সন্তানদের পাশে
চাকরি, সংসার, সামাজিকতা আর দৈনন্দিনতার চাপে আমার জেরবার অবস্থা। জুলাইয়ের প্রথম আট-দশ দিন তাই কোনো কিছু তেমন গোচরে আসেনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দু–একটা লিংক আর অফিসের লাঞ্চের ফাঁকে কিংবা ফোনের আলাপচারিতার মধ্যে একটু–আধটু খবর পাই আন্দোলনের। ছাত্ররা নাকি আবার কোটাব্যবস্থার বিরোধিতা শুরু করেছে! ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ হচ্ছে, মিছিল করছে, পথরোধ করছে ছেলেমেয়েরা। খুব একটা মনোযোগ দিইনি এসবের দিকে।
এর মধ্যে হঠাৎই একদিন, খুব সম্ভবত ১১ বা ১৪ তারিখে অনেক দিন পর একটা অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটল। দুপুরের দিকে অফিসের কাজে বেরিয়েছি। রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুলের কাছাকাছি আসতেই কয়েকজন ছাত্রছাত্রী আমার গাড়ি ঘিরে ধরল, বেশ ভদ্রভাবে যা বলল তার সারমর্ম হলো, গাড়ি নিয়ে আর এগোনো যাবে না। ওরা রাস্তা ব্লক করেছে। আমি একটু অনুনয়–বিনয় করে বললাম আমার পায়ে ব্যথা, আমার ক্ষেত্রে যেন একটু নিয়মের ব্যতিক্রম করে তারা। কিন্তু ওরা অনড়। গাড়ি সামনে যাবে না আর। মিষ্টি দেখতে একটা মেয়ে গাড়ির জানালার বাইরে থেকে আমাকে বলল, ‘আন্টি, আপনারা আমাদেরকে সাপোর্ট না করলে কীভাবে সফল হব?’ এই কথার পর তো আর কোনো কথা চলে না। আমি ল্যাপটপের ব্যাগ, জরুরি ফাইলপত্র গাড়িতে রেখে নেমে এলাম রাস্তায়।
হাঁটতে শুরু করলাম মিছিলের পাশে পাশে। ছাত্রছাত্রীরা হাত ধরাধরি করে, স্লোগান দিতে দিতে, রাস্তা দখল করতে করতে এগোচ্ছে। এর মধ্যে আকাশ কেমন ঘোলাটে হয়ে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। কিচ্ছু করার নাই বিধায় টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে ছেলেমেয়েগুলোর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই কী যেন কী ঘটে আমার ভেতরে। বয়সটা কেমন হুট করে কমে গেল! রক্তে বেশ একটা দোলা লাগল। মিরপুর রোডটাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বলে মনে হলো। ঠোঁট বিড়বিড়িয়ে আমিও ওদের সঙ্গে স্লোগান দিতে শুরু করলাম, ‘মেধা না কোটা? মেধা, মেধা!’ ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আসাদ গেট পেরিয়ে আমরা চলে এলাম আড়ংয়ের মোড়ে। দেখেতে পেলাম সাদা সাদা স্কুলের পোশাকে আরও অনেক ছাত্ররা ঘিরে রেখেছে ২৭ নম্বরের মোড়। আমি ভিডিও করতে করতে, ওদের সঙ্গে স্লোগান দিতে দিতে ধানমন্ডির দিকে বাঁক নিই। অল্প এগোলেই বাড়ির পথ। ‘তোমাদের আন্দোলন সফল হোক’ বলে প্রতিবাদী ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে যখন বিদায় নিচ্ছি, চটপটে একটা ছেলে এসে ‘আন্টি, হাই ফাইভ’ বলে হাত মিলিয়ে দৌড়ে ভিড়ে মিশে গেল। আর আমি ছাত্রবয়সের উদ্দাম মনে ধারণ করে ঘরে ঢুকলাম।
পরদিন থেকে পত্রিকা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আন্দোলনের খবরাখবর, ছাত্রছাত্রীদের ওপর নির্যাতনের খবর পড়তে শুরু করলাম। আর ১৬ তারিখের দুপুরের পর কোনো একটা সময়ে আবু সাঈদের ভিডিওটা এল, অবশ করে দিল আমাকে। জানলাম ছেলেটা ঠিক আমার মেয়ের বয়সী। ঘুমাতে পারলাম না সারারাত। মিরপুর রোডের প্রতিবাদ করা বাচ্চাগুলোর মুখ ভেসে উঠছিল বারবার। ভয় হচ্ছিল, হাই ফাইভ করা সেই ছেলেটার যদি আবু সাঈদের মতো কিছু হয়ে যায়!
