কর্মীর লেখা
মঞ্চায়িত হয়নি যে নাটক
প্রথম আলোর ২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কর্মীদের কাছে লেখা আহ্বান করা হয়েছিল। তাঁরা লিখেছেন প্রথম আলোকে নিয়েই। কর্মীদের নির্বাচিত কিছু লেখা নিয়েই এ আয়োজন।
আরও কেউ কেউ আমার সঙ্গে যাওয়ার কথা থাকলেও তাদের যাওয়া হয়নি। তাদের বাইরে আর কাউকেও সম্ভবত পাইনি। তাই সেদিন সন্ধ্যায় আমি একাই নাট-মণ্ডলে গিয়েছিলাম। বুদ্ধদেব বসুর কাব্যনাটক ‘কাঠঠোকরা’র মঞ্চায়ন দেখতে।
সময়টা ২০১০ সালের মাঝামাঝি। জুন-জুলাই মাস হবে হয়তো। প্রশাখাময় ক্যাম্পাসের দিগ্বিদিক ডানা মেলা রাস্তাগুলো ইতস্তত ভেজা, এইটুকু শুধু মনে পড়ছে।
এমন এক বৃষ্টিভেজা শ্যামল সন্ধ্যায় স্নান সেরে জিয়া হলের গণরুম থেকে সেদিন আমি বের হয়েছিলাম। সূর্যসেন হল ক্যাফেটেরিয়া পেরিয়ে হাতের বাঁয়ে বাণিজ্য অনুষদের সামনের মালরো চত্বর অতিক্রম করে, আর সি মজুমদার মিলনায়তনের সামনের রাস্তা ধরে হেঁটে যথাসময়ে আমি নাট-মণ্ডলে পৌঁছাই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের পেছনের এই নাট্যশালায় তখন পর্যন্ত আমি আর কোনো নাটক দেখিনি। তাই স্বাভাবিক একটা উদ্দীপনা ছিল। তার ওপর মঞ্চ পরিচালক জয়িতা মহলানবিশের এ নাটকটি আমি বিনে পয়সায় দেখতে এসেছি! তিনি ছিলেন ডালিম ভাইয়ের বন্ধু। তিনিই আমাকে নাটকটি দেখতে আসতে বলেছিলেন।
তখন একটি বিভোর সময় পার করছিলাম আমি। এই ঘোরলাগা কালের ওই দিন সন্ধ্যায় আনুষ্ঠানিকতা শেষে নাট-মণ্ডলে ঢুকে মঞ্চসজ্জা দেখে আমার মনটা ভালো হয়ে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি এই ছয়-সাত মতো হবে। মাথায় ঝাঁকড়া লম্বা চুলে ক্যাপ, ঢিলে জিনস ও টি-শার্ট, পায়ে চপ্পল। এই বেশেই ক্লাস করি, মধুর ক্যানটিনে যাই, গ্রন্থাগারে ঢুঁ মারি, হাকিমে যাই, চা খাই, এদিক–সেদিক বসে থাকি, আড্ডা মারি। এরই মধ্যে একটি প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। এরপর আমার পালে নীলকণ্ঠের খোলা হাওয়ার গতিবেগ বেড়ে যায়। তখন ঝড়ের ভয়, ভ্রুকুটির সব ডর সত্যি সত্যি আমার কেটে যেতে শুরু করেছিল।
এদিকে হলের গণরুমে তল্পিতল্পা রেখেছি ঠিকই, ঠিকমতো ঘুমাতেও পারি না, বিদঘুটে এই গেস্টরুমও তেমন একটা করি না। বস্তুত গণরুম ও গেস্টরুম নামের এসব অভিশপ্ত কক্ষ জেলা শহর ও গ্রামীণ পরিবার থেকে আসা তরুণদের একটি বড় অংশের স্বপ্নে জল ঢেলে দেয়। ফলে অনেক কিছু চুপসে যেতে ও ওলট-পালট হতে শুরু করে।
শুরু হয় রাত জাগা, ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়ানো। দলে দলে, কেউবা কাছের দু-একজন বন্ধুকে নিয়ে, কেউবা একাকী নিশিরাতে ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়ায়। রাতের আঁধারের সঙ্গে, মল চত্বরের কড়া ছাতিম ফুলের সুবাসের সঙ্গে বা পাশের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বেঞ্চিতে শুয়ে আধা ঘোলাটে আকাশে নক্ষত্র গুনে স্বপ্ন বিনিময় করে এক-আধজন। আমিও এই হাটে বিনিময় শুরু করি অনেকটা নিজের অজান্তে। তখন কবিতাই ছিল আমার ধ্যানজ্ঞান।
তখন একটি বিভোর সময় পার করছিলাম আমি। এই ঘোরলাগা কালের ওই দিন সন্ধ্যায় আনুষ্ঠানিকতা শেষে নাট-মণ্ডলে ঢুকে মঞ্চসজ্জা দেখে আমার মনটা ভালো হয়ে যায়। মাঝারি আকারের মঞ্চটি নানা ধরনের গাছগাছালিতে ঠাসা। গাছের ফাঁকে ফাঁকে নানা রঙের আলোর খেলা। একধরনের সুবাস সংগীতের নিচু স্বরের টুনটান নাট্যশালাটি মোহময় করে রেখেছে।
টিকিটের অর্থভেদে বসার জায়গা বিন্যাস করা ছিল। সামনের কয়েকটা সারির পরের ধাপে আমার বসার আসন। নির্দিষ্ট করা নেই, এখানকার যেকোনো একটাতে বসলেই হলো। তো হাঁটার জায়গার পাশের দু-একটি চেয়ার রেখে আমি বসে পড়ি।
বসে মঞ্চের দিকে তাকাচ্ছি, ডানে-বাঁয়ে হয়তো দেখছি। এমন সময় পেছন থেকে কেউ একজন আমাকে আদেশের সুরে বলল, এ্যা-ই, পা নামিয়ে বস! আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তার কাছে জানতে চাইলাম, আপনার কি দেখতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে? এরপর তার সঙ্গে আমার আরও কয়েকটা বাক্য বিনিময় হলো। ততক্ষণে নাটক শুরু হয়ে গেছে। আমি তার সঙ্গে কথা না বাড়িয়ে ডান পায়ের ওপর বাঁ পা রেখে আরাম করে বসে নাটকে মনোনিবেশ করি।
নাটক শেষে হৃদয়গ্রাহী এক আবেশে উৎফুল্ল মনে আমি বের হয়ে চলে যাচ্ছিলাম। নাট্যশালা থেকে বের হয়ে কয়েক পা যেতেই পেছন থেকে কে জানি ডাক দিল, এ্যা-ই!
