কৈশোরে কলকাতা ছেড়ে বছরখানেক সিলেটে ছিলেন আবু সয়ীদ আইয়ুব। প্রয়াত এই রবীন্দ্র-গবেষক ও সাহিত্য সমালোচকের ভগ্নিপতি তখন সিলেট আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ। সে সুবাদে ওই মাদ্রাসায় সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তিও হয়েছিলেন তিনি।
আইয়ুব ছাড়াও এমন অনেকেই এখানে পড়াশোনা করেছেন, পরে দেশ-বিদেশে নিজ কর্মগুণে যাঁরা ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছেন। এ রকম প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মধ্যে আছেন বাংলাদেশের সাবেক স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, রাজনীতিবিদ দেওয়ান তৈমুর রাজা চৌধুরী। আর আলেম-ওলামার তো কথাই নেই, অনেক ইসলামি চিন্তাবিদ এবং আলেম-ওলামা তৈরি করেছে সিলেট আলিয়া মাদ্রাসা। ১৯১৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১০৯ বছর ধরে শিক্ষা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে এ মাদ্রাসা।
সিলেট নগরের চৌহাট্টা এলাকায় ৭ দশমিক ১৭ একর জায়গাজুড়ে সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা। প্রায় তিন হাজার শিক্ষার্থী বর্তমানে এখানে পড়াশোনা করছেন। শিক্ষক আছেন ৩১ জন। একটা সময় ইবতেদায়ি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান কার্যক্রম চালু থাকলেও এখন নবম শ্রেণি থেকে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়ে থাকে। বর্তমানে এখানে দাখিল, আলিম, ফাজিল ও কামিল পর্যায়ে পাঠদান করা হয়। এখানে চালু আছে আল কোরআন অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ, আল হাদিস অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ, দাওয়াহ্ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ এবং আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর কোর্স।
১৯৮৭ সালে মাদ্রাসার বার্ষিকী ‘সোপান’-এ হেলাল উদ্দিন আহমদ নামের এক শিক্ষার্থীর লেখায় মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার ইতিহাস খানিকটা পাওয়া যায়। ‘সিলেট আলিয়া মাদ্রাসা: অতীত ও বর্তমান প্রেক্ষাপট’ শীর্ষক ওই লেখায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের ভূখণ্ডে সরকারি ভিত্তিতে কোনো আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার দিক থেকে এটিই প্রাচীনতম...বিশ শতকের গোড়ার দিকে সিলেট শহরের নাইওরপুল এলাকায় আনজুমানে ইসলামিয়া নামে একটি খুদে বেসরকারি মাদ্রাসা ছিল। তৎকালীন আসাম সরকারের শিক্ষামন্ত্রী খানবাহাদুর আবদুল মজিদ ওরফে কাপ্তান মিয়া এ মাদ্রাসা সম্প্রসারণ ও সরকারীকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এ সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ১৯১৩ সালে ইবতেদায়ি ক্লাস, জুনিয়র সেকশনসহ সরকারিভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা।’
মাদ্রাসার শিক্ষক পরিষদের সম্পাদক ফজলুর রহমান চৌধুরী জানান, মাদ্রাসায় ছয়টি ভবন রয়েছে। এর মধ্যে দুটি অনেক প্রাচীন। সিলেটের নিজস্ব স্থাপত্যরীতি ‘আসাম-আদলে’ এগুলো নির্মিত। এখানে ৩৭ আসনের একটি ছাত্রাবাসও আছে। রয়েছে একটি মসজিদও। মাদ্রাসার কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে ১৬ হাজার এবং চারটি বিভাগীয় গ্রন্থাগারে ২ হাজার প্রাচীন ও নতুন বই আছে। ১৯৫৯ সাল থেকে নিয়মিত বিরতিতে এখান থেকে সিলেট গভর্নমেন্ট মাদ্রাসা ম্যাগাজিন নামে সাময়িকীও প্রকাশিত হয়ে আসছে। প্রতিটি পর্যায়ের পরীক্ষাতেই শিক্ষার্থীরা সাফল্যের পরিচয় রাখছেন। পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে প্রতিবছর গড়ে ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করছেন। মাদ্রাসার পাশেই প্রতিষ্ঠানের একটি বড় মাঠ রয়েছে। রাজনৈতিক সভা, সমাবেশ ছাড়াও মাঠে ধর্মীয়, ক্রীড়া, সামাজিক ও সরকারি নানা অনুষ্ঠান হয়ে থাকে।
শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি ভাষা আন্দোলনেও মাদ্রাসার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ১৯৪৭ সালের ৩০ নভেম্বর কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের উদ্যোগে মাদ্রাসার মিলনায়তনে এক আলোচনা সভা হয়। সেখানে সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ শীর্ষক দীর্ঘ প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তবে উর্দু সমর্থকদের বিশৃঙ্খলার কারণে সেদিন সভার কাজ নির্বিঘ্নে শেষ করা যায়নি। কিছুদিন পর প্রবন্ধটি আল-ইসলাহ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সে প্রবন্ধে বাংলা ভাষার দাবির পক্ষে যুক্তিপ্রমাণ দেন মুজতবা আলী এবং বাংলার পরিবর্তে রাষ্ট্রভাষা উর্দু হলে কী কী অসুবিধা হতে পারে, এর বিশদ ব্যাখ্যাও দেন। সবশেষে এ সিদ্ধান্তই জানান, একমাত্র মাতৃভাষা বাংলাই পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়ার যোগ্যতা রাখে।
১০০ বছর ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে ভালো ফল করে পথচলা সহজ ব্যাপার নয়। এ নিয়ে গর্বের কথা জানালেন মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মুহাম্মদ মাহমুদুল হাসান। প্রাচীন এ মাদ্রাসার সুবিদিত ঐতিহ্যের উল্লেখ করে অধ্যক্ষ বলেন, সিলেটের ইসলামি শিক্ষা বিস্তারে প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। শতবর্ষ ধরে আলোর রশ্মি ছড়িয়ে আসছে এ মাদ্রাসা।
লেখক:প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক, সিলেট