ভাইয়ের বুকে রক্ত কেন
আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, জুলাইয়ের স্মৃতিচারণা করলে প্রথমে কী মনে পড়ে? আমি বলব, মৃত্যু, রক্ত, ভয়, হতাশা, বৃষ্টি আর এক আনারসওয়ালার কাহিনি।
ফেসবুকে কোনো কিছু দেখা এক ব্যাপার আর সামনাসামনি আরেক বিষয়। ১৬ জুলাই আমরা প্রথম ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের সামনে দাঁড়াই, রাস্তা ব্লক করি। সেদিন তেমন কোনো আক্রমণ হয়নি আমাদের ওপর। তবে বিকেলে যখন বাসায় ফিরছিলাম, পথে সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে যাই। হঠাৎ দেখি, সামনে ধারালো অস্ত্রধারী কয়েকজন লোক আইডি কার্ড পরা নিরস্ত্র এক ছাত্রকে রাস্তায় ফেলে মুখের ওপর পা দিয়ে জোরে জোরে লাথি মারছে। কয়েক দিন ধরে যে নৃশংসতা ফেসবুকের টাইমলাইনে দেখে আসছিলাম, তার আভাস সামনাসামনি সেদিন প্রথম পেলাম।
বাসায় ফিরেই আবু সাঈদের কথা জানতে পারি, জানতে পারি দেশজুড়ে আরও অনেক জায়গায় ছাত্রদের ওপর হামলা হয়েছে। কিন্তু বরাবরের মতোই গণমাধ্যমগুলোতে সেভাবে বিষয়টি আসছে না। সব যেন ‘বিটিভি’। লেখক ও গবেষক হিসেবে আমি ‘ফোকলোর এক্সপেডিশন বাংলাদেশ’ নামের সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। নিরুপায় হয়ে সেখানে সহকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করছিলাম, কী করা যায়? এরপর সবাই মিলে ঠিক করলাম, আমাদের যেহেতু দেশে-বিদেশে অসংখ্য পাঠক আছে, আমরাই দেশের খবর প্রচার করব। তা–ই হলো। দিনে আন্দোলনে থাকতাম আর রাতে এসে ফেসবুক পেজ থেকে সাক্ষ্য দিতাম এই হত্যাকাণ্ডের, প্রচার করতাম আহত, নিহত আর হামলার খবরগুলো। পরবর্তী সময়ে আমরা আমাদের সংগঠনের পেজ থেকে বিভিন্ন চিকিৎসা দলের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের যোগাযোগ করিয়ে দিতাম।
১৬ জুলাই আমরা যখন রাস্তা ব্লক করে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার বিচার চাচ্ছিলাম, প্রতিরক্ষার জন্য আমাদের কাছে তখন কিছুই ছিল না। এরপর চোখের সামনেই যখন রক্তক্ষয় দেখলাম, বুঝতে পারি যে আমরা যত শান্তিপূর্ণ থাকব, ততই আমাদের লাশের সংখ্যা বাড়বে। সে রাতে তাই আমরা দ্রুত কিছু সিদ্ধান্ত নিই। সবাইকে বলা হয়, অন্তত প্রতিরক্ষার জন্য সঙ্গে একটি লাঠি রাখতে হবে আর বানাতে হবে পিপার স্প্রে। রাবার বুলেট থেকে বাঁচতে ব্যাগে নিতে হবে মোটা একটা বই। আমার সবচেয়ে ভারী বইটা ছিল উপনিষদ, সেটাই নিতাম সঙ্গে। কাঁদানে গ্যাস থেকে বাঁচতে নিতাম লাইটার, টুথপেস্ট, মাস্ক আর ওড়না। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় ফোন থেকে মুছে ফেলতাম আন্দোলনের সব আলোচনা আর বার্তা। কিন্তু এত কিছুর পরও কি বুলেট আর হেলমেট পরে মোটা বাঁশ নিয়ে ধাওয়া দেওয়া পেশাদার গুন্ডাদের সঙ্গে পেরে ওঠা যায়?
