মার্কিন কম্পিউটার বিজ্ঞানী এবং প্রযুক্তি নিয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী রে কার্জউইল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। ২০০৫ সালে তিনি ‘দ্য সিঙ্গুলারিটি ইজ নিয়ার’ নামের একটি বই লেখেন। বইটির কাটতি ছিল বেশ ভালোই। তাঁর বইটি ২০২৯ সালের মধ্যে কম্পিউটার মানবস্তরের বুদ্ধিমত্তায় পৌঁছে যাবে, এমন নানা ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে, যা নানা বৈজ্ঞানিক জল্পনাকল্পনার জন্ম দিয়েছে।
এ বইয়ে কার্জউইল ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, ‘২০৪৫ সালের দিকে আমরা কম্পিউটারের সঙ্গে একত্র হয়ে অতিমানব হয়ে উঠব।’ তিনি একে ‘দ্য সিঙ্গুলারিটি’ বলেছেন। ওই বই লেখার দুই দশক পার হয়ে গেছে। ৭৬ বছর বয়সী কার্জউইলের বইটির নতুন একটি পর্ব বা সিকুয়েল আসছে। তিনি এর নাম দিয়েছেন ‘দ্য সিঙ্গুলারিটি ইজ নিয়ারার।’ এর অর্থ সিঙ্গুলারিটি আরও কাছাকাছি।
কার্জউইল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তা এখন আর আগের মতো কল্পকাহিনি মনে হচ্ছে না। কার্জউইল নিজে মার্কিন প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান গুগলে এআই-বিষয়ক প্রধান গবেষক হিসেবে কাজ করেন। তিনি সেখানকার এআই ভবিষ্যৎ-দ্রষ্টা। সম্প্রতি তিনি যুক্তরাজ্যের দ্য অবজারভারকে এক সাক্ষাৎকারে তাঁর লেখকজীবন, উদ্ভাবন ও প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলেছেন।
আরেকটি নতুন বই কেন লিখলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে গুগলের এই গবেষক বলেন, ‘“দ্য সিঙ্গুলারিটি ইজ নিয়ারার” ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলে, কিন্তু তা ২০ বছর আগে লেখা। তখন মানুষ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কী, তা-ই জানত না। আমার কাছে পরিষ্কার ছিল কী ঘটতে যাচ্ছে, কিন্তু সবার কাছে তা ছিল না। আমরা এখন কতটা এগিয়েছি, তা আবার দেখার দরকার। এখন এআইয়ের মূল হিসেবে পরিচিত লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলগুলো (এলএলএম) স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে ব্যবহার করা যাচ্ছে এবং এ ক্ষেত্রে সাফল্য আসছে।’
জবাবে কার্জউইল বলেন, আমি ধারাবাহিক থেকেছি। ২০২৯ সালে মানুষের স্তরের বুদ্ধিমত্তা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইনটেলিজেন্সের (এজিআই) উভয়ই ক্ষেত্রে কিছুটা পার্থক্য থাকবে। মানুষের স্তরের বুদ্ধিমত্তা অর্জনের সাধারণ অর্থ হচ্ছে, যেকোনো একটি ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সবচেয়ে দক্ষতাসম্পন্ন মানুষের ক্ষমতায় পৌঁছেছে এবং ২০২৯ সাল নাগাদ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা মানুষের সক্ষমতা অর্জন করবে।
আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইনটেলিজেন্সের অর্থ হচ্ছে, মানুষ যা করতে পারে, তা সবই এআই করতে পারে। তবে এজিআই তার করতে পারবে, তা আরও উচ্চতর স্তরে। এজিআই বিষয়টি কঠিন শোনাচ্ছে বটে, তবে দুটিই একই সময়ে আসছে। তবে আমি এজিআই অর্জনের জন্য পাঁচ বছর সময় ধরেছি, যা মূলত রক্ষণশীল ধারণা। টেসলার প্রধান নির্বাহী ইলন মাস্ক সম্প্রতি বলেছেন, ‘মাত্র দুই বছরের মধ্যেই এজিআই অর্জন সক্ষম।’
জবাবে কার্জউইল বলেন, আমিই একমাত্র ব্যক্তি, এআই নিয়ে আজকের এই আগ্রহের বিষয়ে পূর্বাভাস দিয়েছিলাম। ১৯৯৯ সালে মানুষ ভাবত, এআই সক্ষমতা অর্জনে ১০০ বছর বা তার বেশি সময় লাগবে। আমি বলেছিলাম, মাত্র ৩০ বছর যেতে দিন, দেখুন তারপর কী ঘটে। এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চালক হলো কম্পিউটিং শক্তির পরিমাণ বেড়ে যাওয়া। আর এর পেছনে ব্যাপক অর্থ ব্যয় করা। আমরা প্রতি ১৫ মাসে মূল্য-কর্মক্ষমতা দ্বিগুণ করছি। প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়ায় মাত্র দুই বছর আগে আমরা এলএলএম নিয়ে কাজ শুরু করেছি।
এমন প্রশ্নে কার্জউইলের জবাব, এ ক্ষেত্রে দরকার আরও বেশি কম্পিউটারের শক্তি। কম্পিউটারের ক্ষমতা ধীরে ধীরে বাড়ছে। এতে এআইয়ের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক স্মৃতিশক্তি বাড়বে, সাধারণ জ্ঞানের যুক্তি এবং সামাজিক মিথস্ক্রিয়াতে উন্নতি করতে সক্ষম করবে। এখনো এসব ক্ষেত্রে ঘাটতি থেকে গেছে। এগুলোর বাধা দূর হলে আমাদের আরও উন্নত অ্যালগরিদম প্রয়োজন হবে, যাতে আরও প্রশ্নের উত্তর দিতে আরও তথ্য প্রয়োজন হবে।
কার্জউইল বলেন, বর্তমানে এলএলএম হ্যালুসিনেশন একটি সমস্যা (এ ধরনের সমস্যায় এআই থেকে অযৌক্তিক ও অপ্রাসঙ্গিক উত্তর পাওয়া যায়।) কিন্তু এ সমস্যা ধীরে ধীরে কমে আসবে। ২০২৯ সাল নাগাদ এ পরিস্থিতি আরও ভালো হবে। দুই বছর আগে যে ধরনের সমস্যা ছিল, এখন তা অনেকটাই কমে এসেছে। এ ধরনের পরিস্থিতি তখনই ঘটে, যখন এআইয়ের কাছে সঠিক জবাব থাকে না বা এর উত্তর সে জানে না। এ জন্য সে সেরা বিষয়টি খোঁজার চেষ্টা করে; কিন্তু তা অনেক সময় ভুল বা অযৌক্তিক হয়ে দেখা দেয়। এআই উন্নত (স্মার্ট) হলে নিজের জ্ঞান সম্পর্কে ভালো বুঝতে পারবে। এটি আরও ভালো ও নিখুঁতভাবে মানুষের কাছে জবাব দেবে। যা সে জানে না, সে বিষয়টিও ভালোভাবে তুলে ধরতে পারবে।
এমন প্রশ্নে কার্জউইল বলেন, বর্তমানে আমাদের একটি মস্তিষ্কের আকার আছে, যা আমরা স্মার্ট হওয়ার জন্য অতিক্রম করতে পারি না; কিন্তু ক্লাউড আরও উন্নত হচ্ছে, যার কোনো সীমানা থাকছে না। (ক্লাউড কম্পিউটিং হচ্ছে কম্পিউটার রিসোর্স, যেমন কম্পিউটার হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার, নেটওয়ার্ক ডিভাইস প্রভৃতি ব্যবহার করে কম্পিউটার নেটওয়ার্কের মাধ্যমে (বিশেষত ইন্টারনেট) কোনো সার্ভিস বা সেবা দেওয়া। ক্লাউড কম্পিউটিং কোনো নির্দিষ্ট প্রযুক্তি নয়, বেশ কয়েকটি প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করা একটা মডেল।) সিঙ্গুলারিটি একধরনের রূপক, যা পদার্থবিদ্যা থেকে নেওয়া। আমাদের মস্তিষ্ক যখন ক্লাউডের সঙ্গে যুক্ত হয়, তখন সিঙ্গুলারিটি তৈরি হয়। আমরা আমাদের প্রাকৃতিক বুদ্ধিমত্তা ও আমাদের সাইবারনেটিক বুদ্ধিমত্তার সংমিশ্রণ হতে যাচ্ছে এবং উভয়ই একটিতে পরিণত হব। এটাকে সম্ভব করতে তৈরি হবে ব্রেন-কম্পিউটার ইন্টারফেস, যা মূলত একধরনের ন্যানোবটস বা রোবট আকৃতির কণা। এসব কণা মস্তিষ্কের কোনো ক্ষতি ছাড়াই সূক্ষ্ম রক্তনালি দিয়ে মস্তিষ্কে ঢুকবে। ২০৪৫ সাল নাগাদ আমরা আমাদের বুদ্ধিমত্তা কয়েক লাখ গুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে নিতে পারব। এটা আমাদের সচেতনতা ও চেতনাকে আরও গভীর করতে চলেছে।
এটা কেমন হবে, তা কল্পনা করা কঠিন; কিন্তু এটা খুব আকর্ষণীয় হবে, তা মনে হচ্ছে না।
জবাবে কার্জউইল বলেন, মনে করুন, আপনার স্মার্টফোনটি আপনার হাতে না থেকে মাথার মধ্যে রয়েছে। আপনি যদি কোনো প্রশ্ন আপনার মস্তিষ্ককে করেন, তখন মস্তিষ্ক ক্লাউডে গিয়ে তার একটি উত্তর খুঁজে দেবে। ঠিক যেভাবে ফোন কাজ করে। এটা তৎক্ষণাৎ জানা যাবে। তখন কোনো ইনপুট বা আউটপুট বা নির্দেশ দেওয়ার ঝামেলা থাকবে না। এটা কখন হয়ে যাবে, তা বুঝতেও পারবেন না। মানুষ তখন বলবে, ‘এটা আমার দরকার নেই।’ তখন মানুষের আর ফোনের দরকার পড়বে না।
উন্নত এআই সিস্টেমের অস্তিত্বের ঝুঁকি কী ধরনের? এআই কি অপ্রত্যাশিত শক্তি অর্জন ও মানবতার মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে? এআই খাতের গডফাদারখ্যাত জিওফ্রে হিনটন গত বছর এই উদ্বেগ থেকেই গুগল ছেড়েছেন। এ ছাড়া ইলন মাস্কের মতো বড় বড় প্রযুক্তি উদ্যোক্তার অনেকেই এ নিয়ে সতর্ক করছেন। এ মাসের শুরুতে মার্কিন প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান ওপেনএআই ও গুগল ডিপমাইন্ডের কর্মকর্তারা এ খাতের কর্মীদের সুরক্ষার দাবি জানিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে কার্জউইল বলেন, বিপদের একটি অধ্যায় আমার বইয়ে আছে। সামনে এগোনোর সেরা উপায় বের করার চেষ্টা করেছি। এ জন্য আমি আসিলোমার এআই প্রিন্সিপাল (এআই উন্নয়নের নীতিমালা) তৈরি করেছি। আমাদের এখানে সম্ভাব্যতা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং এআই কী করছে, তা নিরীক্ষণ করতে হবে; কিন্তু শুধু এর বিরুদ্ধে থাকাটা বোধগম্য নয়। সুবিধাগুলো দেখতে হবে।
কার্জউইল বলেন, মানুষ বনাম এআই কখনোই হবে না; বরং এআই হবে আমাদের ভেতরে। এটি আমাদের নতুন কিছু সৃষ্টির জন্য সহায়তা করবে, যে সুবিধা আগে ছিল না। ভবিষ্যৎ হবে বেশ চমৎকার।
দ্য গার্ডিয়ান অবলম্বনে