আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্বদেরও মনোযোগ আকর্ষণ করেছে প্রথম আলো। প্রথম আলোর জন্য তাঁরা লিখেছেন বিশেষ শীর্ষ রচনা, দিয়েছেন একান্ত সাক্ষাৎকার। সেসবের নির্বাচিত একটি অংশ রইল এখানে।
সৈয়দ শামসুল হক: গাফ্ফার, লন্ডনে তুমি আছো ৪২ বছর হয়ে গেল। আমাদের সম্পর্কের শুরুটা হয়েছিল ৬০-৬২ বছর আগে। লন্ডনে এলেই তোমার কাছে একবার আসি। এবার এলাম একটা দুঃখজনক ঘটনার কারণে। শরীরের অবস্থাটা ভালো নয়—ফুসফুসে ক্যানসার ধরা পড়েছে, একটু ছড়িয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। ঢাকার চিকিৎসক বললেন, আমি যেন লন্ডনে গিয়ে ভালো চিকিৎসা নিই। তুমি এই খবর শুনে রবীন্দ্রনাথের একটা গানের কলি শোনালে। এখন একটু বলো না। রবিঠাকুর চলে যাওয়ার আগে গানটি লিখেছিলেন।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী: গানটি মনে পড়ল। কারণ, আমাদের দুজনেরই বয়স ৮০ পেরিয়েছে। বাঙালির গড়পড়তা আয়ুর চেয়ে এটা বেশি। সুতরাং আমার দুঃখ নেই। তোমাকে যেমন ডাক্তার একটা নির্দিষ্ট রোগের কথা বলেছেন, তেমনি আমারও অনেক রোগ আছে; যেগুলো দ্রুত মৃত্যুর কথা বলে না, কিন্তু আশাও দেয় না। তখনই রবীন্দ্রনাথের ওই গানটা আমার মনে পড়ল। আমি তো গাইতে পারি না। তবু যদি তুমি শুনতে চাও, গাইতে পারি। কারণ, এটা এখন দুজনেরই মনের কথা, ‘চাহি না রহিতে বসে ফুরাইলে বেলা/ তখনই চলিয়া যাব শেষ হলে খেলা।’ দোস্ত, আমাদের দুজনেরই বেলা ফুরিয়েছে। তবে অতীতের দিকে তাকিয়ে কোনো দুঃখ নেই। আই হ্যাভ নো রিগ্রেট।
সৈয়দ হক: আমারও কোনো রিগ্রেট নেই। উই হ্যাড গুড রান অব লাইফ। তা ছাড়া মানুষের কথা ভেবেছি, দেশ ও মানুষের কথা বলার চেষ্টা করেছি এবং সৎ থাকার চেষ্টা করেছি। যা কিছু ভেবেছি, সেটা গোপন না করে, রেখে-ঢেকে না রেখে পরিষ্কার করে বলার চেষ্টা করেছি। তবে তোমার এই গান শুনতে শুনতে মনে হলো, পঞ্চাশের দশকে আমাদের শুরুর দিনগুলোর কথা। তোমাকে আমরা বলতাম, ওই গানটা করো, ‘ওগো তৃষ্ণা আমার বক্ষজুড়ে/ তুমি বৃষ্টিবিহীন বৈশাখী দিন/ সন্তাপে প্রাণ যায় যে পুড়ে।’ সেই দিনগুলো কিন্তু ভালোই ছিল, কী বলো? পেছনের দিকে তাকিয়ে কী মনে হয়?
গাফ্ফার চৌধুরী: এখন তো কাউকে দেখি না চারপাশে। যাদের সঙ্গে আড্ডায় ঝগড়া করতাম, যাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল, শত্রুতা ছিল—তেমন কেউই নেই। আমাদের শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ—কেউ নেই। আমার তো মনে হয় তুমি আর আমি ছাড়া...
সৈয়দ হক: আরেকজন আছে, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর।
গাফ্ফার চৌধুরী: আমরা সবাই সহপাঠী। পঞ্চাশের দশকের কথা খুব মনে পড়ে। তখনই তোমার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ—সওগাত-এর অফিসে।
সৈয়দ হক: সওগাত অফিসে সাহিত্যের সভা বসত। পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের পাক্ষিক সভা বসত। সেখানে নাসিরউদ্দিন সাহেবের গুদামঘরে আমরা বসতাম।
গাফ্ফার চৌধুরী: রওশন আর মোসলেম নামের দুই বালক ছিল। আমাদের চা খাওয়াত। বেগম পত্রিকায় মেয়েদের নামে কবিতা লিখতে হতো, মনে আছে? (হাসি)
সৈয়দ হক: মনে আছে, হাসান তো বেগম পত্রিকা সম্পাদনা করতেন বেনামে? এমনকি সোয়েটার বোনার কলাকৌশলও তাঁকে লিখতে হতো। হাসানের একটা কবিতার কয়েকটা লাইন মনে পড়ছে। কবিতাটি কখনো ওর বইতে পাইনি, ‘মরুভূমি তার শরীরে অসার ধুলার রাশি/ ওড়াবেই কেন দিনরাত বসে/ বলো না এসে/ বলবে এখন/ সময় তোমার হয়েছে এখন দীপ্তিমান/ কতটুকু গেলে স্বর্গ মেলে/ কত পথ গেলে স্বর্গ মেলে?’ এই কবিতার মতো আমারও বলতে ইচ্ছা করে, ‘কতটুকু গেলে স্বর্গ মেলে/ কত পথ গেলে স্বর্গ মেলে?’
গাফ্ফার চৌধুরী: শামসুর রাহমানেরও একটি কবিতার লাইন আছে, ‘গোধূলিতে হলো যার প্রয়াণ হে প্রভু।’ আমরা তো আমাদের জীবনের গোধূলিলগ্নে।…তোমার খেলারাম খেলে যা উপন্যাসের কথা আমার খুব মনে পড়ে। এটি তোমাকে প্রচুর সুনাম দিয়েছে, দুর্নাম দিয়েছে। বইটির বিশেষত্ব হলো, এই প্রথম বাংলাদেশের সাহিত্যে শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা আন্দোলনের কথা উঠে এসেছে। এর আগে কোনো গল্প-উপন্যাস বা সাহিত্যে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর আন্দোলনের প্রসঙ্গ উঠে আসেনি। আরও একটা অনন্য দান তোমার বাংলা সাহিত্যে, সেটা হলো বাংলা সাহিত্যে তখনো শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি হয়নি। তুমিই প্রথম তাস এবং অন্যান্য গল্প গ্রন্থে শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে তুলে আনলে এবং ঢাকার নাগরিক জীবনটা উঠে এল। এটা তোমার একটা বড় কীর্তি। সওগাত অফিসের অনেক স্মৃতি মনে পড়ছে।
২৪ জুন ২০১৬ (সংক্ষেপিত)