বর্ষাকালে প্রেম হারানো দিনের কথা মনে পড়ে—মনে পড়ে প্রেমিকার কথা, জলের মতো মায়ের কথা। আরও না-থাকা অসংখ্য মুখের স্মৃতিও এসে থই থই করে মেঘলা দিনে। শীতকালেও একইভাবে তা মনে হয়। শীতকালে যেমন বিকেল হতে না-হতেই ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে আসে, তেমনি মানুষের মনেও হঠাৎ বিষণ্নতা ভর করে ফেলে। এটা হয় মূলত ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আচরণ ও সিদ্ধান্ত পরিবর্তিত হওয়ার কারণে। একে বলা হয় সিজনাল অ্যাফেকটিভ ডিজঅর্ডার (স্যাড)।
ঋতু পরিবর্তন মানুষের আবেগকে প্রভাবিত করে। এই প্রভাবে সৃষ্ট ডিজঅর্ডার অনেক সময় বিপজ্জনক পরিস্থিতির দিকে মানুষকে নিয়ে যেতে পারে। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতে পারে মানুষ। তবে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার শিখতে পারলে এই বিষণ্নতা বা ডিজঅর্ডার থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
ঋতু পরিবর্তন যে শুধু মানুষের আবেগকে প্রভাবিত করে, তা নয়। সাইকোলজিক্যাল সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত একটি সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, নানাভাবে ঋতু মানুষের মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করতে পারে। মানুষের যৌনতা থেকে শুরু করে বুদ্ধিমত্তা ও সামাজিক কর্মকাণ্ডকেও প্রভাবিত করতে পারে।
কানাডার হাঁস বা কালো ভালুকের মতো প্রাণীরা ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিজের আচরণকেও পরিবর্তন করে নেয়—এটা এখন একটি স্বীকৃত বিষয়। তবে মানব মনোবিজ্ঞানের এই সূক্ষ্ম পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা খুব কম হয়েছে। যদিও মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সুস্থতা বোঝার জন্য এগুলো অপরিহার্য।
এসব বিষয়ে গবেষকেরা কিছু ফলাফল উল্লেখ করেছেন—
শীতকালে যে মন বিষণ্ন হয়ে থাকে, এই বিষয়কে বলা হয় ‘সিজনাল অ্যাফেকটিভ ডিজঅর্ডার (স্যাড)’। এর লক্ষণ হলো, মনে দুঃখ বা উদ্বেগ ভর করে, যা অন্তত দুই সপ্তাহ স্থায়ী হয়। নিজেকে হতাশ ও মূল্যহীন মনে হয়। শক্তি হ্রাস পায়, খাওয়া বেড়ে যায় এবং অতিরিক্ত ঘুম পায়।
এ কারণে অনেকের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। বিষণ্নতা চেপে বসে মনে। এই সাধারণ বিষণ্নতা ‘শীতকালীন ব্লুজ’ নামে পরিচিত। ২০১০ সালের শুরুর দিকে নিউইয়র্কে ইথাকার কর্নেল ইউনিভার্সিটির গবেষকেরা ৮৪টি দেশের ৫০ কোটি ৯০ লাখ টুইটের বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করেছেন। গবেষকেরা দেখেছেন, দিনের আলোর সময়ের পরিবর্তন ও পোস্টের মানসিক বিষয়বস্তুর মধ্যে একটি সম্পর্ক আছে। দিন ছোট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই টুইটার ব্যবহারকারীদের কম ইতিবাচক শব্দ ব্যবহারের প্রবণতা দেখা গেছে।
