মূল্যস্ফীতি সঠিকভাবে বুঝতে অর্থনীতিতে টাকা কীভাবে কাজ করে, তা জানা জরুরি। আগে টাকার ভিত্তি ছিল সোনা, এখন অবশ্য তা নয়। অর্থনীতিতে যে বিপুল পরিমাণ টাকার সঞ্চালন আছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সে পরিমাণ সোনা নেই। সোনার পরিবর্তে সরকার টাকার মান নিশ্চিত করে, যেন প্রত্যেকে তাঁর হাতে থাকা টাকার সমপরিমাণ পণ্য অথবা সেবা পেতে পারেন। টাকার এই মূল্য মূলত মূল্যস্ফীতির সঙ্গে জড়িত।
ধরুন, আপনার অর্থনীতিতে মোট সম্পদের পরিমাণ দুটি সোনার কয়েন এবং তার ওপর ভিত্তি করে আপনি ১ টাকার দুটি নোট ছাপালেন। অর্থাৎ প্রতিটি ১ টাকার নোটের মূল্য একটি সোনার কয়েনের সমান। এখন যদি অর্থনীতিতে সোনার কয়েনের সংখ্যা না বাড়িয়ে আরও দুটি ১ টাকার নোট ছাপান, তাহলে আপনার অর্থনীতিতে চারটি ১ টাকার নোট দুটি সোনার কয়েনের প্রতিনিধিত্ব করবে। অতএব প্রতিটি ১ টাকার নোটের মূল্য কমে দাঁড়িয়েছে একটি সোনার কয়েনের অর্ধেক। সরকার অর্থনীতিতে পণ্য ও সেবা না বাড়িয়ে টাকা ছাপালে একইভাবে টাকার মূল্য কমে গিয়ে মূল্যস্ফীতি ঘটে। সরলভাবে বললে ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি বলতে বোঝায় যে পণ্য বা সেবার গত বছর ক্রয়মূল্য ছিল ১০০ টাকা, তা এখন ১১০ টাকা।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি বাড়তে শুরু করে ২০২২–এর দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে। সে বছরের আগস্টে তা পৌঁছায় সর্বোচ্চে (৯.৫২%)। তার পর থেকে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি থাকে। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় ১১.৬৬ শতাংশে, যা ২০১১ সালের পর সর্বোচ্চ। এই মূল্যস্ফীতির অনেকটাই আসে খাদ্যদ্রব্যের উচ্চ মূল্য থেকে। কারণ, একই সময় খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১৪.১ শতাংশ। অর্থবছর ২০২২-২৩–এ খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল খাদ্য মূল্যস্ফীতির ওপরে, কিন্তু ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এর পুরো বিপরীত চিত্র দেখা যায়। এই সময়জুড়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতির বেশ ওপরে থাকে এবং সাধারণ মূল্যস্ফীতিকে ওপরে ধরে রাখে।
সেপ্টেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি নিচের দিকে নামার প্রবণতা দেখা গেলেও এখনো তা ১০ শতাংশের কাছাকাছি রয়েছে।
এই একই সময়ে, অর্থবছর ২০২২-২৩ এবং ২০২৩-২৪–এ ধারাবাহিকভাবে মজুরি বেড়েছে ৭.০৪ শতাংশ এবং ৭.৫২ শতাংশ হারে, যা মূল্যস্ফীতির তুলনায় কম। বিষয়টিকে আরও প্রাসঙ্গিক করতে ঢাকা শহরে চার সদস্যের একটি পরিবার মাসিক ১৯ হাজার ৬৮৮ টাকা খরচ করলে তাকে দরিদ্র ধরা হয় না (এইচআইইএস ২০২২–এর দারিদ্র্যসীমা অনুযায়ী)। গত দুই অর্থবছরে এই পরিবারের মজুরি বেড়ে হয়েছে ২২ হাজার ৬৫৯ টাকা (মজুরি সূচক অনুযায়ী); কিন্তু দারিদ্র্যসীমার ওপরে থাকতে এই পরিবারের মজুরি বাড়তে হতো ২৩ হাজার ৫৫২ টাকা। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে এই পরিবার এখন দারিদ্র্যসীমার ৮৯৩ টাকা নিচে বসবাস করছে। অতএব, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে দারিদ্র্যসীমার ওপরে কিন্তু কাছাকাছি থাকা মানুষেরা আবার দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে আসতে পারে।
বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায়, মূল্যস্ফীতির পেছনে অন্যতম তিনটি প্রধান বিষয়কে দায়ী করা যায়: ১. কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি, ২. ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন এবং ৩. বাজারব্যবস্থার বিকৃতি।
বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২২-২৩ অর্থবছরে রেপো রেট এবং রিভার্স রেপো রেট দুই দফায় বাড়িয়ে নিজেদের মূল্যস্ফীতি কমানোর প্রচেষ্টা পরিষ্কার করে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও—গত সরকারের পদত্যাগের আগপর্যন্ত—একই ধারায় রেপো রেট এবং রিভার্স রেপো রেট একাধিক ধাপে বাড়িয়ে ৮.৫০ শতাংশে আনা হয়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকাণ্ড এবং কাগজে-কলমে এর ইচ্ছার মধ্যে বৈপরীত্য লক্ষ করা যায়। তদুপরি এই নীতিগত ব্যবস্থাগুলো খুব সামান্য এবং দেরিতে ছিল।
২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৯৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৮০ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে সরকারের সিকিউরিটিজ কেনে, অর্থাৎ সরকারের বাজেট ঘাটতি পূরণে সহায়তা করে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দুর্বল প্রাইভেট ব্যাংকগুলোকে নগদ অর্থের সংকট থেকে উদ্ধারে আবারও টাকা ছাপায়। ২০২৪ সালের শুরুর দিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের বিদ্যুৎ ও সার বন্ডের বিপরীতে আবার টাকা ছাপায়। দেশের সম্পদ বৃদ্ধির ভিত্তি ছাড়া এভাবে বারবার টাকা ছাপানোর কারণে মূল্যস্ফীতি ত্বরান্বিত হয়েছে এবং মূল্যস্ফীতি কমাতে প্রয়োগকৃত অন্য নীতিগুলোর বিপরীতে কাজ করেছে।
কোভিড–১৯–এর পর পণ্য সরবরাহে বিঘ্ন এবং উচ্চ চাহিদার পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি বহুল আলোচিত মূল্যস্ফীতির কারণ। কিন্তু ডলারের বিনিময় মূল্য গত দুই বছরে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। ফেডারেল রিজার্ভের সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি এবং কোভিড-১৯ লকডাউন ওঠানোর পর বৈশ্বিকভাবে ডলারের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ডলারের মূল্য বৃদ্ধি পায়, যা বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি করে। বাংলাদেশও এই প্রভাবের বাইরে ছিল না। ডলারের উচ্চ বিনিময় হার আমদানিকৃত পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। কঠোর আমদানি নীতির অধীনে অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসবহুল পণ্যের আমদানি সীমিত করা হলেও, প্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি দেশি বাজারকে প্রভাবিত করার জন্য যথেষ্ট ছিল।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোতে সাধারণ মূল্যস্ফীতি এবং খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং তা বাংলাদেশের তুলনায় অনেক কম। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৪ সালের আগস্টে ভারতে সাধারণ মূল্যস্ফীতি এবং খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল যথাক্রমে ৩.৬৫ শতাংশ এবং ৫.৬৬ শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত। এর একটি উল্লেখযোগ্য অংশের কারণ হলো প্রতিযোগিতামূলক বাজার থেকে দেশি বাজারের বিকৃতি। কিছু প্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে দেশি বাজার অলিগোপলির মতো আচরণ করে, যেখানে বাজারের কিছু এজেন্টের মধ্যে আঁতাত সৃষ্টি হয়। মূলত কয়েকজন ব্যবসায়ী বা প্রতিষ্ঠান একটি পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে এবং নিজেদের ইচ্ছেমতো দাম নির্ধারণ করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লক্ষ করা যায়, এই ব্যবসায়ীরা বেআইনিভাবে পণ্য মজুত করে সেই পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করেন বেশি মুনাফার আশায়। এর ফলে বাজারে সরবরাহ এবং চাহিদার ভিত্তিতে পণ্যের যে ভারসাম্য দাম থাকার কথা, তার তুলনায় বাজারদর বেশি থাকে। তবে এই বাড়তি দামের সুবিধাভোগী কৃষকেরা নন; বরং মধ্যস্বত্বভোগী এবং বড় ব্যবসায়ীরাই, যাঁরা কৃষকদের কাছ থেকে পণ্য সংগ্রহ করে বাজারে সরবরাহ করেন। ফলে এই বাজার–বিকৃতি শুধু হাতে গোনা কিছু মানুষকে সুবিধা দিয়ে বৈষম্য সৃষ্টি করছে। এর দায় সরকারের ওপরও পড়ে, কারণ বাজারমূল্য পর্যবেক্ষণে তারা ব্যর্থ হয়েছে। ‘সিন্ডিকেট’ নামে পরিচিত এই অলিগোপলিদের বিরুদ্ধে জনসাধারণের ব্যাপক অসন্তোষ সত্ত্বেও বাজারকে আরও প্রতিযোগিতামূলক করতে এবং অলিগোপলি ভাঙার জন্য সরকারের দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
মূল্যস্ফীতি কমাতে এই ক্ষেত্রগুলোতে সরকারকে আরও দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। দুর্বল প্রাইভেট ব্যাংকগুলোকে ছাপানো টাকা দিয়ে বেইল-আউট না করার সিদ্ধান্ত, রেপো রেট বাড়িয়ে ৯ শতাংশ করা, এসএলএফ এবং এসডিএল বাড়িয়ে যথাক্রমে ১০.৫০ শতাংশ এবং ৭.৫০ শতাংশ করা—এগুলোর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতি কমানোর সঠিক পথে আছে বলে মনে হচ্ছে। সরকারি বাজেট কাটছাঁট করাও এই ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।
ব্যাংকিং খাত ইতিমধ্যে উন্নতি করছে, স্থিতিশীলতা ফিরে আসছে এবং দুর্বল প্রাইভেট ব্যাংকগুলো ইতিবাচক বর্তমান হিসাব দেখাচ্ছে। তবে উৎপাদনশ্রমিক আন্দোলনের কারণে তৈরি পোশাক খাত বিঘ্নিত বলে ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় মূল্যে শিগগিরই উন্নতি আশা করা যাচ্ছে না। এই খাত থেকে ৮০ শতাংশের বেশি রপ্তানি আয় আসে। তবু দেশি বাজারে পণ্যের মূল্য নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করে, অলিগোপলি ভেঙে বাজারকে আরও প্রতিযোগিতামূলক করে, প্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর শুল্ক কমিয়ে, অভ্যন্তরীণ পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করে এবং পরিবহন ও অস্বাভাবিক খরচ, যেমন চাঁদাবাজি কমিয়ে সরকার মূল্যস্ফীতি কমাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
* আব্দুল জব্বার সাকিল: আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা বিশ্লেষক