১৮ জুলাই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে কাঁদানে গ্যাসের শেল আর ছররা গুলি নিক্ষেপ করা হয়। আমাদের সেই সাজানো–গোছানো আদরের ক্যাম্পাস রক্তাক্ত হয়ে যায় মুহূর্তেই, ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে ক্যাম্পাসের কুকুরগুলো ভয়ে দিগ্বিদিক ছুটতে থাকে। ছাত্রছাত্রীরা যাতে ক্যাম্পাস থেকে বের হতে না পারে, এ জন্য একসময় ছাত্রলীগ চারদিক থেকে ঘেরাও করে ফেলে। আর পুলিশও অ্যাম্বুলেন্স প্রবেশে বাধা দেয়। প্রচুর হতাহত হয় সেদিন, কলেজপড়ুয়া একটি ছেলে মারা যায় মেডিকেল রুমে সবার চোখের সামনে। সেই অসহায় মুহূর্তে আমাদের কিছু শিক্ষক, গার্ড আপা ও গার্ড মামা ঢাল হয়ে পাশে এসে দাঁড়ান।
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যখন রক্তাক্ত, তখন ফেসবুকে ঢুকতেই দেখলাম, আমার খুব পছন্দের একজন সাবেক শিক্ষক মন্তব্য করেছেন আন্দোলন সম্পর্কে, ‘চাকরির পলিটিকসকে দেশের পলিটিকস বানানোর দরকার আছে? দুই পক্ষই বাড়াবাড়ি করছে!’ নিরস্ত্র ছাত্রছাত্রীদের ওপর রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুলি করছে আর আমার প্রিয় শিক্ষকের কাছে তা লাগছে বাড়াবাড়ি! শুধু তাঁর নয়, এ রকম পোস্ট ছিল অনেক শিল্পী আর তথাকথিত বুদ্ধিজীবীর। হয়তো তাঁরা আশা করেছিলেন, কিছুদিন পর সবাই আবার সব ভুলে স্বাভাবিক জীবনে ফেরত যাবে। ওই সময় নিজেকে প্রশ্ন করছিলাম, চোখের সামনে এতটা নৃশংসতা দেখে আবার আগের জীবনযাপনে ফেরা কি সম্ভব? সব ভুলে শুধু পড়াশোনা আর চাকরির জন্য ছোটাছুটি করা সম্ভব? এই ঘৃণা, রাগ, কষ্ট—সবকিছু পুষে রাখব আমি?
১৯ জুলাই ব্ল্যাকআউট শুরু হলো। সে এক অদ্ভুত সময়। ইন্টারনেট বন্ধ। এদিকে টিভি চ্যানেলগুলোর ওপর তো ভরসা উঠে গেছে অনেক আগেই। আমি যে এলাকায় থাকি, সেটা মেইন রোড থেকে বেশ ভেতরে। রাস্তার কোনো কোলাহলের শব্দ এখান অবধি আসে না, চারদিকে তখন শুধু অস্বস্তিকর নীরবতা। পরিচিতজনদের ফোন দিয়ে খোঁজখবর নিয়েই সেদিন কাটিয়ে দিলাম আমি। ১৮ জুলাই আমাদের ক্যাম্পাসে হামলার পর আমার অনেক বন্ধুই বাড়ি ফিরতে