শীতকালীন ব্লুজ ও স্যাডের অনেক সম্ভাব্য ব্যাখ্যা আছে। এর একটি জনপ্রিয় তত্ত্ব হলো, সার্কাডিয়ান রিদম। এই তত্ত্বে আলোর মাত্রা কমে গেলে তা শারীরিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করে। বিষয়টি মানসিক প্রক্রিয়ায় জড়িত নিউরোট্রান্সমিটারের সুস্থ নিয়ন্ত্রণকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এ থেকে পরিত্রাণে আলোক থেরাপি ব্যবহারের কথা বলা হয়। বিশেষ বাতি ব্যবহারের মাধ্যমে সূর্যের অনুকরণ করে শারীরিক প্রক্রিয়াকে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে। তবে পদ্ধতিগত পর্যালোচনা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে, প্রতিরোধমূলক চিকিৎসা হিসেবে এর কার্যকারিতার প্রমাণ সীমিত।
যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির স্বাস্থ্য মনোবিজ্ঞানী ক্যারি লিবোভিটজ সাম্প্রতিক এক গবেষণায় পরামর্শ দিয়েছেন যে এতে আমাদের মানসিকতাও একটি ভূমিকা পালন করতে পারে। ট্রমসো বিশ্ববিদ্যালয়ে জোয়ার ভিটারসোর সঙ্গে করা যৌথ গবেষণায় লিবোভিটজ নরওয়ের বিভিন্ন অঞ্চলের অংশগ্রহণকারীদের শীতের প্রতি তাঁদের মনোভাব সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলেন। ‘শীতকাল বিশেষভাবে বছরের সুন্দর সময়’ এই বক্তব্যের সঙ্গে অংশগ্রহণকারীদের মানসিক মূল্যায়ন করতে বলা হয়েছিল। কেউ বলেছেন, আমি শীতের মাসগুলোর স্বাচ্ছন্দ্য পছন্দ করি; কেউ বলেছেন, শীতকালের কোমল আলো তাঁর পছন্দ। লিবোভিটজ ও ভিটারস দেখেছেন, যাঁরা এই বক্তব্যগুলোর সঙ্গে একমত, তাঁরা ইতিবাচক আবেগ ও সন্তুষ্টি নিয়ে ঠান্ডা ও অন্ধকার পরিবেশের সঙ্গে আরও ভালোভাবে মোকাবিলা করার প্রবণতা রাখেন।
লিবোভিটস পরামর্শ দিয়েছেন, শীতের ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ ও আলিঙ্গন করতে শিখলে শীতকালীন ব্লুজকে পরাজিত করা সম্ভব।
সর্বোপরি এমন অনেক ঘটনার নিজের মানসিকতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। যাঁরা উদ্বেগজনিত রোগে আক্রান্ত, তাঁদের কগনিটিভ বিহেভিয়রাল থেরাপি পরিস্থিতির আরও ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় নিয়ে যেতে সাহায্য করতে পারে। এতে তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যেরও সামগ্রিক উন্নতি হয়। আচরণগত এই থেরাপি স্যাডের বিরুদ্ধেও কার্যকর হতে পারে, এমন কিছু প্রমাণও মিলেছে। এই কৌশল শীত, বসন্ত ও বর্ষাকালে মানুষের মানসিক অবস্থার উন্নতি করতে সহায়তা করতে পারে।
বিষয়টা এমন নয় যে, কেবল একা থাকলেই মানসিক তীক্ষ্ণতা কমে যায়। বরং অনেকের মধ্যে থাকলেও দিনের আলো কমে যাওয়ার সঙ্গে মানুষের মানসিক তীক্ষ্ণতা কমে যেতে পারে। নেদারল্যান্ডসে রটারডামের ইরাসমাস ইউনিভার্সিটি মেডিকেল সেন্টারের স্যান মুলদিক ও তাঁর সহকর্মীরা সম্প্রতি ৪৫ বছর বা এর বেশি বয়সী ১০ হাজারের বেশি অংশগ্রহণকারীর তথ্য বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁরা দেখেছেন, গ্রীষ্মের তুলনায় শীতকালে শেখা, স্মৃতিশক্তি ও মনোযোগ কমে যায়।
