ইসরায়েল গাজায় ১০০ দিন ধরে নজিরবিহীন ধ্বংসযজ্ঞে মেতে রয়েছে। এ ধ্বংসযজ্ঞের একমাত্র নাম জেনোসাইড বা জাতিহত্যা।
জেনোসাইড—লাতিন শব্দবন্ধটির দুটি অংশ; জেনোস বা জাতি ও সাইড বা হত্যা। কখনো কখনো জেনোসাইডের বাংলা ‘গণহত্যা’ বলা হলেও সেটি সম্ভবত সঠিক অর্থান্তর নয়। একাত্তরে আমরা পাকিস্তানিদের হাতে শুধু যে গণহত্যার শিকার হয়েছিলাম, তা নয়। বাঙালি জাতিকে নির্মূল করার এক গভীর চক্রান্তের অংশ হিসেবেই সেই গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল, সে কারণে সেটি ছিল জেনোসাইড বা জাতিহত্যা। একইভাবে আজ গাজায় যা ঘটছে, তা কেবল গণহত্যা নয়, জাতিহত্যা। ফিলিস্তিন (আরবি উচ্চারণে ফলাস্তিন) নামক জাতিকে আক্ষরিক অর্থে নির্মূল করার লক্ষ্য নিয়েই ইসরায়েল গাজায় ১০০ দিন ধরে নজিরবিহীন ধ্বংসযজ্ঞে মেতে রয়েছে। এ ধ্বংসযজ্ঞের একমাত্র নাম জেনোসাইড বা জাতিহত্যা।
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ নিয়ে জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইসিজে) বা আন্তর্জাতিক বিচার আদালত বা বিশ্ব আদালতে মামলা করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। জেনোসাইডের অভিযোগে এটি আইসিজের সামনে দ্বিতীয় মামলা, এর আগে গাম্বিয়া রোহিঙ্গা জাতিহত্যার অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করে। সে মামলা এখনো চলছে। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মামলায় দক্ষিণ আফ্রিকা একা নয়, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বৈশ্বিক দক্ষিণের অনেক দেশ, যাদের একটি বাংলাদেশ। গত সপ্তাহে মামলা শুনানির অংশ হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইসরায়েল তাদের প্রাথমিক বক্তব্য পেশ করেছে।
এই মামলার কেন্দ্রে রয়েছে ১৯৪৮ সালে গৃহীত আন্তর্জাতিক জেনোসাইড কনভেনশন বা চুক্তি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মানির হাতে সুপরিকল্পিত জাতিহত্যার অংশ হিসেবে ৬০ লাখ ইহুদি প্রাণ হারায়। এই ঘটনা যাতে আর না ঘটে, এই উদ্দেশ্য মাথায় রেখেই এই আন্তর্জাতিক চুক্তিটি প্রণয়ন করা হয়। এখন পর্যন্ত পৃথিবীর ১৫৩টি দেশ এই চুক্তিকে তাদের জন্য আজ্ঞানুবর্তী ‘আইন’ হিসেবে মেনে নিয়েছে। অন্য কথায়, এই আইনের ভিত্তিতে আইসিজে যদি কোনো দেশের ব্যাপারে কোনো রায় দেন, সে রায়ের বাস্তবায়ন নির্দেশিত দেশসহ বিশ্ব সংস্থার সব সদস্য আইনত মেনে চলতে বাধ্য। এটি কাগজে-কলমে লেখা থাকলেও বাস্তবে অবশ্য অনেক সময়েই তা ঘটে না; কারণ, তার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের কোনো প্রক্রিয়া বা হাতিয়ার আইসিজের এখতিয়ারে নেই। ২০২২ সালের মার্চ মাসে আইসিজে রাশিয়াকে ইউক্রেনে তাদের যুদ্ধ থামাতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। রাশিয়া সে রায় মানার কোনো প্রয়োজন দেখেনি। ২০০৪ সালে একই আদালত ইসরায়েলকে অধিকৃত ফিলিস্তিনে প্রতিবন্ধক দেয়াল নির্মাণ বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, ইসরায়েল সে নির্দেশ আদৌ আমলে নেয়নি।