পারেনি তখনো, আশপাশের কোনো পরিচিত বা শিক্ষকের বাসায় থেকে গেছে। কারও বাসায় আবার ছাত্রলীগের ছেলেরা এসে হুমকি দিয়ে গেছে। সবার কাছে সারা দেশের পরিস্থিতি শুনে আরও অস্থির হয়ে পড়ছিলাম। নানা রকম তথ্য দিচ্ছিল সবাই। কেউ বলছিল, প্রচুর গোলাগুলি হচ্ছে চারদিকে, রাস্তায় রাস্তায় মানুষ আহত হয়ে পড়ে আছে, অমুক জায়গায় নাকি শুধু লাশ আর লাশ। সন্ধ্যায় এক আন্দোলনকারী ছোট বোন ফোনে বার্তা দিল, ‘কাজলা, যাত্রাবাড়ীতে বাড়িওয়ালাদের জিম্মি করে পুলিশ বাড়ির মধ্যে ঢুকে ছাদ থেকে টার্গেট করে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালিয়েছে।’ বুঝতে পারছিলাম না, কথাটার কতটা গুজব আর কতটুকু সত্য। আসলে এমন একটা সময় ছিল যে গুজব আর সত্যের মাঝখানের সীমারেখা ক্রমেই হয়ে উঠছিল অস্পষ্ট। কারণ, গুজব যা শুনতাম, তার চেয়েও ভয়াবহ নৃশংসতা তো দেখছিলাম চোখের সামনেই।
সারা দিন ঘরে বসে আতঙ্কে কাটানোর পর সন্ধ্যার দিকে আমি মায়ের সঙ্গে বাজার করার জন্য বের হই। আমাদের বাসার আশপাশে তেমন কোনো দোকানপাট নেই, বাজারসদাইয়ের জন্য যেতে হয় বড় রাস্তার কাছে। সেদিকেই যাচ্ছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে দেখি, চারদিক একদম ফাঁকা, কোথাও লোকজন নেই। একজন রিকশাওয়ালা পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় শুধু বলল, ‘আপা, একা একা ওই দিক যাইয়েন না, অবস্থা ভালো না। রাস্তার মধ্যে এক আনারসওয়ালা মরে পড়ি আছে।’
আমরা গন্তব্য পাল্টে বাসার কাছে একটা ফার্মেসি থেকে শুধু দরকারি ওষুধ কিনে বাড়ি ফিরি। এসে দেখি, দুধওয়ালা দুধ দিতে এসেছে। আমরা কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সে–ও আমাদের আনারসওয়ালার কথা জানাল। পায়ে গুলি খেয়ে পড়ে আছে পদচারী–সেতুর নিচে। কেউ ভয়ে হাসপাতালে নিয়ে যায়নি। মা সব শুনে দুধওয়ালাকে জানাল, এই কয়েক দিন দুধ না দিলেও চলবে। আসার দরকার নেই। দুধওয়ালা মলিন হেসে উত্তর দিল, ‘না এসে তো উপায় নেই, আপা। আপনারা না চাইলেও অন্য অনেক বাসার লোক তো চাইবে যে আমরা আসি। আর কাজ বন্ধ করে রাখলে তো মালিক টাকা দেবে না।’
সে রাতে আমার ঘুম আর আসে না, কিছু খেতেও পারি না। চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাচ্ছিলাম, গুলি খেয়ে রাস্তায় পড়ে আছে একজন, রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারদিক। আর তার ঝুড়ি থেকে চারদিকে ছিটকে পড়ে আছে আনারস। একসময় ব্যথায় চিৎকার করতে করতেই সবার অলক্ষ্যে গুলি আর ধোঁয়ার মাঝে লোকটা চুপচাপ মারা গেল। তার পরিবার কি জানে, সে কোথায়?