ঠিক এর এক দিন পর সোশ্যাল মিডিয়াজুড়ে ফারহান ফাইয়াজের ছবি, খবর। রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুলের ছাত্র। জন্ম সেপ্টেম্বরে, ২০০৬–এ। ঠিক আমার ছেলের বয়সী। অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল আমার। সিদ্ধান্ত নিলাম আর ঘরে থাকা যাবে না। একটা কিছু করতেই হবে! আমার সন্তানসম বাচ্চাদের নির্বিচার মেরে ফেলা হবে, আর মা হয়ে আমি ঘরে বসে থাকব? এটা হতে পারে?
চারদিকে যোগাযোগ করতে শুরু করলাম। বন্ধু, আত্মীয়, প্রতিবেশী, পরিচিত সুহৃদেরা সবাই একমত, কিছু একটা করতে হবে। কী, তা আমরা জানি না। এলোপাতাড়িভাবে একে–তাকে ফোন দিতে দিতে কবি মাহবুব মোরশেদ খবর দিলেন রাখাল রাহা নামের একজন ‘সন্তানের পাশে অভিভাবক’ ব্যানারে কিছু একটা করার চেষ্টা করছেন। একেবারে যেন মিলে গেল আমার মনের সঙ্গে। ঠিক এ রকম কিছু একটাই খুঁজছিলাম আমি। মা হিসেবে সন্তানের সুরক্ষার জন্য যা করতে হয় করব। নম্বর জোগাড় করে ফোন দিলাম রাখাল রাহাকে। কথা হলো বেশ খানিকক্ষণ। জানলাম পরদিন, অর্থাৎ ১৯ জুলাই শাহবাগে সকাল দশটায় উনি আরও কয়েকজন অভিভাবকসহ প্রতিবাদসভার আয়োজন করতে চলেছেন। ওনাকে বললাম আমরা জনা পঁচিশেক মা–বাবা এক হয়েছি। আমরা এই সভার অংশ হতে চাই। উনি আমাদের স্বাগত জানালেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে আমার পরিচিতদের খবরটা জানালাম। ফেসবুকের মাধ্যমে খবরটা ছড়াতে শুরু করলাম। বাড়িতে এ-ফোর কাগজে স্লোগান লিখতে শুরু করলাম। আশপাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশীরাও যুক্ত হলেন পোস্টার লেখার কাজে। একটু পরপর ফেসবুকে উঁকি দিই, দেখি কতজনে রিচ হলো আমাদের পরদিনের প্রতিবাদসভা, ‘সন্তানের পাশে অভিভাবক’–এর খবর। কতজনে শেয়ার করল স্ট্যাটাস? মনে একটা আশা ছিল সারা রাতে আরও অনেক শেয়ার হবে, অনেক মানুষ জানবে, ছড়িয়ে যাবে আমাদের এই উদ্যোগের কথা। অনেক অনেক মা, বাবা, শিক্ষক, অভিভাবক যুক্ত হবেন। আমরা সবাই মিলে সাহস জোগাব আমাদের প্রতিবাদে মুখর সন্তানদের।
রাত সাড়ে এগারোটার দিকে টের পেলাম ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। হতাশা নিয়ে লক্ষ করলাম মাত্র এক শ শেয়ার হয়েছে আমাদের সভার খবর। কারও সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে পারছি না সহজে। ভয়, উত্তেজনা, আশঙ্কা মনে নিয়ে পার করলাম রাত।