যে ৮৪ পৃষ্ঠার তথ্য-উপাত্ত দক্ষিণ আফ্রিকা তার অভিযোগের স্বপক্ষে আদালতে উপস্থিত করেছে, তা থেকে কোনো সন্দেহ থাকে না গাজায় ইসরায়েলের লক্ষ্য শুধু হামাস নয়, ফিলিস্তিন নামক জাতিকে হয় নির্মূল করা, নয়তো এই অঞ্চল থেকে বহিষ্কার করা। এ কথা প্রমাণ করতে দক্ষিণ আফ্রিকাকে খুব কষ্ট করতে হয়নি। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী থেকে সেনা কমান্ডার পর্যন্ত বিস্তর কর্তাব্যক্তি কোনো রাখঢাক ছাড়াই বলেছেন, প্রত্যেক গাজাবাসীকে নিশ্চিহ্ন বা বহিষ্কার না করা পর্যন্ত তাদের অভিযান থামবে না। একজন মন্ত্রী হাতে তিন আঙুল গুনে বলেছেন, ফিলিস্তিনিদের সামনে তিনটি পথ খোলা আছে: পালাও, আত্মসমর্পণ করো, অথবা মরো। আরেক মন্ত্রী বলেছেন, গাজায় তাঁরা পানি, খাদ্য ও বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেবেন। সদম্ভে বলেছেন, এদের সবাইকে মিসরের সিনাই মরুভূমিতে ঠেলে পাঠানো হবে, গাজায় নতুন ইহুদি বসতি গড়ে তোলা হবে। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু পর্যন্ত বলেছেন, এই ‘মানবপশুদের’ নিশ্চিহ্ন না করা পর্যন্ত সামরিক অভিযান বন্ধ হবে না।
দক্ষিণ আফ্রিকা তাদের মামলার আবেদনপত্রে এই জাতীয় বিস্তর উদ্ধৃতি অক্ষরে অক্ষরে তুলে ধরে বলেছে, শীর্ষস্থানীয় নীতিনির্ধারকদের বক্তব্য ও গৃহীত সামরিক ব্যবস্থা থেকে স্পষ্ট, গাজায় ইসরায়েল কী চায়, কী তার ‘ইন্টেন্ট’। এ কোনো আত্মরক্ষা নয়, জাতিহত্যা। (পুরো নথি পড়তে ক্লিক করুন)
জবাবে ইসরায়েল দাবি করেছে, ফিলিস্তিনিরা নয়, তারাই জাতিহত্যা হুমকির সম্মুখীন। প্রকৃত সত্যকে বিকৃত করে দক্ষিণ আফ্রিকা জেনোসাইড চুক্তির অপব্যবহার করছে। ইসরায়েলের এই কথায় খুব যে ওজন আছে, সে কথা জায়নবাদীরা ছাড়া আর কেউ বলবে না। ইসরায়েলের অভ্যন্তরে হামাসের হামলা নিন্দনীয়, কিন্তু সেটি ইহুদি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত একটি জাতিহত্যা, এ কথা বলে পার পাওয়া কঠিন, বিশেষত নিহত মানুষের আনুপাতিক সংখ্যা ১ হাজার ২০০ বনাম প্রায় ২৪ হাজার।
একাধিক ইসরায়েলি পত্রিকা স্বীকার করেছে, এই মামলার ফলে ইসরায়েল তার অস্তিত্ব নিয়ে হুমকির মুখে পড়েছে। এ কথা বলার একাধিক কারণ রয়েছে। জেনোসাইড চুক্তিটির সঙ্গে ইসরায়েলের রাজনৈতিক অস্তিত্ব জড়িত, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সংঘটিত ‘হলোকাস্ট’ ব্যবহার করে এখনো তারা পশ্চিমা বিশ্বের সহানুভূতি দাবি করে থাকে। ইসরায়েল নিজেই এখন সেই জাতিহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত। নিজের জন্য যে নৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব সে দাবি করে থাকে, আইসিজের রায় তার বিরুদ্ধে গেলে তেমন দাবির আর কোনো যৌক্তিক মূল্যই থাকবে না। সে নিজে বিশ্বের মানুষের ঘৃণার সম্মুখীন হবে।