আমি হাঁটা বন্ধ করে ফিরে তাকাতেই দেখি লিকলিকে একটা মানুষ আমার দিকে তেড়ে আসছে। সাতপাঁচ ভাবার আগেই আমি পালানোর জন্য দৌড়াতে শুরু করি।
আমি দৌড়াচ্ছি, পেছনে পেছনে সেও দৌড়াচ্ছে আর চিল্লাছে। তার সঙ্গে আরও কেউ ছিল কি না, ঠিক মনে পড়ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ, সমাজবিজ্ঞান অনুষদের নতুন ভবন অতিক্রম করে মধুর ক্যানটিনের উঠানটা কোনোমতে আড়াআড়িভাবে পার হয়ে যাই।
আইবিএ গেটের সামনে মূল সড়ক দিয়ে না গিয়ে কোনাকুনিভাবে দৌড়ে যাওয়ার সময় আমি মাটি স্পর্শ করে উবু হয়ে থেমে যাই। হঠাৎ গতি কমায় আমাকে ধাওয়া করা ব্যক্তি জুতা পিছলে ধপাস! পড়ে যেতে যেতে তার ধর্ ধর্ চিল্লানি শুনে ক্যানটিনের ভেতর ও বাইরে থাকা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের অনেকে ছুটে আসেন। ভাগ্যক্রমে সেখানে আমার হলের আমার ব্যাচেরও কয়েকজন ছিল। তারাসহ অন্যরা আমাকে ক্যানটিনের বাইরে গোলঘরের পাশে একটি চেয়ারে এনে বসায়। ওদিকে পড়ে যাওয়া ব্যক্তি বেশ লম্ফঝম্ফ করতে থাকে। সবাই আমাকে ঘিরে ধরেছে। ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা আমার বৃত্তান্ত শুনে, হলের নাম-ঠিকানা জেনে ছেড়ে দেয়।
পরে জানতে পারি, নাট্যশালায় যে লোকটি আমাকে আদব শেখাতে উদ্ধত হয়েছিলেন, তিনি ক্যাম্পাসে ‘বোমা আব্বাস’ নামে পরিচিত। ছাত্রলীগের সাবেক নেতা।
এ ঘটনার দু-এক দিন পর গেস্টরুম চলাকালে আমি গণরুমে বসে ছিলাম। এমন সময় একজন এসে বলে, তোকে মারুফ ভাই ডাকছে! শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে গেলাম। আমাদের ব্যাচমেটে ঠাসা গেস্টরুমে মারুফ সাহেব ওই দিনের ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ শুনলেন।
মারুফ সাহেব সম্ভবত হলের নন, ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় বা কেন্দ্রীয় কমিটির কোনো দায়িত্বে ছিলেন। অর্থনীতি বিভাগের এই ভদ্র লোক সব শুনে সংক্ষেপে ‘রায়’ দিলেন, তুমি এখনই হল থেকে নেমে যাবে। তিন মাস কি অনির্দিষ্টকালের জন্য আমার হলে ফেরা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
আমিও সঙ্গে সঙ্গে একটি ছোট ঝুল-ব্যাগে দু-একটা প্যান্ট-শার্ট নিয়ে অনেকটা বীরদর্পে জিয়া হলের করিডর ধরে দ্রুত লয়ে বের হয়ে যাই।
পরে জানতে পারি, নাট্যশালায় যে লোকটি আমাকে আদব শেখাতে উদ্ধত হয়েছিলেন, তিনি ক্যাম্পাসে ‘বোমা আব্বাস’ নামে পরিচিত। ছাত্রলীগের সাবেক নেতা। আরও শুনেছিলাম, আমাকে গেস্টরুমে ডেকে পাঠানোর আগে উপস্থিত সবাইকে মারুফ সাহেব বলেছিলেন, তাকে (আমাকে) গণধোলাই দিতে হবে।
যা–ই হোক, গণরুমবাসী এ ধরনের অসংখ্য গণধোলাইয়ের সাক্ষী। আমি চাই তারা ক্যাম্পাসের সুখস্মৃতির পাশাপাশি ভয়-আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের গল্পগুলোও লিখুক। আমার ধারণা, এসব গল্প জাতীয় জীবনকে বুঝতে সাহায্য করে।
মো. তাসনিম আলম, সমন্বিত বার্তা বিভাগ