সকালের দিকে ফ্ল্যাটের নিচে প্রতিবেশীরা জড়ো হতে থাকলাম। হাতে আঁকা পোস্টার নিয়ে আমরা রওনা হই শাহবাগের দিকে। খুঁজতে থাকি রাখাল রাহাকে। পেয়েও যাই। দেখলাম উনি বেশ গুছিয়ে, ভালো প্রস্তুতি নিয়ে এসেছেন। ছাপানো ব্যানারে লেখা, ‘মৃত্যু এত সহজ কেন?’ নিচে ‘সন্তানের পাশে অভিভাবক’। আমরা কয়েকজন মিলে সেই ব্যানার ধরে দাঁড়িয়ে গেলাম জাদুঘরের গেটের সামনে। উল্টো দিকে অজস্র পুলিশ। দেখলাম পরিচিত কিছু সুজন, বন্ধু এসে দাঁড়াচ্ছে এক এক করে। সময় যত এগোচ্ছে, লোক বাড়ছে একটু একটু করে। একটা সময়ে প্রায় ৫০–৬০ জন যখন একত্র হলাম, বক্তব্য দিতে শুরু করলাম আমরা। একটা সময়ে ব্যানারের সামনে এসে বসলেন কয়েকজন অভিভাবক, যাঁদের একজন বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একজন উপদেষ্টা। দেখলাম গণমাধ্যমের পরিচিত মুখ—আবদুন নূর তুষার, সারা আফরিন, কামার আহমাদ সাইমনকে। বেশ কয়েকজন শিক্ষক এসে বক্তব্য দিলেন।
আমাদের সমাবেশ যখন চলছে, তখন দুইবার ছাত্রলীগের ছেলেরা মোটর সাইকেলের বড়সড় বহর নিয়ে চক্কর দিয়ে গেল। ওদের উদ্দেশ্য ছিল একটা আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করা। আমরা ভ্রূক্ষেপ না করে সমাবেশের কাজ চালিয়ে গেলাম। ছাত্রসম সন্তানদের সবাই অভয় দিয়ে বললেন, ‘তোমরা মাথা নত কোরো না। আমরা সঙ্গে আছি, পাশে আছি।’
প্রথম দিনের এই উদ্যোগকে যথেষ্ট আশাজাগানিয়া মনে হলো। আমি আর রাখাল রাহা সেই প্রতিবাদসভা চলাকালেই সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা আমাদের এই উদ্যোগ বহাল রাখব। ঠিক হলো পরদিন আমরা ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে জড়ো হব। ১৮ জুলাই ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ওপরে পুলিশের তাণ্ডবের প্রতিবাদে আমরা জড়ো হব, প্রতিবাদ জানাব।
ঘরে ফিরে পরদিনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করি নতুন উদ্যমে। রাতে রাখাল রাহার সঙ্গে ফোনে পরদিনের করণীয় নিয়ে কথা বলছি, শুনলাম টিভিতে বলছে রাত থেকে কারফিউ। বুঝে গেলাম পরদিনের পরিকল্পনা বাতিল। যদিও রাখাল রাহাসহ আরও কয়েকজন শনিবারে ঢাকা মেডিকেলের সামনে মৌন প্রতিবাদ করতে গিয়ে পুলিশের জুলুমের শিকার হয়ে ফেরত চলে আসেন।
