সংগীত পরিচালক হিসেবে মণি রত্নমের রোজা আপনার প্রথম চলচ্চিত্র। আর তাতেই পুরো উপমহাদেশ ভেসে গেল। শ্রোতারা চমকিত হয়ে ২৬ বছর বয়সী এমন এক যুবকের আবির্ভাব দেখল, যিনি তরতাজা ও চমকপ্রদ সুর সৃষ্টি করার জন্য শব্দকে সার্কাসের বলের মতো লোফালুফি করতে পারেন।
এ আর রাহমান: তাই কি, আমার বয়স কি তখন ২৬? উম্, না, না। আমার জন্ম তো ১৯৬৭ সালে, আর রোজা মুক্তি পায় ১৯৯২-এ। রোজা র গানগুলো যখন আমি করছি, তখন আমার ২৫ বছর বয়স।
প্রথম ছবিতে জীবনের প্রথম অ্যালবামে, ওই বয়সেই, সেই অসম্ভব সম্ভব করেছিলেন কীভাবে?
রাহমান: আসলে তখনো আমার মাথায় এমন কোনো ভাবনা একেবারেই ছিল না যে ভবিষ্যতে আমি আরও কোনো ছবি করার সুযোগ পাব। আমি ভেবেছিলাম, রোজাই আমার প্রথম ও শেষ ছবি। ফলে ব্যাপারটা আমার কাছে ছিল অনেকটা এ রকম যে অবসর নেওয়ার আগে জীবনের শেষ ছবিতে সংগীতের কাজটুকু সেরে নাও। যতটা সম্ভব একেবারে সেরা উপায়ে। আবার একই সঙ্গে আরেকটি অনুভূতিও সে সময় আমি টের পাচ্ছিলাম। তখন আমার মধ্যে একধরনের আধ্যাত্মিক অনুভবের উন্মেষ ঘটছিল। সুফি-জাতীয় বিষয়াদির সঙ্গে আমি জড়িয়ে পড়েছিলাম। একটি অজানা প্রত্যয় আমার মধ্যে ভর করেছিল। গানগুলোর সুর যেন ঠিক আমি নিজেই করিনি, বরং গানগুলো আমার মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল।
চলচ্চিত্রে সুনির্দিষ্ট কাহিনি, সিকোয়েন্স ও পাত্রপাত্রীর ভেতরে থেকে একটি লিরিকের সাংগীতিক সম্ভাবনা আপনাকে খুঁজে বের করতে হয়। সেটি একধরনের চ্যালেঞ্জ তো অবশ্যই। আবার ‘বন্দে মাতরম’ বা ‘জনগণমন’-এর মতো কোটি কোটি মানুষের সহস্রবার গাইতে গাইতে অন্ধিসন্ধি মুখস্থ হয়ে যাওয়া গান নতুন স্বাদে তুলে দেওয়াও নিশ্চয় বিরাট এক চ্যালেঞ্জ। এ দুটোর মধ্যে...
রাহমান: সত্যি বলতে কি, দ্বিতীয় ধরনের গানগুলো করার মধ্য দিয়ে সুর-রচয়িতা হিসেবে আমার ভূমিকার আরও প্রসার ঘটেছে। শুরুতে তো সিনেমার গানের জন্য সুর করা ছাড়া অন্য
কোনো ভূমিকার কথা আমার কল্পনার সীমানাতেও ছিল না। কিন্তু ভারতবালার মতো আমার যুবক চিত্রনির্মাতা বন্ধুরা একবার ভাবলেন, আমাকে নিয়ে একটি মিউজিক ভিডিও করা যাক। প্রথমে ‘বন্দে মাতরম’ করা হলো। আমিও তখন যুবক। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, ১২ বছর বয়স থেকেই আমি প্রবীণদের সঙ্গে কাজ করে আসছি। এই গানটা করতে গিয়ে আমি অকস্মাৎ টের পেলাম, আরে, আমিও তো আসলে যুবক। তারপর হলো কি, ওই গানটা কী করে যেন একটি রাজনৈতিক মাত্রা পেয়ে গেল। গানটা আমার ভূমিকাও যেন কেমন করে অনেকটা বদলে দিল। এ গানের মধ্য দিয়ে আমার পরিচয় যেন সংগীত পরিচালকের জায়গা থেকে কিছুটা ছাপিয়ে গেল। যে প্রীতি আমি পেলাম, সেটুকু কাজে লাগিয়ে ভারতবালা তখন ‘জনগণমন’ গানটি করলেন। সেটি ছিল অন্য রকমের এক প্রেরণাময় অনুভূতি। অন্য সব গানের চেয়ে এই গানের অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণভাবে আলাদা।
এই দুই ধরনের গানেই কিন্তু আপনাকে কাজ করতে হয়েছে অন্যের শর্তের মধ্যে। আপনার নিজের জন্য সুর রচনা করতে ইচ্ছা করে না?
