যে কারণে শেখ হাসিনার ছবি নামিয়েছিলাম

শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি সংহতি জানিয়ে মুখে লাল কাপড় বেঁধে ‘নিপীড়নের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’–এর ব্যানারে শিক্ষকেরা। ৩০ জুলাই ২০২৪ছবি: শামসুজ্জামান

স্বৈরাচার শেখ হাসিনার ছবি যেদিন আমার অফিস কক্ষের দেয়াল থেকে নামিয়ে ফেললাম, চারদিকে তখন গ্রেপ্তারের তাণ্ডব। সারা দেশে শহীদ হয়েছেন অনেকেই। একজন শিক্ষক হিসেবে, মা হিসেবে সেদিন আমার মনে হয়েছিল, এই গণহত্যাকারীর ছবি মাথার ওপরে থাকা মানে শহীদদের অপমান। আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা তো সেই ১৪-১৫ জুলাই থেকেই চরম অপমানের গ্লানি বয়ে বেড়াচ্ছিলাম।

১৬ জুলাই উত্তাল হলো ক্যাম্পাস। সকালেই মুখে লাল কাপড় বেঁধে প্রশাসন ভবনে উপস্থিত হলাম। এক শর মতো শিক্ষক। ঘটনার বিচার চাইলাম আমরা। কিন্তু দায়সারা গোছের গতানুগতিক কথা বলে পার পেতে চাইল প্রশাসন। এদিন সকালেই ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের ক্যাম্পাস ছাড়া করল শিক্ষার্থীরা।

রাতগুলো, দিনগুলো

১৫ জুলাই মধ্যরাত। তৎকালীন উপাচার্যের বাসভবনে আশ্রয় নেওয়া আন্দোলনকারীদের ওপর আওয়ামী লীগের পেটোয়া বাহিনী, ভাড়াটে সন্ত্রাসী ও পুলিশ একযোগে হামলা চালায়। আহত হন অনেক শিক্ষার্থী ও শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের উপস্থিতিতে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা জাহাঙ্গীরনগরের ইতিহাসে আর ঘটেনি।

১৬ জুলাই উত্তাল হলো ক্যাম্পাস। সকালেই মুখে লাল কাপড় বেঁধে প্রশাসন ভবনে উপস্থিত হলাম। এক শর মতো শিক্ষক। ঘটনার বিচার চাইলাম আমরা। কিন্তু দায়সারা গোছের গতানুগতিক কথা বলে পার পেতে চাইল প্রশাসন। এদিন সকালেই ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের ক্যাম্পাস ছাড়া করল শিক্ষার্থীরা।

এই পরিস্থিতিতে তড়িঘড়ি করে বিশ্ববিদ্যালয় ও হল বন্ধ ঘোষণা করল প্রশাসন। আমরা বেশ কয়েকজন শিক্ষক সারা দিন প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান করলাম, বিচারের আরজি জানিয়ে বক্তৃতা দিলাম। এদিকে হল বন্ধ হলেও শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ ক্যাম্পাস ছাড়ল না, আশপাশের গেরুয়া, আমবাগান, ইসলামনগর, পানধোয়া প্রভৃতি গ্রামে অবস্থান নিল। এর মধ্যে রংপুরে আবু সাঈদ শহীদ হয়েছে। তার আত্মবিশ্বাসী বুকটাকে বুলেটে ঝাঁঝরা করে দেওয়ার দৃশ্য নাড়া দিয়েছে প্রত্যেক বিবেকবান মানুষকে।

শামীমা সুলতানা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক

১৭ জুলাই আবারও প্রশাসন ভবনে গেলাম। সাত-আটজন শিক্ষক মিলে দেখা করতে চাইলাম উপাচার্যের সঙ্গে। কিন্তু দেখা করতে দেওয়া হলো না। এ সময় শিক্ষার্থীরা ক্রমে ক্রমে প্রশাসন ভবনের সামনে জড়ো হতে থাকলে প্রশাসন থেকে তাদের হুমকি দেওয়া হলো। বলা হলো, বিকেল চারটার মধ্যে সরে না গেলে আক্রমণ করা হবে। তবু কেউ সরেনি। তারা দেখা করতে চাইল প্রশাসনের সঙ্গে। প্রশাসন দেখা তো করলই না; বরং বিকেল পাঁচটার দিকে পুলিশ দিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর আবারও নির্যাতন-হামলা চালানো হলো। সে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি।

