কর্মীর লেখা
প্রথম আলো ও মনের স্লেটে টানা একটা দামি দাগ
প্রথম আলোর ২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কর্মীদের কাছে লেখা আহ্বান করা হয়েছিল। তাঁরা লিখেছেন প্রথম আলোকে নিয়েই। কর্মীদের নির্বাচিত কিছু লেখা নিয়েই এ আয়োজন।
২২ বছর আগের কথা। মফস্সলে একটা ছোটকাগজ সম্পাদনা করি। কবিতা লিখি, মুছি। মাঝেমধ্যে দৈনিকের সাহিত্য পাতায় সেগুলো ছাপাও হয়। তাতে গর্ব হয় আমার; কষ্ট হয় আব্বার। ভাবেন, ‘আহা রে, ছেলেটা গোল্লায় গেল!’
আব্বার আক্ষেপ রাগে মোচড় নিতে দেরি হলো না। আমিও ‘রেখো মা দাসেরে মনে...’ বলে বেরোলাম। ঢাকায় এসে উঠলাম। প্রথমে ‘কবিতীর্থ’ আজিজ মার্কেটে। সেখান থেকে কাজীপাড়ায় দুই বন্ধুর একান্নবর্তী দেড় রুমের বাসায়। তাঁদের একজন কবি। একজন ছবি আঁকে। সে বাসায় রান্নাটান্না হয় না। রেস্তোরাঁ থেকে তিনজন গিয়ে খেয়ে আসি। নবাগত বেকার বন্ধুটির খাবারের টাকা তারাই দেয়।
প্রায় ৪৮ ঘণ্টা একটানা পেটে দানা না পড়ার পর আমি ‘ক্ষুধার স্বরূপ’ দেখা শুরু করলাম। মাঝেমধ্যে ঘুম আসছে বলে মনে হতে লাগল। আসলে সেটা ঘুম ছিল না। ছিল অদ্ভুত ধরনের স্বপ্নালু ঘোর।
দিন পনেরো পর ওই দুই বন্ধু কী একটা কাজে ঢাকার বাইরে গেল। ওই দিনই তাদের ফেরার কথা। কিন্তু ফিরল না। পরদিনও না। তারপরের দিনও না। এদিকে আমার পকেট ফাঁকা। পরিচিত কেউ নেই। ঘরে চাল–ডালও নেই। যথাসময়ে ক্ষুধা বাড়তে লাগল। পানি খেতে লাগলাম। এতে তাৎক্ষণিকভাবে মাথার ঝিমঝিম ভাবটা চলে যায়। কিন্তু বার দুয়েক বাথরুমে যাওয়ার পর সেই ভাব চাগাড় দিয়ে ওঠে। ঝিমঝিম ভাবটা শেষ পর্যন্ত একটা ঘোর তৈরি করে।
একবার ভাবলাম, মতিঝিলে যাই। সেখানে এক বড় ভাই থাকেন। তাঁর কাছ থেকে কিছু টাকা নিই। পরক্ষণে মনে হলো, নাহ্! দেখা যাক, কতক্ষণ না খেয়ে থাকতে পারি। আমি ক্ষুধার স্বরূপ দেখতে চাই।
প্রায় ৪৮ ঘণ্টা একটানা পেটে দানা না পড়ার পর আমি ‘ক্ষুধার স্বরূপ’ দেখা শুরু করলাম। মাঝেমধ্যে ঘুম আসছে বলে মনে হতে লাগল। আসলে সেটা ঘুম ছিল না। ছিল অদ্ভুত ধরনের স্বপ্নালু ঘোর। সেটি সম্ভবত অজ্ঞান হওয়ার খুব কাছের অনুভূতি। এ সময় চোখের সামনে কিছুক্ষণ পরপর ছোট ছোট আলো জ্বলতে দেখা যায়। সম্ভবত এটাই ‘শর্ষে ফুল’।
মনে হচ্ছিল, আমি যেন কোথায় হারিয়ে যাচ্ছি। মনে হচ্ছিল, কালের গলিত গর্ভে বিলীয়মান সময়ের মতো ধীরে ধীরে আমি ডুবে যাচ্ছি। ডুবে যাচ্ছি... ডুবে যাচ্ছি... ডুবে... ডুবে...!
