বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় সম্ভাবনার জায়গা হলো, দেশের বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠী। এই বিপুল তারুণ্যের জনমিতিক সুফল পেতে হলে অনতিবিলম্বে তাদের যুগের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ করা প্রয়োজন। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ঊর্ধ্বমুখী রাখতে রেমিট্যান্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, যার প্রধান উৎস হলো স্বল্প দক্ষতা সম্পন্ন প্রবাসী জনশক্তি, তৈরি পোশাক কারখানায় বিপুল নারী কর্মীর অংশগ্রহণ এবং পরিশ্রমী কৃষক সমাজের কৃষি ও মৎস্য উৎপাদন। গবেষণায় দেখা যায়, এসব ক্ষেত্রে যারা কর্মরত তাদের অধিকাংশই ন্যূনতম মৌলিক শিক্ষাগ্রহণ করার সুযোগ পাননি অথবা পেলেও চর্চার অভাবে তা টেকসই হয়নি।
উন্নত দেশগুলোতে বা সম্প্রতি উন্নয়নশীল থেকে উন্নত দেশে পরিণত হওয়া দেশগুলোর জনসংখ্যার শতকরা ৬০-৮০ ভাগ মানুষ কারিগরি শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের মোট শিক্ষার্থীর মাত্র শতকরা ১৫ ভাগ কারিগরি বা দক্ষতা ভিত্তিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে ভর্তি হয়। কাজেই অদক্ষ বা স্বল্প দক্ষতা সম্পন্ন জনশক্তিকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে, তার দশগুণ বেশি আয় করা সম্ভব হতো, যদি কারিগরি শিক্ষাকে জনপ্রিয় করার মাধ্যমে মূলধারায় নিয়ে আসা সম্ভব হতো। আবার, আমাদের দেশে বহুজাতিক করপোরেট ও বাণিজ্যিক কোম্পানিগুলোর জন্য ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে নেতৃত্বের গুণাবলি সম্পন্ন জনশক্তি তৈরি করতে না পারায় বিদেশি নাগরিকেরা এসব পদে কাজ করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে নিয়ে যাচ্ছেন। নতুন আশঙ্কার বিষয় হলো, যে কৌশল অবলম্বন করে বাংলাদেশ বর্তমানে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখেছে, সেই শ্রমভিত্তিক মডেল আজকে হুমকির সম্মুখীন।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রভাবে মানুষের সাধারণ দক্ষতাভিত্তিক কাজগুলো সব কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে পরিচালিত হবে। ফলে বর্তমানের অনেক পেশা হারিয়ে যাবে। কাজেই দীর্ঘদিনের বাজারমুখী জনশক্তি চাহিদা পূরণের উদ্দেশ্যে সাজানো শিক্ষা ব্যবস্থার চাহিদা হারিয়ে যাচ্ছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রভাবে ভবিষ্যৎ সমাজকাঠামো, শ্রমবাজার পরিবর্তনের গতি অকল্পনীয়। এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে হলে শিক্ষাক্রমের সংস্কার সাধনের মাধ্যমে পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে অভিযোজনের জন্য নেতৃত্ব, যোগাযোগ, সূক্ষ্ম চিন্তন, সৃজনশীল চিন্তন, সমস্যা সমাধান মূলক দক্ষতা ইত্যাদি রূপান্তরমূলক দক্ষতা অর্জন করার বিকল্প নেই।
বিশ্ব অর্থনীতির দীর্ঘদিনের বাস্তবতায় উন্নত দেশগুলো তাদের জ্ঞাননির্ভর শিক্ষাব্যবস্থাকে সাজিয়েছে এবং সৃজনশীলতার চর্চার মাধ্যমে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করে বিশ্বের নেতৃত্ব দিয়েছে ও অর্থনৈতিক বাজার নিয়ন্ত্রণ করেছে। অনেক উন্নত দেশ সারা পৃথিবী থেকে সৃষ্টিশীল মানুষদের নাগরিকত্ব দিয়ে তাদের পেটেন্ট তৈরির ঝুলি ভারী করেছে।
