দাসত্বের যুগ শেষ হয়েছে বলা হলেও বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন। ‘আধুনিক দাসত্ব’-এর শৃঙ্খলে আটকা পড়ে আছে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ। এসব মানুষকে দিয়ে হয় জোর করে কাজ করিয়ে নেওয়া হচ্ছে অথবা জোরপূর্বক বিয়ে দেওয়া হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এসব মানুষের জীবনের মর্যাদাও নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে।
আজ সোমবার জাতিসংঘের প্রকাশ করা নতুন এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে আধুনিক দাসত্বের শৃঙ্খলে আটকা পড়া মানুষের সংখ্যা এখন পাঁচ কোটি।
আধুনিক যত উপায়ে এখনো দাসত্বের চর্চা চলছে, ২০৩০ সালের মধ্যে তার সব দূর করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে জাতিসংঘ। কিন্তু জাতিসংঘের এ লক্ষ্য তো অর্জিত হয়নি, উল্টো বেড়েছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০২১ সালে বিশ্বে বাধ্যতামূলক শ্রম ও জোরপূর্বক বিয়ের শিকার মানুষের সংখ্যা বেড়েছে এক কোটি।
জাতিসংঘের শ্রমবিষয়ক সংস্থা আইএলও, অভিবাসনবিষয়ক সংস্থা আইওএম ও অস্ট্রেলিয়ার দাতব্য সংস্থা ওয়াক ফ্রি ফাউন্ডেশন যৌথভাবে এ গবেষণা করেছে। তাতে দেখা গেছে, গত বছরের শেষ দিকে বিশ্বের ২ কোটি ৮০ লাখ লোক বাধ্যতামূলক শ্রম দিচ্ছেন আর জোরপূর্বক বিয়ের পর সংসার করছেন ২ কোটি ২২ লাখ।
জাতিসংঘ প্রতিবেদন অনুযায়ী হিসাবটা এমন দাঁড়াচ্ছে, বিশ্বে প্রতি দেড় শ মানুষের মধ্যে প্রায় একজন দাসত্বের আধুনিক শৃঙ্খলে বন্দী হয়ে জীবন যাপন করছেন।
গবেষণার অংশীদার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রধান গাই রাইডার এক বিবৃতিতে বলেছেন, এটা অত্যন্ত মর্মান্তিক বিষয় যে আধুনিক দাসত্বের পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। মানুষের এই মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি এখনো ঘটে চলছে। কোনো ধরনের কোনো যুক্তি দিয়েই এর বৈধতা দেওয়া যেতে পারে না।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, কোভিড মহামারি এই ঝুঁকি আরও বাড়িয়েছে। কারণ, মহামারিতে অনেক শ্রমিকের পরিস্থিতি ও ঋণের পরিমাণ অনেক বেড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও সশস্ত্র সংঘাতে চাকরির বাজার, শিক্ষা, হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা এবং জোরপূর্বক ও অনিরাপদে দেশান্তর বেড়েছে নজিরবিহীনভাবে।
এসব ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নারী ও শিশুরা। বাধ্যতামূলক শ্রমের শিকার প্রতি পাঁচজনের একজনই শিশু। এর মধ্যে অর্ধেক বাণিজ্যিকভাবে যৌন নিপীড়নের শিকার। এতে বলা হয়, অভিবাসী শ্রমিকেরা অ-অভিবাসী প্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিকদের তুলনায় জোরপূর্বক শ্রমের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে তিন গুণ বেশি।
আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থার (আইওএম) প্রধান আন্তোনিও ভিতোরিনো এক বিবৃতিতে বলেছেন, নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ও নিরাপদ অভিবাসনের বিষয়টির গুরুত্ব উঠে এসেছে এ প্রতিবেদনে।
বিশ্বের প্রতিটি দেশেই আধুনিক দাসত্বের শিকার মানুষ রয়েছে। এর মধ্যে শ্রম দিতে বাধ্য হচ্ছে এমন মানুষের অর্ধেকের বেশি এবং জোরপূর্বক বিয়ের শিকার মানুষের চার ভাগের এক ভাগ উচ্চমধ্যম বা উচ্চ আয়ের দেশের। গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৬ সালে যতসংখ্যক লোক জোরপূর্বক বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছেন, এরপরের সময়ে সেই সংখ্যা ৬৬ লাখ বেড়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগই নারী ও শিশু। একই সময়ে জোরপূর্বক শ্রম দিতে বাধ্য মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ২৭ লাখের মতো।
এই সংখ্যা বেড়েছে প্রধানত বেসরকারি খাতের অর্থনীতিতে জোরপূর্বক শ্রম দেওয়া মানুষের। এর মধ্যে রয়েছে বাণিজ্যিকভাবে যৌনকাজে বাধ্য করা।
তবে জাতিসংঘের ওই প্রতিবেদনে এ-ও বলা হয়েছে, জোরপূর্বক শ্রম দিতে যাঁরা বাধ্য হচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে ১৪ শতাংশ কাজ করছে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক আরোপিত কাজে। এ ছাড়া অনেক দেশে কারাগারে বন্দী মানুষকে দিয়ে জোরপূর্বক কাজ করিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এসব দেশের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশও রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জোরপূর্বক শ্রমের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বাজে পরিস্থিতি উত্তর কোরিয়ার। এর আগে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় থেকেও বিষয়টি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিল। এ ছাড়া চীনের বিষয়টিও উঠে এসেছে। তাতে বলা হচ্ছে, জাতিসংঘের একাধিক সংস্থা চীনে জোরপূর্বক শ্রমের বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ জানায়। এর মধ্যে দেশটির জিনজিয়াং অঞ্চল রয়েছে। যেখানে ১০ লাখের বেশি উইঘুর ও অন্য সম্প্রদায়ের মুসলিমকে আটকে রেখে কাজ করানো হচ্ছে।