ভারত, পশ্চিম এশিয়া ও ইউরোপে আর্থিক কর্মকাণ্ডে গতি আনতে ঘোষিত হয়েছে এক নতুন রেল ও জাহাজ চলাচলের করিডর। এই নতুন করিডর ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে, তবে কি চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (বিআরআই) কিংবা ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ (ওবিওআর) প্রকল্পের সঙ্গে পাল্লা দিতে চলেছে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র?
গত শনিবার ভারতের রাজধানী দিল্লিতে অনুষ্ঠিত জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে এই নতুন অর্থনৈতিক করিডরের (অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও পণ্য বাণিজ্যের পথ) কথা ঘোষণা করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
ভারত, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্ডান, ইসরায়েল ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে রেল ও সমুদ্রপথে সংযুক্ত করা এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য। এর ফলে বাণিজ্য যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনই শক্তি সম্পদ বিনিময় ও ডিজিটাল যোগাযোগও বহুগুণ বেড়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। এই করিডর বিস্তীর্ণ এই ভূখণ্ডের বাণিজ্য খরচ কমিয়ে দেবে বহুলাংশে। উপকৃত হবে সাধারণ মানুষ। প্রধানমন্ত্রী মোদি জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের অবসরে এই প্রকল্প রূপায়ণে একটি অনুচুক্তি সই করে বলেন, এটা এক ‘ঐতিহাসিক পার্টনারশিপ’। ভারত ছাড়াও সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এতে স্বাক্ষর করেছে।
পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ সম্প্রসারণের চেষ্টা ভারত যখনই করেছে, বাদ সেধেছে পাকিস্তান। তারা কখনো চায়নি ভারতকে সেই সুযোগ দিতে। ১৯৯০ সাল থেকে এই বিষয়ে তারা সক্রিয়। পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে আফগানিস্তান বা পশ্চিম এশিয়ায় যোগসূত্র স্থাপনে ভারতকে সাহায্যের হাত তারা বাড়িয়ে দেয়নি। ভয় ও অবিশ্বাসই তার প্রধান কারণ। পাকিস্তানকে সে বিষয়ে ক্রমাগত উৎসাহিত করে গেছে তাদের সর্বঋতুর বন্ধু চীন; বরং পাকিস্তানকে তালুবন্দী করে চীন এগিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছে তার ‘ওবিওআর’ বা ‘বিআরআই’ প্রকল্প। এবার পশ্চিম ও উত্তরের ওই দুই প্রতিবেশীর যাবতীয় বাধা কাটিয়ে ভারত তার পশ্চিমাভিযান সফল করতে পারবে বলে মনে করা হচ্ছে। সেই উদ্যোগে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম এশিয়ার সৌদি আরব, আমিরাতসহ ভারতের নতুন বন্ধুরা।
এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যুক্তরাষ্ট্রও আগ্রহী। তার প্রধান কারণ, দক্ষিণ ও পশ্চিম এশিয়ায় চীনের প্রভাব কমানো। চলতি বছরের মে মাসে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা যথাক্রমে অজিত দোভাল ও জেক সুলিভানের বৈঠকে এই প্রকল্প নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা হয়। তারপর কথাবার্তা এগোয় দ্রুতগতিতে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগ্রহ বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে পূর্ব লাদাখে চীনের অনমনীয় মনোভাবের দরুন। আকসাই চীন ও পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের গিলগিট ও বালটিস্তানের মধ্য দিয়ে চীন তার ‘বিআরআই’ প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিয়ে চলেছে। ভারতের আপত্তি তারা আমলেই আনছে না। এই পরিস্থিতিতে পাল্টা এমন কিছু একটা করতে তিনি আগ্রহী ও উৎসাহী হয়েছেন স্বাভাবিক কারণেই।
তবে এই বিরাট প্রকল্পের অর্থায়ন কীভাবে হবে, জি-২০তে যোগদানকারী এই দেশগুলোর কোনো নেতাই তা স্পষ্ট করেননি। প্রকল্প শেষের সময়সীমাও নির্ধারণ করা হয়নি। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, এখনো অনেক জটিলতা কাটানো বাকি। শনিবার যা হয়েছে, তা নিতান্তই নীতিগত ঘোষণা। আনুষ্ঠানিক সলতে পাকানোর কাজ শুরু হয়েছে বলা যায়।
এই প্রকল্পের কথা ঘোষণার সময় মোদি বলেন, ‘আমরা শুধু বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধিতে আগ্রহী নই, আমরা বিশ্বাসের যোগসূত্রও বাড়াতে চাই।’ গোটা সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী মোদি বারবার এই ‘বিশ্বাসের ঘাটতির’ কথাই উচ্চারণ করেছেন। বুঝিয়েছেন, সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মূল আধার বিশ্বাস। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেনও সেই সুরে সুর মিলিয়ে বলেছেন, ‘এক বিশ্ব, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎ আজকের জোটবদ্ধতার মূল মন্ত্র। এই নতুন অর্থনৈতিক করিডর চুক্তি সেই মন্ত্র মেনে সংযোগের ক্ষেত্র প্রসারিত করবে। তাই এই প্রকল্প ঐতিহাসিক ও বিপুল সম্ভাবনাময়।’
এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে পাকিস্তান ও চীনের বাধা উপেক্ষা করে পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে ভারতের যোগসূত্র সরাসরি স্থাপিত হবে। পাকিস্তানের ওপর কোনোভাবেই আর ভারতকে নির্ভরশীল হতে হবে না। আরব দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক দিন দিন উন্নত হচ্ছে। এর ফলে এই করিডর বাণিজ্য বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।
প্রাচীনকালে ভারতীয় উপমহাদেশের সঙ্গে ইউরোপের যোগসূত্র স্থাপন করত ‘স্পাইস রুট’। এই প্রকল্পকে তাই ‘নতুন স্পাইস রুট’ বলে বর্ণনা করা হচ্ছে। প্রস্তাব অনুযায়ী, মোট দুই করিডর মিলে এই প্রকল্প চূড়ান্ত হবে। একটি ‘ইস্ট-ওয়েস্ট’, যা ভারতের সঙ্গে পশ্চিম এশিয়ার সংযোগকারী। অন্যটি ‘নর্দান করিডর’, যা পশ্চিম এশিয়ার যোগসূত্র হবে ইউরোপের সঙ্গে।
চীন এখনো এই প্রকল্প নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। তারা এটি কীভাবে নেবে, তা দেখার। ভারতের ঘনিষ্ঠতম প্রতিবেশী ও বন্ধু বাংলাদেশ এই প্রকল্পে উৎসাহিত হয় কি না, তা-ও দ্রষ্টব্য। ভারতের সঙ্গে সুমধুর সম্পর্ক সত্ত্বেও চীনের ‘বিআরআই’ প্রকল্পের সঙ্গী বাংলাদেশ। দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কও সুদৃঢ়। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব বৃদ্ধি আবার ভারতকে সব সময় শঙ্কিত রাখে।