পরের দিন সকালে ফোন দিল বনশ্রীবাসী এক বন্ধু। বেশ কিছুক্ষণ অপ্রকৃতিস্থের মতো ব্যবহার করে ও বলল, রাস্তায় এত লাশ দেখে ও আর মাথা ঠিক রাখতে পারছে না। প্রচুর মানুষ আহত হয়েছে, হাসপাতালে যাচ্ছে। চারদিকে কাঁদানে গ্যাসের গন্ধ। এর মধ্যে ফরাজী হাসপাতালের সামনের গলিতে কিছু ছেলে আগুন জ্বালিয়ে তাণ্ডব করছে, ভাঙচুর করছে, কাউকে হাসপাতালে ঢুকতে দিচ্ছে না। তবে এই ছেলেগুলোর রাজনৈতিক পরিচয় ও জানে না। এরপর থেমে যোগ করল, ওদের গলির চানাচুরওয়ালা গুলি খেয়ে মারা গেছে। তার পাঁচ সন্তান। স্বামীর লাশ আর সেই পাঁচ সন্তানকে নিয়ে তাদের জননী আকুল হয়ে কান্না করেছিল রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে। এরপর আশপাশের বাসাবাড়ি থেকে কিছু টাকা জোগাড় করে লাশ গ্রামে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।
পরিচিত মানুষের কাছ থেকে পাওয়া হামলার খবর, কাঁদানে গ্যাসের গন্ধ আর দূর থেকে আসা বুলেটের শব্দ—এ–ই ছিল তখনকার দিনরাত্রি। এরই মধ্যে একদিন টিভিতে দেখলাম, সমন্বয়কেরা আট দফা দিয়েছে। সেই আট দফায় আমি সন্তুষ্ট ছিলাম না, সবচেয়ে বেশি হতাশ হয়ে পড়েছিলাম তখনই। এতগুলো মানুষ মারা গেছে, আর শুধু কোটা সংস্কার করেই সব ভুলে যাবে সবাই! মনে হচ্ছিল, আন্দোলন বিক্রি হয়ে গেছে, আর কোনো আশা নেই। পরে অবশ্য শুনেছিলাম যে দফা ছিল নয়টা, কিন্তু টিভিতে দেখানো হয়েছিল আট দফা।
ব্ল্যাকআউটের পর যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফিরে এলাম, ধীরে ধীরে অর্ধপরিচিত অনেকের মৃত্যুর সংবাদ পাই। বুঝতে পারি, আমার মতো অনেকেই আছে, যারা এই মৃত্যুগুলো ভোলেনি, যারা আপস করতে চায় না। এরপর একটু একটু করে প্রতিদিন মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে আন্দোলনে। আমার বাসা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দূরে হওয়ায় সব সময় সেখানকার আন্দোলনে যোগ দিতে পারতাম না। তাই বাসার কাছেই আন্দোলনে যোগ দিতাম, একা একা। এখানে নানা বয়সী মানুষ আসত, খাবার নিয়ে, জল নিয়ে। কেউ সঙ্গে নিয়ে আসত তাদের ছোট্ট বাচ্চাটিকেও। বৃষ্টি আসত এর মধ্যে। দেখতাম, বৃষ্টির মধ্যে কোনো কোনো মেয়ের কাপড়ে পিরিয়ডের রক্ত...। তবু তারা স্লোগান দিচ্ছে, ‘আমার ভাইয়ের বুকে রক্ত কেন?’
একদিন আন্দোলনে আমাকে একা একা খালি হাতে দেখে অচেনা একটা ছেলে আমার প্রতিরক্ষার জন্য একটা লাঠি দিয়ে যায়। আর ওর বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলে, ওদের সঙ্গে যেন দল বেঁধে থাকি। মনে পড়ে, একদিন বৃষ্টির পর এক অচেনা আন্টি এসে তার ওড়না দিয়ে আমার মাথা মুছে দিয়েছিল। সেই ভিড়ের মধ্যে কখনোই তাই নিজেকে একা মনে হতো না। এই মমতা ও ভালোবাসা দেখার পর যাঁরা তখনো নিশ্চুপ ছিলেন বা আপসমূলক মনোভাব পোষণ করছিলেন, তাঁদের কথা ভাবার কি আর সময় থাকে?
আমি বুঝতে পারতাম, এত কিছু দেখার পর যদি আমরা ফিরে যাই, তাহলে আমাদের একটা জীবন্ত লাশ হয়েই কাটাতে হবে বাকি জীবন। এর চেয়ে এই যে প্রতিদিন কিছু চেনা-অচেনা মানুষের ভালোবাসা পাচ্ছি, তা বুকভরে গ্রহণ করে, শেষনিশ্বাস পর্যন্ত নিজের আত্মার প্রতি সৎ থেকে মৃত্যুবরণ করাই কি শ্রেয় নয়?
আমরা সবাই হয়তো সেটাই বেছে নিয়েছিলাম।
* উপমা অধিকারী: ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী