‘এ দিন আজি কোন্ ঘরে গো খুলে দিল দ্বার?/ আজি প্রাতে সূর্য ওঠা সফল হল কার?।’ আমরা জানি, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই এমন করে আমাদের কথা বলতে পারেন।
আজ থেকে ২৫ বছর আগের কথা। একটা নতুন কাগজের জন্য আমরা নাম খুঁজছিলাম। অনেক নামের ভিড়ে বন্ধু মফিদুল হক আর আবুল মোমেনের যৌথ প্রস্তাবিত ‘প্রথম আলো’ নামটিতে আমাদের দৃষ্টি আটকে গেল। প্রথম আলোর চরণধ্বনি যেন বেজে উঠল আমাদের মনে। অগ্রজ শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী প্রথম আলোর নামলিপিতে বসিয়ে দিলেন রশ্মিশোভিত এক লাল সূর্য।
আমাদের জীবনে খুলে গেল এক নতুন দ্বার। প্রতিদিন সকালে আমাদের দরজায় টোকা দিতে লাগল এক নতুন সূর্য। লাখ লাখ পাঠক এই সূর্যের আলোকে ভালোবেসে গ্রহণ করলেন। আজও তা অব্যাহত আছে।
২৫টা বছর চলে গেল। এর প্রতিটি দিন ছিল উদ্দীপনার, ভালোবাসার, লাখো পাঠকের সঙ্গে সংযোগের। প্রতিটি দিন ছিল স্বপ্নে ভরা। কত বাধা, কত বিপদ পেরিয়ে যাওয়ার আনন্দ। দেশের শ্রেষ্ঠ গুণী মানুষদের সঙ্গে পেলাম। কত কত নতুন স্বপ্ন দেখানো মানুষকে পেলাম। কত সাধারণ–অসাধারণ নারী ও পুরুষের সন্ধান পেলাম। কত বিস্ময়কর তাঁদের সফলতার জীবন। কতজনকে হারালাম, কত বন্ধুকে পেয়ে গেলাম চলার পথে। কত ভালোবাসা, কত সমালোচনা। এ সবই আমাদের এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা। আমরা এগিয়ে যেতে চেয়েছি দেশের মানুষের সঙ্গে একযোগে।
প্রিয় পাঠক, আজ হেমন্তের এই রোদঝলমলে সকালবেলায় আমাদের অভিবাদন ও শুভেচ্ছা নিন। রজতজয়ন্তীর এই আনন্দভরা দিনে আমরা সবার আগে আপনাদেরই স্মরণ করি। কারণ, প্রথম আলো আজকে যা কিছু পেরেছে, তার সবই আপনারা আমাদের গ্রহণ করেছেন বলেই। এই দিনে আপনারা আমাদের গভীর কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন।
সত্যে তথ্যে ২৫
১৯৯৮ সালের ৪ নভেম্বর—২৫ বছর আগের এই দিনে, প্রথম আলো আপনাদের সামনে বিনীতভাবে হাজির হয়েছিল। আমাদের লক্ষ্য ছিল অনেক বড়। প্রথম আলো হবে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ এবং আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী একটি কাগজ। এর সাংবাদিকতা হবে তথ্যনির্ভর ও বস্তুনিষ্ঠ, পরিবেশনা হবে আধুনিক ও রুচিশীল। নতুনত্ব ও সৃজনশীলতাকে বরণ করে নিতে থাকবে উৎসুক। আমাদের বিশ্বাস ছিল, এসব যদি করা যায়, তাহলেই এটি হবে বাংলাদেশের সবচেয়ে পাঠকনন্দিত কাগজ। কারণ, পাঠক পক্ষপাত চান না, চান নিরপেক্ষতা, চান নির্ভুল খবর। এমনকি কোনো রাজনৈতিক দলের অনুগত কর্মীও সঠিক খবর ও বিশ্লেষণ জানার জন্য নিরপেক্ষ ও পেশাদার সংবাদমাধ্যমের ওপরই নির্ভর করেন। আর আমাদের সংকল্প ছিল—সৎ, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমরা সহযাত্রী হব বাংলাদেশের এগিয়ে চলার। কারণ, পেশাদারি সাংবাদিকতাই গণতন্ত্রকে অর্থপূর্ণ করে, মানুষের অধিকার রক্ষা করে, অন্যায় রুখে দেয়, অব্যবস্থার অবসান ঘটায়, বৈষম্য দূর করে, দুর্নীতি রোধে ভূমিকা রাখে। অসাম্প্রদায়িক, ভেদাভেদহীন, বৈষম্যমুক্ত, নিপীড়নমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে তুলতে বিশ্বজুড়ে স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা স্বীকৃত।