এই ঋতু পরিবর্তনের কারণ এখনো অজানা। দুর্বল জ্ঞানভিত্তিক কর্মক্ষমতা মানুষের সাধারণভাবে হতাশাগ্রস্ত অনুভূতির পরিণতি হতে পারে। যখন নীল রং অনুভূত হয়, তখন সরাসরি অন্য কিছু চিন্তা করা কঠিন হয়। আরেকটি বিষয় হলো, মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যকে সহায়তা করে ভিটামিন ডি। শীতকালে আলো ও সময়ের ঘাটতির কারণে এই ভিটামিনের ঘাটতি দেখা দেয়। মানুষের ত্বক সূর্যালোকের সংস্পর্শে এলে শরীর সেই আলো নিয়ে ভিটামিন ডি উৎপাদন করে। আবার মানুষ খাবার থেকে পুষ্টি শোষণ করতে পারে, তবে শুধু খাবার থেকে পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি পাওয়া খুব কঠিন।
একই সময়ের মধ্যে ডিমেনশিয়া রোগনির্ণয়ের সংখ্যা বেড়ে যায়। পরীক্ষাটি মূলত বিজ্ঞানীদের এর কারণ বুঝতেও সাহায্য করতে পারে। শীতকালে মানসিক শক্তির সামান্য হ্রাস জ্ঞানভিত্তিক কর্মক্ষমতা হ্রাসের বিদ্যমান উপসর্গকে বাড়িয়ে দিতে পারে, যা আরও বেশি মানুষকে ডিমেনশিয়ার ক্লিনিক্যাল মানদণ্ড পূরণে পরিচালিত করে।
মানুষের আচরণ সামাজিক সংযোগকেও প্রভাবিত করতে পারে। ‘সামাজিক থার্মোরেগুলেশন’ তত্ত্ব অনুসারে, মানুষ শারীরিক উষ্ণতা ও আরামের উৎসের জন্য অন্যদের ওপর নির্ভর করে। একইভাবে পেঙ্গুইন ও অন্য অনেক প্রাণী স্বাভাবিকভাবেই তাদের শরীরের তাপ ভাগ করে নেওয়ার জন্য একসঙ্গে জড়ো হয়ে থাকে।
এই তত্ত্ব যদি সত্য হয়, তাহলে কম তাপমাত্রা বৃহত্তর সামাজিক সংযোগ খোঁজার জন্য প্ররোচিত করবে। এই ভবিষ্যদ্বাণী পরীক্ষার জন্য ফ্রান্সের ইউনিভার্সিটি গ্রেনোবেল আল্পসে হ্যান্স আইজারম্যানের নেতৃত্বে একটি দল অংশগ্রহণকারীদের চিন্তার বিষয়বস্তু অনুসন্ধানে বিভিন্ন প্রশ্ন করার সময় গরম বা ঠান্ডা পানীয় রাখতে বলেছিলেন। তিনি দেখেছেন, যারা গরম পানীয় পান করেন, তাঁদের চেয়ে যাঁরা ঠান্ডা পানীয় পান করেন, তাঁরা কাছের প্রিয়জনদের কথা ভাবেন—যাঁরা তাঁদের সামাজিক সংযোগের প্রয়োজন পূরণ করবেন।
এসব ঘটনার আরও প্রমাণ পাওয়া যায় সিনেমা দেখার অভ্যাস থেকে। অনলাইন মুভি রেন্টালস থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, তাপমাত্রা কমে গেলে মানুষ অন্যান্য ঘরানার তুলনায় রোমান্টিক সিনেমা বেশি দেখেন। একাধিক পরীক্ষায় এটা প্রমাণিত হয়েছে। হৃদয়কে উষ্ণ করার মতো সিনেমা দৃশ্যত শীত বা গুমোট পরিবেশের কারণে মানসিক উষ্ণতা ও স্নেহের জন্য মানুষের উদ্ভূত আকাঙ্ক্ষা পূরণ করে।
এদিকে মানুষের যৌন কার্যকলাপ আরও জটিল। পেনসিলভানিয়ার ভিলানোভা ইউনিভার্সিটি ও নিউ জার্সির রাটগার্স ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের উভয় ক্ষেত্রেই গুগল ব্যবহারকারীরা শীতের মাঝামাঝি ও গ্রীষ্মের শুরুতে পর্নোগ্রাফি বেশি খোঁজেন। তাঁরা ডেটিং ওয়েবসাইটেও বেশি ঘোরেন। এর পেছনে অনেক কারণ জড়িত থাকতে পারে। তবে এটি অনুমান করা যেতে পারে যে শীতকাল বৃহত্তর মানুষের যোগাযোগের জন্য তাদের আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিফলিত করতে পারে।
বিবিসি, সিএনএন ও কোয়েন্টা সাময়িকী অবলম্বনে