আতঙ্কে ১৭ তারিখে আর বাসায় যেতে পারিনি। পুলিশকে কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে দেখছি, গুলির শব্দ শুনছি। শিক্ষার্থীরা তখন এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে। পরিচিত বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে যোগাযোগ করে আমার বিভাগে চলে আসতে বললাম। দৌড়ে এসে তারা যেন অন্তত বাংলা বিভাগে আশ্রয় নিতে পারে, তাই খোলা রাখলাম অফিস ও সেমিনার কক্ষ। ততক্ষণে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে মুঠোফোনের ইন্টারনেট। তাই যারা আশ্রয় নিয়েছিল, তাদের বিভাগের ওয়াই-ফাইয়ের পাসওয়ার্ড দিলাম।

এদিন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলেন। সবাই আশা করেছিল, হয়তো তিনি আশাজাগানিয়া বক্তব্য দেবেন, কিন্তু জাতি তাঁর বক্তব্য শুনে হতাশ। একই দিনে ক্যাম্পাসের আশপাশে আশ্রয় নেওয়া শিক্ষার্থীদের পুলিশ আর সন্ত্রাসী বাহিনী যৌথভাবে ধরপাকড় করতে থাকে। আমরা কয়েকজন শিক্ষক তাদের ছাড়িয়ে আনতে চেষ্টা করি। শিক্ষার্থীরা যাতে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকে, সে জন্য কথা বলি গ্রামবাসীর সঙ্গে।

সহিংসতার বিরুদ্ধে

১৮ জুলাই সারা দেশের সহিংসতার বিরুদ্ধে আমরা কয়েকজন জাহাঙ্গীরনগরের শহীদ মিনারে মোমবাতি হাতে দাঁড়াই। এর মধ্যে শুরু হয়েছে কারফিউ, হেলিকপ্টার থেকে গুলি, এলাকা ভাগ করে ব্লক রেইড, গ্রেপ্তার আর হত্যার উৎসব।

দিনকয়েক বাদে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ ছয়জন সমন্বয়ককে ধরে নিয়ে গেল; নিয়ে গেল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক আরিফ সোহেলকেও। বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের পাদদেশে দাঁড়িয়ে তাদের মুক্তি দাবি করি আমরা। মানসিক-শারীরিক নির্যাতনের মাধ্যমে সমন্বয়কদের যখন বিবৃতি দিতে বাধ্য করা হয়, বুঝতে পারি, এটা সাজানো নাটক। এর প্রতিবাদে আবার মিছিলে নামলাম, ক্যাম্পাসের চারপাশে থাকা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সেদিন আমরা ছিলাম মাত্র চারজন শিক্ষক।

দিনকয়েক বাদে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ ছয়জন সমন্বয়ককে ধরে নিয়ে গেল; নিয়ে গেল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক আরিফ সোহেলকেও। বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের পাদদেশে দাঁড়িয়ে তাদের মুক্তি দাবি করি আমরা।

ছবি নামানোর সেই ক্ষণ

১ আগস্টেও ক্যাম্পাসে র্যালি হয়। শহীদ মিনারের পাদদেশে জাতীয় সংগীত গাওয়া শেষে দেশের গান গাইতে গাইতে ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করি আমরা। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শহীদের উদ্দেশে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভে গিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করি। এ সময় আমার যেন কী হলো। আবু সাঈদ, মুগ্ধ, ফাইয়াজ, ফরহাদ হোসেন, দীপ্ত দে, রুদ্র সেন, ওয়াসিমসহ নাম-না জানা শহীদদের মনে পড়ল। চোখে ভাসল সন্তানহারা মায়ের আহাজারি। ভাবলাম, যিনি এই মায়েদের বুক খালি করার নির্দেশদাতা, যাঁর হাতে এত রক্তের দাগ, তাঁর আর দেয়ালে থাকার অধিকার নেই। পাশাপাশি মনে হলো, এখন এমন কিছু করা দরকার, যাতে আন্দোলনকারীরা উদ্বুদ্ধ হয়। আবার স্বৈরশাসকের গদিতেও টান পড়ে।

এসব চিন্তা থেকে অফিসে এসে শেখ হাসিনার ছবিটা নামালাম। ছবি নামানোর সে দৃশ্য আমি ফেসবুকে শেয়ার করি।