পরবর্তী কটা দিন আর সবার মতো ভয়াবহ কাটতে থাকে আমাদের। চারপাশে এত এত মৃত্যু, এত হতাহতের খবর আর কিচ্ছু করতে না পারার হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়ি আমরা। ২৬ তারিখে শুক্রবারে, আমরা পরীবাগে বেশ কিছু অভিভাবক এক হই আবারও। ঠিক করি, আমরা আলাদা করে আর কোনো উদ্যোগ নেব না। ছাত্রছাত্রীরা যেখানে প্রতিবাদ করবে, জমায়েত হবে, আমরা ওদের সঙ্গে সংহতি জানাতে সেখানেই যাব, পাশে থাকব। পরবর্তী দিনগুলোতে আমরা প্রেসক্লাব, শহীদ মিনার, পলাশীর মোড়—যে যেখানে পেরেছি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের সঙ্গে প্রতিবাদে যুক্ত থেকেছি। এক এক করে আরও অনেক মা–বাবা যুক্ত হচ্ছেন আমাদের সঙ্গে। এর মধ্যেই ২ আগস্ট শিল্পীসমাজ আবাহনী মাঠে জমায়েত করে। খবর আসে, আরও কিছু অভিভাবক গুলশানের সাহাবুদ্দীন পার্কে প্রতিবাদসভার আয়োজন করেছেন। এর মাঝেই ৯ দফা দাবি এক দফার দিকে মোড় নিতে শুরু করল। আমরা ঠিক করলাম ৩ তারিখে আবার আমরা শাহবাগে দাঁড়াব। এবার আমাদের দাবি আরও জোরালো, অবস্থান আরও শক্ত। আমরা এখন আর এই খুনি সরকারকে আর চাই না। ১ তারিখ রাত থেকে সারা আফরিন, রাখাল রাহা আর আমি পোস্টার–ব্যানার তৈরিতে নেমে পড়লাম। সারা রাত ধরে আমার মেয়ে ও তার বন্ধুদল, চারুকলার এক সময়ের ছাত্র আমার এক ভাই মিলে ডিজিটাল পোস্টার তৈরি করল। সারা তৈরি করল শহীদ ছাত্রদের মুখ আঁকা পোস্টার। সকালে প্রিন্ট করলেন রাখালদা। আমরা প্রস্তুত।
৩ তারিখে সকালে আবারও শাহবাগ। এবার আরও অনেক অনেক সহযাত্রী আমাদের পাশে, আরও তীব্র প্রতিবাদে মুখর আমরা। সমাবেশ শেষ করে মিছিল নিয়ে আমরা অভিভাবকের দল এগোতে থাকি। অবাক বিস্ময়ে দেখি রিকশা থেকে নেমে আমাদের মিছিলে যোগ দিচ্ছে তরুণ দুটো ছেলেমেয়ে, বাজারভর্তি ব্যাগ হাতে একজন মা আমাদের সঙ্গে হেঁটে হেঁটে সংহতি প্রকাশ করেন। আমরা সাহস পাই, ভরসা পাই সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে।
বিকেলের দিকে আমরা শহীদ মিনারে যাই। লাখ লাখ মানুষের মাঝে আবারও পোস্টার আর ব্যানার নিয়ে দাঁড়াই। কেউ কেউ এসে আমাদের থেকে পোস্টার চেয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে গা ঘেঁষে। এক হাত থেকে অন্য হাতে ঘুরতে থাকে আবু সাঈদ, রাব্বি, মুগ্ধ, ফাইয়াজের মুখচ্ছবিতে আঁকা আমাদের পোস্টার। ভিড়ের মিছিলে শহীদ সন্তানদের হাস্যোজ্জ্বল মুখগুলো দেখতে পাই দূর থেকে আর কীভাবে আমরা যেন টের পেয়ে যাই ওদের মৃত্যু বৃথা হতে যাচ্ছে না। শিগগিরই আসছে মুক্তি।
*আসফিয়া আজিম: ‘সন্তানের পাশে অভিভাবক’–এর অন্যতম সংগঠক; জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