কিন্তু বাংলাদেশসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশ জ্ঞান নির্ভর সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য যে ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা প্রয়োজন তা প্রতিষ্ঠায় আজও সফল হয়নি। আমরা শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে সাজিয়েছি যা বাস্তবতা থেকে শিক্ষার্থীকে প্রতিনিয়ত দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। শিক্ষার্থী জীবনের সঙ্গে শিক্ষা গ্রহণ প্রক্রিয়ার মিল খুঁজে পাচ্ছে না। এতে আগ্রহ হারাচ্ছে এবং ঝরে পড়ছে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ২০১৩-২০১৭ সালে করা ধারাবাহিক গবেষণায় দেখা যায়, অধিকাংশ শিক্ষার্থী কাঙ্ক্ষিত যোগ্যতা অর্জন করতে পারছে না। যোগ্যতা অর্জনের ধারা বছর অনুযায়ী নিম্নমুখী। আমাদের মাধ্যমিক স্তরেও আছে নানামুখী সমস্যা। উপরন্তু শিক্ষার মান নিয়ে আছে নানা চ্যালেঞ্জ। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক ডিঙিয়ে যেসব শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষায় যাচ্ছেন, তারাও মুখস্থনির্ভর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গিয়ে সনদ অর্জন করছেন। ফলে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি, পেটেন্ট ও কপিরাইট অর্জনের চর্চা অবহেলিত থেকে গেছে। যে যুগে তথ্য সংরক্ষণের জন্য চার পাশে হাজারো প্রযুক্তি এবং কৌশল ছড়িয়ে আছে, সেই যুগে শিক্ষাব্যবস্থায় এখনো মস্তিষ্কে তথ্য ধরে রাখার মুখস্থনির্ভর কৌশল চর্চা অব্যাহত রাখা সত্যিই হতাশা জনক। এসব সমস্যার পাশাপাশি কোভিড-১৯ সার্বিক এই পরিস্থিতিতে বাড়তি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। শিখনকে বাস্তবসম্মত করতে হলে শ্রেণিকক্ষের বাইরে গিয়ে জীবনের অভিজ্ঞতার কাছে নিয়ে যেতে হবে।
সম্প্রতি সরকার প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত একই লক্ষ্য উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রমের রূপরেখা প্রণয়ন করেছে। আশা করা যায় এর ফলে এক স্তর থেকে আরেক স্তরে উত্তরণ বাধাহীন হবে এবং ঝরে পড়া কমবে। এতে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন শেখানো প্রক্রিয়ার চর্চা হবে এবং শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে। ফলে শিক্ষা শুধু বিদ্যালয়ের শ্রেণি কক্ষে আবদ্ধ থাকবে না, ছড়িয়ে যাবে শিশুর প্রতিটি কাজ ও অভিজ্ঞতার মাঝে। শিক্ষার্থীরা সাধারণ শিক্ষায় থেকেই জীবিকা সংশ্লিষ্ট দক্ষতা অর্জনের সুযোগ পাবে এবং কারিগরি ও সাধারণ শিক্ষার শিক্ষার্থীরা তাদের ধারা পরিবর্তনেরও সুযোগ পাবে।
নতুন এই শিক্ষাক্রম সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে দক্ষ ও সৃজনশীল শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। পৃথিবীতে শিক্ষা সংস্কারের মাধ্যমে উন্নতির শিখরে পৌঁছা দেশগুলোতে (দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, ফিনল্যান্ড, জাপান ইত্যাদি) সরকারি চাকরিতে শিক্ষকদের সর্বাধিক বেতনকাঠামো প্রণয়ন করেছে, যাতে মেধাবীরা এই পেশায় আকৃষ্ট হয়। আমাদের শিক্ষকদের মানোন্নয়নের পাশাপাশি পেশাগত উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। শিখন সামগ্রীর আধুনিকায়নও সময়ের দাবি। এসব পরিবর্তন আনতে হলে শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়ানোর বিকল্প নেই। বাংলাদেশ যতই মধ্যম আয়ের দেশের দিকে উত্তীর্ণ হবে, সেই অনুপাতে শিক্ষা খাতে জিডিপির বরাদ্দ বাড়াতে হবে। শিক্ষাখাতের বরাদ্দ জিডিপির ৬ শতাংশে নিতে হবে। তাই, আগামীর দিনগুলোতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে শিক্ষা সংস্কারে বিনিয়োগই হোক উন্নয়নের মেগা প্রকল্প।
ড. এম তারিক আহসান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক ও জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন কোর কমিটির সদস্য।