেয়েছে।’
মনে মনে ভাবলাম, একেই বলে মা। গুলিতে ছেলে মারা গেছে তা জানার পরও এই মা ভাবছেন, মৃত শরীর কাটাকাটির সময়ও ছেলে ব্যথা পেয়েছে।
* মানসুরা হোসাইন: বিশেষ প্রতিবেদক, প্রথম আলো