রাহমান: সত্যি বলতে কি, নিজের গানের অ্যালবামেই শুধু সেটি করা সম্ভব। আমি যে সেটা করিনি, তা–ও নয়। তবে খুব বেশি পারিনি। সে রকম কাজ আমি আরও করতে চাই। কিন্তু চলচ্চিত্রের স্রোত সেখান থেকে আমাকে হটিয়ে দেয়। শুধু হটিয়ে দেয় না, একেবারে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আবার ধরুন, ব্যক্তি ও সামাজিক মানুষ হিসেবে নানা রকমের দায়ও তো আমাদের বহন করতে হয়। সে জন্য ছবির কাজ করতেই হয়।
তাই বলে আবার ভাববেন না যে ছবির গান করতে আমি ভালোবাসি না। আমি সেটা খুবই ভালোবাসি।
শুরুর দিকে আপনার গান ছিল সরল ও সুরেলা; চটজলদি আকর্ষণ করার মতো। আপনার গান ধীরে ধীরে জটিল হতে শুরু করে। নুসরাত ফতেহ আলী খানের সঙ্গে ‘চান্দা সুরজ লাখোঁ তারে’ গানটি করার সময় আপনি এক সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, এ গানের
ভেতর শ্রোতারা স্থানের একটি ব্যাপ্তি অনুভব করবে।
রাহমান: আসলে শব্দ নিজেই আপনাকে এ ধরনের অনুভূতি দিয়ে থাকে। রুদ্ধ ঘরে বসে থাকলে শব্দই বলে দেবে, আপনি কোথায় আছেন। আবার চোখ বন্ধ করেও যদি আপনি রাজপথে উঠে আসেন, শব্দেই আপনি বুঝতে পারবেন, এটি রাজপথ, চারপাশটা খোলা। শব্দের এ এক অপূর্ব খেলা। তা ছাড়া সুর রচনার সময়ও তো আপনি একই জায়গায় বসে থাকতে পারেন না। সেটা একসময় ক্লান্তিকর হয়ে পড়বে, আপনার ও শ্রোতার—দুজনের পক্ষেই। আসলে প্রবল উদ্দীপনাই আমাদের অনবরত টেনে নিয়ে যেতে থাকে।
আপনার মধ্যে আমরা একটি ধর্মভাব টের পাই। আপনার জীবন ও সংগীতের ওপর এই আধ্যাত্মিক অনুভূতির কি কোনো প্রভাব পড়েছে?
রাহমান: এটা অনেকটা সূর্যের কাছ থেকে আলো গ্রহণ করার মতো। সূর্যের কাছ থেকে,
৪০ ওয়াটের বাতির কাছ থেকে নয়। বাতি আপনাকে জানান দেয়, সূর্য নয়। সূর্য কোটি কোটি লোককে আলো দিচ্ছে, তারা চায় কি চায় না তার বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে। আপনি যে সূর্যের কাছ থেকে নিচ্ছেন, তা–ও কিন্তু অসচেতনভাবেই। প্রকৃতি আমাদের বিস্ময়ে স্তব্ধ করে দেয়। প্রকৃতির সৌন্দর্যে আমরা ভরে উঠি, অনুপ্রাণিত হই।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ ঢাকায়
১৫ মার্চ ২০১৪ (সংক্ষেপিত)