প্রথম আলো দেশের সর্বাধিক প্রচারিত কাগজ হয়ে ওঠে প্রকাশের চার বছরের মধ্যে। প্রকাশের সূচনা থেকেই পত্রিকার পাশাপাশি প্রথম আলো অনলাইনেও হাজির ছিল। কনটেন্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (সিএমএস) বা আধেয় ব্যবস্থাপনা প্রণালিভিত্তিক অনলাইনে প্রথম আলোর নতুন যাত্রা শুরু হয় ২০১১ সালে। প্রথম আলো ডটকম এখন সারা বিশ্বের এক নম্বর বাংলা ওয়েবসাইট। প্রথম আলোর ফেসবুক পেজে অনুসারীর সংখ্যা বাংলাদেশে শীর্ষতম। বিশ্বজুড়ে প্রথম আলো এখন অন্যতম বৃহত্তম বাংলা সংবাদমাধ্যম। পাঠকদের এই বিপুল আস্থা আমাদের একদিকে যেমন আবেগাপ্লুত করে, একই সঙ্গে আমাদের দায়িত্বের কথাও মনে করিয়ে দেয়।
আমরা সব সময় আপনাদের এই আস্থা ও ভালোবাসার মর্যাদা রাখার জন্য সচেষ্ট থাকি। শত চাপের মুখেও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা ধরে রাখতে চাই। সচেতন থাকি যেন স্বাধীন অবস্থান থেকে কোনো চাপে বা প্রলোভনে কখনোই সরে না যাই। সত্য তথ্য—এই হলো আমাদের পাথেয়। আধুনিকতা আর অগ্রসরমাণতা—এই হলো আমাদের উজ্জীবনী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদের পথনির্দেশিকা; সুসাংবাদিকতা আমাদের ব্রত, সততা আমাদের দৃঢ়তার উত্স। আমাদের পত্রিকা প্রকাশ থেকে শুরু করে ম্যাগাজিন ও বই প্রকাশ—যা শুরু যা করি, সবকিছুর পেছনে এই প্রেরণাই সব সময় জাগরূক থাকে।
প্রতিকূল সময়ে গণমাধ্যম
আজকের দিনে সাংবাদিকতা সারা বিশ্বেই কঠিন হয়ে পড়েছে। গণতন্ত্র আজ দেশে দেশে হুমকির মুখে। সাংবাদিকতার ওপর শাসকগোষ্ঠী ও প্রভাবশালী মহলের চাপ বাড়ছে। বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়। প্রথম আলোকেও অনেক বাধা ও ভয়ভীতিকে অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যেতে হয়েছে। প্রযুক্তি ও পাঠাভ্যাসের মাধ্যমও বদলে যাচ্ছে। নাগরিকের হাতে হাতে এখন স্মার্টফোন। যেকোনো কিছু ‘লাইভ’ প্রচার করে মানুষের কাছে তা পৌঁছে যাওয়ার ক্ষমতা টেলিভিশনকেন্দ্রের চেয়ে তার কম নয়। তথ্য যাচাই-বাছাই না করেই যে কেউ অনলাইনে খবর প্রকাশ করে দিতে পারেন।
এ সময়ে সাংবাদিকতা সত্যিই কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। বাস্তবতা হলো, এখনই আবার বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করার সবচেয়ে বড় সময়। গণতন্ত্র যখন প্রতিকূলতার মুখে; বাক্স্বাধীনতাকে বেড়ি পরানোর জন্য চেষ্টা চলছে। যখন ‘ফেক নিউজ’, গুজব, নকল খবর আর পোস্টের ভিড়ে ‘সত্য’ খুঁজে ফেরা দুঃসাধ্য, তখনই যথার্থ খবরের চাহিদা সবচেয়ে বেশি, তখনই সাংবাদিকতা করার ভালো সময়।
পাঠকেরা আমাদের বলে থাকেন, কোনো চাঞ্চল্যকর খবর প্রচারিত হতে শুরু করলে তার সত্যতা যাচাই করার জন্য ছুটে আসেন প্রথম আলো ডটকমে, এরপর প্রথম আলোর ছাপা কাগজে। প্রথম আলোর খবরের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে তবেই তাঁরা আস্থা পান। এখানেই আমাদের শক্তি। এই আস্থা আমরা কেবল ধরে রাখব না, আরও সংহত করব—এই আমাদের প্রচেষ্টা। দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রযুক্তির সঙ্গে আমরা কেবল মিলে চলব না, আমরা প্রযুক্তির সব সুবিধা গ্রহণ করব; মানুষকে সঠিক তথ্য–বিশ্লেষণ এবং এগিয়ে যাওয়ার মন্ত্রণা দেওয়ার জন্য নতুন প্রযুক্তিকে কাজে লাগাব।
সংবাদপত্রের চেয়ে একটু বেশি
