কর্মীর লেখা
বরং দ্বিমত হও
প্রথম আলোর ২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কর্মীদের কাছে লেখা আহ্বান করা হয়েছিল। তাঁরা লিখেছেন প্রথম আলোকে নিয়েই। কর্মীদের নির্বাচিত কিছু লেখা নিয়েই এ আয়োজন।
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। প্রথম আলোয় আমার যোগদান এক বছর পূর্ণ হতে চলেছে। আজ অফিসে আমার সার্কুলেশন বিভাগ মাসিক মিটিং ডেকেছে। যোগ দিতে রাজশাহী থেকে ঢাকায় এসেছি। সকালে নির্ধারিত সময়ে সিএ ভবনের কনফারেন্স রুমে মিটিং শুরু হলো। বিভাগীয় প্রধানসহ সার্কুলেশন টিমের সবাই উপস্থিত আছেন। কিছু সময় পরে সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা সম্পাদক একসঙ্গে এলেন। ইতিমধ্যে বার্তা বিভাগসহ অন্য কয়েকটি বিভাগের ঊর্ধ্বতন অনেকেই যোগ দিয়েছেন।
আলোচ্যসূচি অনুযায়ী আলোচনা শুরু হলো। কুশল বিনিময় শেষে সম্পাদক স্যার তাঁর বক্তব্য শুরু করলেন। শুরুতেই এক এক করে আমাদের টিমের প্রত্যেকের গত মাসের পারফরম্যান্স জানলেন। সার্কুলেশন টিমের উদ্দেশে কিছু নির্দেশনামূলক কথা বললেন। এরপর একটি প্রতিযোগী পত্রিকার সার্কুলেশন পরিস্থিতির তথ্য উপস্থাপন করলেন। বেশ কিছু জেলায় সেই প্রতিযোগী পত্রিকাটির সার্কুলেশন অবস্থান আমাদের তুলনায় ভালো। জেলাগুলোর মধ্য থেকে বেছে বেছে পাঁচটি জেলা নির্দিষ্ট করলেন। এই পাঁচটি জেলায় প্রথম আলোর সার্কুলেশন কীভাবে এগিয়ে নেওয়া হবে, তার একটা পরিকল্পনা বর্ণনা করলেন। প্রত্যাশিত লক্ষ্যমাত্রা পত্রিকার কপি সংখ্যায় কত হবে, তা–ও নির্ধারণ করে দিলেন।
বেশ দৃঢ়ভাবে বললাম, পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন সম্ভব, তবে এভাবে নওগাঁ জেলায় প্রত্যাশিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না। মনে মনে যা ভেবেছিলাম তা–ই, আমার উত্তর শুনে তিনি অবাক বিস্ময়ে আমার দিকে তাকালেন।
এই পাঁচটি জেলার মধ্যে আমার কর্ম অঞ্চলের নওগাঁ জেলাও আছে। সম্পাদক স্যার তাঁর বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে ইঙ্গিত করলেন। জানতে চাইলেন, এটি সম্ভব কি না এবং নওগাঁয় আমরা প্রত্যাশিত ফলাফল পাব কি না? তাঁর হঠাৎ প্রশ্নে একটু দ্বিধায় পড়লাম।
কী বলব, মাথায় যা ঘুরছে তা–ই, নাকি মুখের সহমত? কয়েক সেকেন্ড ভেবে, রিস্ক নিয়েই ফেললাম! বেশ দৃঢ়ভাবে বললাম, পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন সম্ভব, তবে এভাবে নওগাঁ জেলায় প্রত্যাশিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না। মনে মনে যা ভেবেছিলাম তা–ই, আমার উত্তর শুনে তিনি অবাক বিস্ময়ে আমার দিকে তাকালেন। জিজ্ঞেস করলেন, প্রথম আলোতে আমি কত দিন? বললাম, এক বছর প্রায়। এবার, কেন সম্ভব না, তা জিজ্ঞাসা না করে প্রথম আলোর অর্জনের ইতিহাস থেকে প্রশ্ন করতে শুরু করলেন। আমি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। যেন কানের মধ্যে বাজছে ঝিঁঝি পোকার শব্দ আর বুকের মধ্যে চলছে ফাঁপরের হাওয়া। মনে হতে লাগল, আমি যেন সেধে বিপদে পড়ার চ্যালেঞ্জ নিয়ে ফেলেছি! পরিস্থিতি অনুধাবন করে পরবর্তী বেশির ভাগ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চুপচাপ থাকলাম। শুধু পরিবেশ অনুকূলে আনতে দুই-তিনবার সরি বললাম। কিন্তু তিনি যেন তা শুনতেই পেলেন না।
কিছুক্ষণ পরে তিনি মিটিং থেকেই বের হয়ে গেলেন। তাঁর প্রয়োজনে, নাকি আমার ওপর রেগে মিটিং ত্যাগ করলেন, তা ঠিক বুঝতে পারলাম না। তবে কেন জানি মনে হতে লাগল, আমার কথায় রাগ করেই তিনি চলে গেলেন। মনে মনে এটা ভেবে এবার ভীষণ লজ্জায় পড়ে গেলাম। মনে হচ্ছিল, ‘চিচিং ফাঁক’ বলে কোনো জাদুকরি দরজা খোলার ক্ষমতা পেলে সে দরজা পেরিয়ে এখান থেকে পালিয়ে যাই এক্ষুনি!