এরপর ইতিহাস। বিভাগ থেকে বাসায় যেতে যেতে ছবিটি অজস্র শেয়ার হয়।

এ সময় আমার সন্তান, শিক্ষার্থীরা আমাকে যেমন অভিবাদন জানিয়েছে, তেমনি স্বৈরাচারের দোসররা নানাভাবে হয়রানি করার চেষ্টা করেছে। ‘বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদ’ থেকে আমার শাস্তি চেয়ে লিফলেট বিলি করা হয়। সাংবাদিকদের মারফত শুনেছিলাম, জরুরি সিন্ডিকেট ডেকে আমাকে শোকজ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যদিও শোকজের চিঠি পাইনি।

৪ আগস্ট দেশে প্রায় দেড় শ মানুষ শহীদ হন। ৬ আগস্টের লংমার্চ ৫ আগস্ট এগিয়ে আনা হয়। ৪ তারিখ সারা রাত ঘুমাতে পারিনি; দোয়া পড়েছি, যেন বড় কোনো হত্যাযজ্ঞ না ঘটে।

লংমার্চ টু ঢাকা

৫ আগস্ট সকাল ১০টার দিকে ‘লংমার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে জাহাঙ্গীরনগর থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিই, আটজন শিক্ষকের মধ্যে আমি একমাত্র নারী শিক্ষক। সঙ্গে জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষার্থীসহ আশপাশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী আর শ্রমিকও আছেন।

আমরা এগোতে থাকি। সাভার সিটি সেন্টারের কাছে পৌঁছালে পুলিশ বাধা দেয়। তখন সমন্বয়ক ও শিক্ষকেরা মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে আমি মিছিলের তত্ত্বাবধান করব এবং আমাদের মধ্য থেকে সাতজন পুলিশের কাছে গিয়ে কথা বলবে।

হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার দিনেও তাঁর লোকেরা সাভার এলাকায় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। সেদিন সাভারে শ্রাবণ, আলিফ, সাফুয়ানসহ অনেককে হত্যা করা হয়। তাই বিজয়ের দিনেও আমার চোখ খুশিতে উচ্ছল হতে পারেনি।

কিন্তু বিধি বাম! শিক্ষকেরা হাত উঁচু করে পুলিশের দিকে অগ্রসর হলে সমন্বয়কেরা পুলিশের উদ্দেশে বলতে থাকে, ‘ওনারা আমাদের শিক্ষক, আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে চান।’ শিক্ষকেরা যখন পুলিশের কাছাকাছি, তখন কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে তাঁদের দিকে কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়তে থাকে পুলিশ। মিছিলেও কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই আমরা। এদিকে সিটি সেন্টারের ওপর থেকে কারা যেন গুলি ছুড়ছিল। কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়ায় আমি চোখে কিছু দেখতে পারছিলাম না, নিশ্বাস আটকে আসছিল, ছোটাছুটি করতে গিয়ে পায়ে ব্যথা পাই। এমন সময় দেখতে পেলাম, আমি একা হয়ে গিয়েছি এবং পাশ দিয়ে গুলি যাচ্ছে। ভীষণ আতঙ্কিত হলাম। এর মধ্যে দুই শিক্ষার্থী এসে আমার মুখে পেস্ট দিয়ে দিল, টিস্যু পেপারে আগুন ধরিয়ে মুখের কাছে নিয়ে এল।

খুব কষ্টে সড়ক বিভাজক পার হয়ে রাজ্জাক প্লাজার পাশে এক সহকর্মীর দেখা পেয়ে একটু আশ্বস্ত হলাম। অন্য সহকর্মীরাও খোঁজ নিচ্ছিলেন। তখনো কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়া আর গোলাগুলি চলছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মকর্তা এবং নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের এক শিক্ষক দ্রুত আমার কাছে এসে বললেন, ‘ওড়না দিয়ে মাথাটা ঢাকেন।’ পরে অটোরিকশায় গ্রামের মধ্য দিয়ে তাঁরাই আমাকে ক্যাম্পাসে নিয়ে এলেন। অসুস্থ হয়ে পড়ায় ঢাকায় আর যেতে পারিনি।

হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার দিনেও তাঁর লোকেরা সাভার এলাকায় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। সেদিন সাভারে শ্রাবণ, আলিফ, সাফুয়ানসহ অনেককে হত্যা করা হয়। তাই বিজয়ের দিনেও আমার চোখ খুশিতে উচ্ছল হতে পারেনি।

* শামীমা সুলতানা: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়