কর্মীর লেখা:
সেই রাতে ২০০ ফুট লম্বা দড়ির জন্য ছটফট করেছিলাম
প্রথম আলোর ২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কর্মীদের কাছে লেখা আহ্বান করা হয়েছিল। তাঁরা লিখেছেন প্রথম আলোকে নিয়েই। কর্মীদের নির্বাচিত কিছু লেখা নিয়েই এ আয়োজন।
রাত আড়াইটা কিংবা তিনটা বাজে। এরই মধ্যে প্রথম আলোর ১২ তলা নিউজ রুমের রাতের কারিগরেরা একে একে সবাই চলে গেছেন। নিউজ রুমে সুনসান নীরবতা। বিশাল বাংলা ডেস্কে আমার মাথার ওপরে শুধু দুটি লাইট জ্বলছে। বাকি সব লাইট নিভিয়ে দিয়ে গেছেন রাতের পালার দায়িত্বরত নিরাপত্তাকর্মী।
নাইট ডিউটিতে এসে ডেস্কে বসে কাজ করছিলাম। কনটেন্ট আপলোডের একজন কর্মী আছেন ১১ তলায়। গোটা ১২ তলায় শুধু একটি প্রাণী, আর সেটা আমি। যেন ভুতুড়ে পরিবেশ। এমন সময় হঠাৎ ফায়ার অ্যালার্ম বেজে উঠল। আমি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়লাম। চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে উঠে দৌড়ে দরজার সামনে গেলাম। দেখি অন্ধকার। ভয় আরও বেড়ে গেল।
এদিকে ফায়ার অ্যালার্ম বেজেই চলছে। আর স্বয়ংক্রিয় নারীকণ্ঠে বারবার কক্ষ ত্যাগ করার জন্য তাগাদা দেওয়া হচ্ছে। এর আগে যতবার ফায়ার অ্যালার্মের মুখোমুখি হয়েছি, সেটা ছিল দিনের বেলা। তখন নিউজ রুম ভর্তি সহকর্মীরা ছিলেন। বেশ কয়েকবার দলবল নিয়ে ভবন থেকে সিঁড়ি দিয়ে নিচেও নেমেছি। সে সময় এতটা ভয় করেনি।
এই নিশীথ রাতে ফায়ার অ্যালার্মে আমি একা হতবিহ্বল। বারবার মনকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছি, আর নিজেকে শান্ত রাখার উপায় খুঁজছি। যন্ত্রিক কোনো ত্রুটির কারণেই হয়তো অ্যালার্ম বাজছে, এটা মনকে বোঝানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু মনকে কোনোভাবেই মানাতে পাচ্ছি না, আবার ঘুটঘুটে অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে নিজেকে নিচের দিকে নামাতেও পারচ্ছি না। তবে কি পুড়ে মরার মুখোমুখি আমি...!
মুহূর্তের মধ্যে মন-মগজে ঢাকার বনানীর এফ আর টাওয়ারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের বীভৎস দৃশ্য ভেসে উঠল। প্রাণে বাঁচতে মানুষ ভবনটির ছাদ থেকে লাফ দিয়েছিল। কেউ কেউ বিদ্যুৎ ও ডিশ লাইনে তার বেয়ে নামার চেষ্টা করেছিল। সেখানে বীভৎস মৃত্যুর দৃশ্য আমাকে তাড়িত করতে লাগল। আমি ছটফট করছিলাম, আর লম্বা একটি দড়ির ভীষণ প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিলাম, যে দড়ি বেয়ে নিচে নেমে প্রাণ বাঁচানো যাবে।
কেবলই মনে পড়ছে প্রগতির এই ভবন ১৬ তলা। এর উচ্চতা প্রায় ১৬ * ১০ = ১৬০ ফুট। সব মিলিয়ে এই মুহূর্তে আমার কাছে ২০০ ফুট লম্বা মোটা দড়ি প্রয়োজন। তা ছাড়া বাঁচার কোনো পথ নেই। হন্তদন্ত হয়ে নিজের ডেস্কে চলে এলাম। অস্থিরতা কমিয়ে নিচতলার রিসেপশনের ৩৩৩৩ নম্বরে কল করে জানতে চাইলাম, ‘ভাই, কী হয়েছে?’ ১২ তলায় ফায়ার অ্যালার্ম বাজছে কেন? বিস্ময় প্রকাশ করে একজন বললেন, এত রাতে ফায়ার অ্যালার্ম...! কই তিনি তো কিছু বুঝতে পাচ্ছেন না। ‘দেখছি’ বলে ফোনের লাইন কেটে দেওয়া হলো।
আমার মস্তিষ্ক আবার অস্থির হয়ে উঠল। একা একটা মানুষের এই মুহূর্তে কী করার থাকে? কীই–বা করার আছে? এমন ভাবতেই আবার দৌড়ে দরজার কাছে এলাম ১১ তলায় যাওয়ার জন্য। সেখানে আপলোডের একজন আছেন। দুজন একসঙ্গে হলে সাহস পাওয়া যাবে। যৌথ প্রযোজনায় বাঁচার চেষ্টা করা যাবে। দরজার সামনে এসে ঘুটঘুটে অন্ধকার দেখে আবার থেমে গেলাম।
মনে হলো, ১১ তলার লোকটাও তো আমার এখানে ছুটে আসতে পারে। সেই ব্যাটা কেন আসছে না? হতাশ হয়ে এবার আল্লাহ ভরসা বলে ডেস্কে গিয়ে বসে পড়লাম। ফায়ার অ্যালার্ম বাজা বন্ধ হলো। দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আবার ৩৩৩৩ নম্বরে কল করে বললাম, কী অবস্থা? সেখান থেকে বলা হলো, কোথাও কোনো আগুন লাগেনি। এ কথা শুনে অস্বস্তি কমতে লাগল।
২০২০ সালে ইন্টিগ্রেটেড নিউজ রুম চালু হওয়ার কিছুদিন পরেই একদিন নাইট ডিউটিতে এসে এমন ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলাম। এখনো ফায়ার অ্যালার্ম বেজে উঠলে আমার সেই রাতের কথা মনে পড়ে। আর ২০০ ফুট লম্বা মোটা দড়ির প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। দড়ির বিষয়টি কর্তৃপক্ষ এখনো ভেবে দেখতে পারে। খুব বেশি তো নয়, মাত্র ২০০ ফুট লম্বা মোটা দড়ি। নিদানকালে কিংবা সত্যি যদি কোনো দিন অগ্নিকাণ্ডে ভবনের ভেতরে আটকা পড়ে যাই, সেদিন কিন্তু এই দড়ি অনেকের প্রাণ বাঁচাতে পারবে।
মো. তৌহিদুল ইসলাম, সহসম্পাদক, বিশাল বাংলা