নওয়াজ শরিফকে রাষ্ট্রীয় কোনো পদে আজীবন নিষিদ্ধ করেছিলেন পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট। চার বছর লন্ডনে স্বেচ্ছা নির্বাসনে থেকে দেশে ফিরে আসন্ন নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন তিনি। এর আগে সৌদি আরবে দশ বছর স্বেচ্ছা নির্বাসন থেকে ফিরে ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন নওয়াজ।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে তিনি কখনো নায়ক, কখনো খলনায়ক। একবার শীর্ষ নীতিনির্ধারকের ভূমিকায়, তো আরেকবার কারাবন্দী। কখনো আবার দেশছাড়া, বছরের পর বছর নির্বাসনে। দেশে ফিরে আবার মর্যাদার আসনে। তাঁর নাম মিয়া মুহাম্মদ নওয়াজ শরিফ।
প্রায় পাঁচ দশক ধরে পাকিস্তানের রাজনীতিতে বড় এক নাম নওয়াজ শরিফ। একবার-দুবার নয়, তিন-তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী তিনি। যদিও কোনোবারই প্রধানমন্ত্রিত্বের মেয়াদ পূরণ করতে পারেননি। কখনো দুর্নীতির দায়ে পদ ছাড়তে হয়েছে তাঁকে, কখনোবা সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন।
এবার প্রায় চার বছর স্বেচ্ছানির্বাসন শেষে গত অক্টোবরে দেশে ফিরেছেন নওয়াজ। লক্ষ্য ৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় নির্বাচন। ইতিমধ্যে লাহোরের একটি আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন তিনি। প্রাথমিকভাবে মনোনয়নপত্র বৈধ হিসেবে গৃহীত হয়েছে। যদিও নির্বাচনে প্রার্থিতা থাকবে কি না, তা নিয়ে বিভক্ত মত আছে দেশটির আইনজ্ঞদের।
২০১৬ সালে পানামা পেপারস কেলেঙ্কারিতে নাম আসে নওয়াজের। এ ঘটনায় অর্থ পাচারের মামলায় ২০১৭ সালে অভিযুক্ত হয়ে আদালতের রায়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে হয় তাঁকে। আদালত সংবিধানের ৬২ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তাঁকে রাষ্ট্রীয় সব পদে অযোগ্য ঘোষণা করেন। একই কারণে পরের বছর আদালতের রায়ে নিজ দল পাকিস্তান মুসলিম লিগের (পিএমএল-এন) প্রধানের পদও ছাড়তে হয় নওয়াজকে।
নওয়াজ শরিফ আবার দৃশ্যপটে। ইমরান খানের সঙ্গে সেনাবাহিনীর দূরত্বই নওয়াজকে আবার দৃশ্যপটে আসার সুযোগ করে দিয়েছে—এ কথা বলাই যায়।
পাকিস্তানের সর্বশেষ সংশোধিত নির্বাচনী আইন অনুযায়ী, দুর্নীতির মামলায় সাজা হলে সেই ব্যক্তি সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচনে অযোগ্য হন। কিন্তু নওয়াজকে সংবিধানের ৬২ নম্বর অনুচ্ছেদের কথা উল্লেখ করে রাষ্ট্রীয় কোনো পদে আজীবন নিষিদ্ধ করেছেন সুপ্রিম কোর্ট। কেউ বলছেন, সংশোধিত নির্বাচনী আইনবলে পার পাবেন নওয়াজ, আবার কেউ বলছেন নওয়াজকে সংবিধানের অনুচ্ছেদ উল্লেখ করে আজীবন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাই নির্বাচনী আইনে তাঁর পার পাওয়ার সুযোগ নেই।
পিএমএল-এন ক্ষমতায় থাকতে আইনবিষয়ক বিশেষ সহকারী ছিলেন ব্যারিস্টার জাফরুল্লাহ খান। পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম ডনকে তিনি বলেন, নওয়াজ শরিফ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন। কারণ, সংশোধিত নির্বাচনী আইনে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর নিষিদ্ধ রাখার কথা বলা হয়েছে। তারপরও কেউ নওয়াজের প্রার্থিতার বিরুদ্ধে আবেদন করলে তাতে আদালত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন। তবে জাফরুল্লাহ খানের সঙ্গে একমত নন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী রাজা ইনাম আমিন মিনহাজ। তাঁর মত, সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের ৬২ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নওয়াজ শরিফকে আজীবন নিষিদ্ধ করেছেন। তাই সুপ্রিম কোর্টেই বিষয়টি সুরাহার হতে পারে। যেটা নওয়াজসহ সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।