খেতে খেতে তিনি শান্ত কণ্ঠে বললেন, ‘তুমি তখন আমার কথার দ্বিমত করলা, তোমার তো অনেক স্পর্ধা।’ বলেই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললেন।
মিটিং যথারীতি এগোচ্ছে। পূর্বনির্ধারিত এজেন্ডা ধরে আলাপ চলছে, সিদ্ধান্ত আসছে, পরিকল্পনা হচ্ছে...। কিন্তু আমার মনের অবস্থা তখন এতটাই বেগতিক, ভরা মিটিংয়ে উপস্থিত থেকেও আমি যেন কিছুই শুনতে পারছি না, কিছুই বুঝতে পারছি না। সংবিৎ ফিরল যখন ব্যবস্থাপনা সম্পাদক স্যার আমার নাম ধরে ডাকলেন। জানতে চাইলেন, তখন কেন আমার মনে হয়েছে নওগাঁয় এভাবে প্রত্যাশিত ফলাফল অর্জন সম্ভব হবে না? প্রথমে কোনো কিছুই বলতে চাইলাম না। পরে অনেকটা বাধ্য হয়ে কারণগুলো তথ্যসহ বর্ণনা করলাম এবং আমার যুক্তিগুলো বললাম। এ–ও বললাম, নওগাঁ শুধু আমার কর্ম এলাকার অংশ না, নিজের জেলাও বটে। তাই নওগাঁ জেলা নিয়ে আমার একটা স্বচ্ছ ধারণা আছে। তথ্য ও যুক্তিগুলো শুনে উপস্থিত প্রায় সবাই আমার যুক্তিগুলোর পক্ষে সায় দিলেন। এবার নিজেকে কিছুটা হালকা অনুভব করতে লাগলাম। মিটিংয়ে মনোযোগ দিলাম।
মধ্যাহ্নভোজের বিরতির সময় এল। হঠাৎ দেখি সম্পাদক স্যারও আমাদের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজে যোগ দিতে এসেছেন। চেয়ারে বসেই তিনি আমার দিকে হাত নাড়িয়ে তাঁর কাছে যাওয়ার জন্য ইশারা করলেন। কাছে যেতেই তাঁর পাশের চেয়ারে বসতে বললেন। আমি ইতস্তত হয়ে না–সূচক কিছু একটা বললাম। এবার তিনি ধমকের সুরে বললেন। অগত্যা তাঁর পাশের চেয়ারে খেতে বসলাম। খেতে খেতে তিনি শান্ত কণ্ঠে বললেন, ‘তুমি তখন আমার কথার দ্বিমত করলা, তোমার তো অনেক স্পর্ধা।’ বলেই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললেন। মুহূর্তমাত্র ভ্যাবাচেকা খেয়ে পরক্ষণেই আমিও হেসে উঠলাম।
মধ্যাহ্নবিরতি শেষ, বিকেলের সেশন শুরু। বিকেল থেকে সন্ধ্যা, পুরো সময় সম্পাদক স্যার মিটিংয়ে উপস্থিত থাকলেন। বিকেলের চা–বিরতির পরে তিনি আমার দ্বিমতের কারণগুলো শুনলেন, যা আমি আগেই অন্যদের শুনিয়েছিলাম। এবার পরিকল্পনাটি ঠিক রেখে ফলাফলের লক্ষ্যমাত্রায় পরিবর্তন আনলেন। সন্ধ্যায় মিটিং শেষ হলো। বিদায় বেলায় কনফারেন্স রুম থেকে বেরোনোর সময় তিনি দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের টিমের সবার সঙ্গে একে একে হাত মেলালেন। আর আমার সঙ্গে হাত মেলানোর সময় হুট করেই আমার পিঠে বেশ জোরে একটা চাপড়ানি দিলেন। ওই মুহূর্তে অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো—পিঠে ব্যথার বদলে মনে ফুরফুরে ভাব অনুভব করলাম!
সেদিন প্রথম আলোর একজন নবীন কর্মী ছিলাম। আজ এক যুগ পেরিয়ে এসেছি। সেদিনের সেই টক ঝাল মিষ্টি অভিজ্ঞতা মনে সাহস জুগিয়েছে নিশ্চিত। তাই সুযোগ পেলেই ঊর্ধ্বতন কি অধীনের সঙ্গে, যৌক্তিক দ্বিমত করা এখন আমার সাধারণ ব্যাপার। স্বাচ্ছন্দ্যে ভাবতে পারি—‘বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়।’
মো. আখতারুজ্জামান সরকার: জেনারেল ম্যানেজার (বগুড়া), সার্কুলেশন সেলস