আমরা বলি, প্রথম আলো সংবাদপত্রের চেয়ে একটু বেশি। সংবাদমাধ্যম হিসেবে যেমন প্রথম আলো উৎকর্ষের উচ্চতর লক্ষ্যে পৌঁছানোর সাধনা করবে, তেমনি তার সামাজিক কর্মকাণ্ড, মানবিক কার্যক্রম, তরুণদের মেধাবিকাশের নানা আয়োজনও অব্যাহত রাখবে। শিল্প-সাহিত্য-বিনোদন-ক্রীড়া-শিক্ষা-সংস্কৃতি-মানব উন্নয়নের নানা ক্ষেত্রে কর্মসূচি, অনুষ্ঠান, অলিম্পিয়াড, পুরস্কার, উদ্যোগগুলোকে আরও অর্থপূর্ণ করার চেষ্টা করবে। এসব কাজে আমাদের অনেক অনেক সুহৃদ ও গুণীজন আমাদের পাশে থাকেন সব সময়। তাঁদের প্রতি আমরা সব সময় কৃতজ্ঞ থাকব।
কত দূর এগোল বাংলাদেশ
সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রকে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনা হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার সংকল্প, স্বপ্ন ও প্রক্রিয়ার মধ্যে আমরা ছিলাম। আমরা চাই, এ দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হবে না, বাক্স্বাধীনতা হবে নিরঙ্কুশ, গণমাধ্যম ভোগ করবে অপার স্বাধীনতা, নির্বাচনব্যবস্থা থাকবে কার্যকর। সমাজে সাম্প্রদায়িকতা, বৈষম্য ও হানাহানি থাকবে না। দেশ হবে দুর্নীতিমুক্ত। থাকবে আইনের শাসন।
নারী–পুরুষ বৈষম্য থাকবে না, বৈষম্য থাকবে না হিন্দু–মুসলিম–বৌদ্ধ–খ্রিষ্টান–বাঙালি-অবাঙালিতে। আইন কিংবা সম্পদ, মর্যাদা কিংবা অধিকার শুধু একটি গোষ্ঠীর হয়ে থাকবে না, হবে সবার।
তবু হারবে না বাংলাদেশ
আমরা জানি, আমাদের আছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সম্পদের অপ্রতুলতা, রাজনীতিতে আছে সংকট। সুশাসন সুদূরপরাহত। পৃথিবীর নানা প্রান্তে যুদ্ধ। অর্থনীতিতে সুসংবাদ সুদূরে। এর মধ্যেও কি বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে না? জীবনযাত্রার মান বেড়েছে, বেড়েছে গড় আয়ু। কমেছে শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃত্যু। বেড়েছে শিক্ষার হার, প্রযুক্তির ব্যবহার। যোগাযোগ হয়েছে উন্নত। করোনাকালের কঠিন পরিস্থিতি আমরা পার হয়েছি সফলতার সঙ্গে।
এসব সম্ভব করে তুলেছেন বাংলাদেশের সৃজনশীল, উদ্যমী, পরিশ্রমী মানুষ; তারুণ্যের শক্তিতে বলীয়ান জনগোষ্ঠী। তাঁরা উদয়াস্ত পরিশ্রম করেন, হাড়ভাঙা শ্রমে মাঠে ফলান সোনার ফসল, প্রবাসী আয় আনেন, তৈরি পোশাক রপ্তানিতে দেশকে নিয়ে যান শীর্ষে। তাঁরা সাহসী ও উদ্যোগী। নতুন প্রযুক্তি, নতুন ধারণা, নতুন সৃষ্টিশীলতা বরণ করে নিতে তাঁরা উন্মুখ। তাঁরাই আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস।
সব সময় সেই হার না–মানা মানুষদেরই পাশে থাকে প্রথম আলো। তাঁদের দুঃখ–কষ্ট–বেদনার কথা তুলে ধরে। প্রকাশ করে তাঁদের সংগ্রাম আর বিজয়ের গাথা।
কোনো জাতি সামনে এগিয়ে যেতে পারে তখনই, যখন তার সামনে থাকে আশা, দুই চোখে থাকে স্বপ্ন। মানুষের এই সংগ্রাম আর বিজয়ে প্রথম আলো বাংলাদেশের সেই স্বপ্ন আর আশার সন্ধান পায়। প্রথম আলো বিশ্বাস করে, বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রাম শেষ পর্যন্ত জয়ী হবেই।
আমরা বাংলাদেশের জয় দেখতে চাই। এটাই প্রথম আলোর একমাত্র লক্ষ্য।
প্রথম আলো তার রজতজয়ন্তীতে বাংলাদেশের হার না–মানা এসব মানুষের ব্যক্তি ও সম্মিলিত সংগ্রামকে জানায় অভিবাদন। আমরা জানি, সব বিরূপ বাস্তবতা একসময় পেরিয়ে যেতে পারব। সে জন্য আমরা দৃঢ় কণ্ঠে বলি, হারবে না বাংলাদেশ।