নওয়াজ অবশ্যই প্রার্থী হওয়ার পথে ইতিমধ্যে দুটি বড় বাধা পেরিয়েছেন। লন্ডনের অ্যাভেনফিল্ডে চারটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কেনার অর্থের বৈধ উৎস দেখাতে না পারায় ২০১৮ সালের জুলাইয়ে ১০ বছর কারাদণ্ড হয়েছিল নওয়াজের। একই বছর ডিসেম্বরে আল আজিজিয়া স্টিল মিলস দুর্নীতি মামলায় ৭ বছরের কারাদণ্ড হয় তাঁর।
এসব মামলায় আগাম জামিন পেয়ে গত অক্টোবরে দেশে ফেরেন নওয়াজ। এরপর গত ২৯ নভেম্বর অ্যাভেনফিল্ড দুর্নীতি মামলায় খালাস পান তিনি। চলতি ডিসেম্বরে নওয়াজের বিরুদ্ধে হওয়া আল আজিজিয়া মামলার শাস্তিও বাতিল করেছেন আদালত।
২০১৮ সালের জুলাইয়ে দুর্নীতির মামলায় কারাদণ্ডাদেশ হওয়ার এক সপ্তাহ পর গ্রেপ্তার করা হয় নওয়াজকে। কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। নেওয়া হয় হাসপাতালে। পরে আদালতের অনুমতি নিয়ে ২০১৯ সালের নভেম্বরে চিকিৎসার জন্য লন্ডন যান। এটা ছিল মূলত স্বেচ্ছা নির্বাচন। তখন হয়তো অনেকে ভেবেছিলেন, এটাই নওয়াজের রাজনীতির শেষ অধ্যায়।
তবে দেশটি পাকিস্তান। দেশটির রাজনীতিতে যেন শেষ কথা বলতে কিছু নেই। তাই ধীরে ধীরে পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। ২০১৮ সালে নির্বাচনে সেনাবাহিনীর আশীর্বাদ নিয়ে ক্ষমতায় আসা ইমরান খানের সঙ্গে সেই সেনাবাহিনীরই সম্পর্কে চিড় ধরে। যার পরিণতিতে গত বছরের এপ্রিলে পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে হেরে প্রধানমন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন ইমরান। প্রধানমন্ত্রী হন নওয়াজেরই ছোট ভাই ও পিএমএলের (এন) চেয়ারম্যান শাহবাজ শরিফ। এরপর পুরোনো সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে যেতে থেকে। তারই ধারাবাহিকতায় আগাম জামিন নিয়ে গত অক্টোবরে দেশে ফেরেন নওয়াজ শরিফ।
এবার চলুন একটু অতীতের দিকে তাকাই। দেখি, লাহোরে ব্যবসায়ী পরিবারে জন্ম নেওয়া নওয়াজ কীভাবে রাজনীতিতে নিজের অবস্থান পোক্ত করলেন। নওয়াজ রাজনীতিতে পা রাখেন গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে। আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তান মুসলিম লিগে তিনি যোগ দেন ১৯৭৬ সালে। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়া শেষে রাজনীতিতে যোগ দেওয়া এই তরুণ নজর কাড়েন তৎকালীন সেনাশাসক জেনারেল জিয়াউল হকের। ১৯৮১ সালে জেনারেল জিয়া তাঁকে পাঞ্জাব প্রদেশের অর্থমন্ত্রী নিয়োগ দেন। নওয়াজের নেতৃত্ব দেওয়ার গুণও অসাধারণ। সব মিলে নওয়াজকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। ১৯৮৫ সালে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন নওয়াজ।
বলা হয়ে থাকে, জেনারেল জিয়া পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) তৎকালীন নেত্রী বেনজির ভুট্টোকে মোকাবিলার জন্য একজন রাজনীতিককে খুঁজছিলেন। এ জন্য নওয়াজকেই বেছে নেন তিনি। অল্প সময়ের মধ্যে সেনাবাহিনীর খুব কাছের রাজনীতিকদের একজন হয়ে যান নওয়াজ।
সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক আর নেতৃত্ব দেওয়ার গুণ—দুইয়ের যোগফলে ১৯৯০ সালে প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন নওয়াজ শরিফ। বলা হয়, নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর স্বার্থের সংঘাতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে চিড় ধরে। এর জের ধরেই তিন বছরের মাথায় দুর্নীতির দায়ে ক্ষমতা হারান নওয়াজ। ১৯৯৩ সালে তিনি নিজের দল পিএমএল (এন) প্রতিষ্ঠা করেন। দল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাজনীতিতে নিজের নামের ব্র্যান্ড তৈরি করেন নওয়াজ। ঠিক পরের জাতীয় নির্বাচনেই তার ফলও পান। ১৯৯৭ সালে নওয়াজ আবারও প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের ৬২ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নওয়াজ শরিফকে আজীবন নিষিদ্ধ করেছেন। তাই সুপ্রিম কোর্টেই বিষয়টি সুরাহার হতে পারে। যেটা নওয়াজসহ সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।রাজা ইনাম আমিন মিনহাজ, পাকিস্তানের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী
তবে এবারও মেয়াদ পূরণ করতে পারেননি নওয়াজ। ১৯৯৯ সালে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানে তাঁকে সরিয়ে দেন। অপহরণ ও দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত করে কারাবন্দী করা হয় তাঁকে। ১৪ মাস কারাভোগ করে রাজনীতি না করার শর্তে ক্ষমা পেয়ে স্বেচ্ছা নির্বাচনে চলে যান সৌদি আরব।
নওয়াজ ২০১১ সালে আবার পাকিস্তানে ফেরেন। ২০১৩ সালে জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। কিন্তু এবার প্রধানমন্ত্রিত্বের পাঁচ বছরের মেয়াদ পূরণ করতে পারেননি নওয়াজ। ২০১৭ সালে আদালতের নির্দেশে পদত্যাগে বাধ্য হন। এবার আদালতকে সামনে রেখে সেই সেনাবাহিনীই কলকাঠি নেড়েছে বলে মনে করা হয়।
সেই নওয়াজ আবার দৃশ্যপটে। ইমরান খানের সঙ্গে সেনাবাহিনীর দূরত্বই নওয়াজকে আবার দৃশ্যপটে আসার সুযোগ করে দিয়েছে—এ কথা বলাই যায়। দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হওয়ায় ইমরানকে তাঁর দল তেহরিক–ই–পাকিস্তানের (পিটিআই) প্রধানের পদ ছাড়তে হয়েছে। এমনকি ইমরানের দলের প্রতীক ‘ব্যাট’ পাওয়া নিয়েও আদালতে দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে। ইমরানের মনোনয়নপত্রও বাতিল করা হয়েছে। যদিও আদালতে যাওয়ার সুযোগ আছে তাঁর। বলা যায়, নির্বাচনে ইমরান তথা পিটিআইকে ঠেকাতে সবকিছুই করা হচ্ছে।
পিটিআই ছাড়া পাকিস্তানের আরেক বড় দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি)। পাকিস্তানের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির পিপিপি আসন্ন নির্বাচনে নওয়াজের দলের সঙ্গে তেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে পারবে বলে মনে হয় না।
সব মিলিয়ে পাকিস্তানের আসন্ন নির্বাচনের চিত্রনাট্য যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে হয়তো নওয়াজ শরিফ চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়ে যাবেন। পাকিস্তানের রাজনীতিতে ‘ফিনিক্স পাখির’ মতো পুনর্জন্ম হবে ৭৪ বছর বয়সী নওয়াজের।