ঘোরের মধ্যেই হঠাৎ মনে হলো, প্রথম আলোর সাহিত্য সাময়িকীতে আমার কয়েকটা কবিতা ছাপা হয়েছিল। তারা নাকি বিল দেয়। গিয়ে দেখাই যাক না! এই চিন্তা মাথায় আসতেই আচমকা অবসন্ন শরীর চাঙা হয়ে উঠল।
লোকাল বাসে চড়ে কারওয়ান বাজারের সিএ ভবনে এলাম। এই প্রথম আমি প্রথম আলোর অফিসে এলাম। তখন সাহিত্য পাতা দেখতেন কবি জাফর আহমেদ রাশেদ। তাঁর রুমে গিয়ে নাম বললাম। তিনি চিনলেন। লেখক সম্মানীর কথা বলার পর তিনি বললেন, ‘আমাদের লেখক সম্মানী দেওয়া হয় মাসের শেষ মঙ্গল ও বুধবারে। আপনার কপাল ভালো, আজ মাসের শেষ বুধবার। অ্যাকাউন্ট সেকশনে যান, বিল রেডি আছে।’
যতদূর মনে পড়ে, সিএ ভবনের নিচতলায় অ্যাকাউন্টস সেকশন ছিল। কাউন্টারে এক তরুণী কর্মীকে বিলের কথা বললাম।
তিনি বললেন, ‘আপনার আইডি নম্বর বলেন।’
আমি বললাম, ‘সেটা কী জিনিস?’
তিনি বললেন, ‘আমরা লেখকদের একটি আইডি নম্বর দিয়ে থাকি। সেই নম্বর বললে, আমরা তাঁকে বিল দিয়ে দিতে পারি।’
টাকাগুলো হাতে পাওয়ার পর নিজেকে রাজা–বাদশা কিসিমের লোক বলে মনে হচ্ছিল। খেয়াল করলাম, ‘পয়সার গরমে’ শরীরে এখন আর অবসন্ন ভাবটা নেই।
আমি বললাম, ‘আমার কোনো আইডি নম্বর নেই।’
তিনি বললেন, ‘কোনো অসুবিধা নেই। আপনার নাম লিখে সার্চ দিলেই পেয়ে যাব।’
তিনি কম্পিউটারে আমার নাম লিখে সার্চ দিলেন। আমি দেখলাম, কম্পিউটারের মনিটরে আমার নাম ভেসে উঠেছে। আমার নামের পাশে লেখক সম্মানীর ঘরে লেখা ১ হাজার ২০০ টাকা। তিনটি কবিতার বিল।
টাকাগুলো হাতে পাওয়ার পর নিজেকে রাজা–বাদশা কিসিমের লোক বলে মনে হচ্ছিল। খেয়াল করলাম, ‘পয়সার গরমে’ শরীরে এখন আর অবসন্ন ভাবটা নেই।
ওই ঘটনার পর অনেক কাগজ থেকে লেখার বিল পেয়েছি। কিন্তু প্রথম আলোর সেই বিল পাওয়ার অভিজ্ঞতা মনের মধ্যে একটা স্থায়ী দাগ কেটে গেছে। সেই দাগ মন থেকে মুছে যাক, তা একজন ‘অবসরপ্রাপ্ত কবি’ হিসেবে চাই না; প্রথম আলোর একজন অতি সাধারণ কর্মী হিসেবেও তা চাই না।
সারফুদ্দিন আহমেদ, সহকারী সম্পাদক, সম্পাদকীয় বিভাগ