দক্ষিণ আফ্রিকা যে এমন মামলা করবে, তা সম্ভবত ইসরায়েলের হিসাবের বাইরে ছিল। এই মামলা যে এত দ্রুত এত অধিক সংখ্যক দেশের সমর্থন অর্জন করবে, সেটাও সে ভাবেনি। মামলা আদালতে ওঠার পর থেকেই নেতানিয়াহু তাঁর সুর পাল্টে ফেলেছেন। দুই দিন আগেও তিনি বলেছেন, গাজা থেকে সরে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা তাঁর নেই। এখন বলছেন, গাজা দখলে রাখার কোনো ইচ্ছা তাঁর নেই। তিনি নিজের মন্ত্রিসভার সদস্যদের সাবধান করে বলেছেন, তাঁরা যেন এমন কোনো কথা না বলেন, যা এই মামলায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে পারে।
ইসরায়েলের পক্ষে উত্থাপিত যুক্তিপত্রে বলা হয়েছে, গাজায় তার অভিযান শুধু নিজের আত্মরক্ষার জন্যই করা। কোনো কোনো রাজনীতিক বা সেনাসদস্য বেফাঁসে যে কথা বলেছেন, তা রাজনৈতিক বক্তব্য, ব্যক্তিগত আবেগ থেকে বলা। অথচ এ কথাগুলো যে দেশের ‘ওয়ার ক্যাবিনেট’ বা যুদ্ধমন্ত্রী সভায় বলা হয়েছে, যাঁরা বলেছেন তাঁদের মধ্যে যুদ্ধমন্ত্রী ও বিচারমন্ত্রীও রয়েছে, সে কথা ইসরায়েল বেমালুম চেপে গেছে।
বিষয়টি শুধু ইসরায়েলের জন্য নয়, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কম অস্বস্তিকর নয়। চলতি বাইডেন প্রশাসন গোড়া থেকে আন্তর্জাতিক নীতি-নিয়মের প্রতি তার গভীর আনুগত্যের কথা বারবার বলে এসেছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বিশ্বজুড়ে যে আইনভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তারাই সে ব্যবস্থার আসল রক্ষক, এমন দাবিও তারা সময়-অসময় আমাদের জানিয়েছে। এই আইনভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার যুক্তি তুলে ধরেই ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুধু আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন নয়, তা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বলেও তারা দাবি করেছে। এখন ইসরায়েল যদি জাতিহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রও কার্যত কাঠগড়ায় দাঁড়াতে বাধ্য হয়। কারণ, গাজা অভিযান যতটা ইসরায়েলের, ঠিক ততটাই যুক্তরাষ্ট্রের। যে অস্ত্র-বারুদ-শ্বেত ফসফরাস এই হামলায় গড়ে প্রতিদিন প্রায় আড়াই শ নারী-পুরুষ ও শিশু হত্যায় ব্যবহৃত হচ্ছে, তার অধিকাংশ এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। আইনবিরুদ্ধ জেনেও বাইডেন প্রশাসন অন্তত দুবার জরুরি ভিত্তিতে ইসরায়েলে এমন সমরাস্ত্র প্রেরণ করেছে, যা মানবহত্যায় ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আইসিজে রায় দিলে তা কার্যত যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও যাবে।
আগেই বলেছি, অনেক সময় বাস্তবায়িত না হলেও আইসিজের সিদ্ধান্ত ‘বাইন্ডিং’ বা তার বাস্তবায়ন এই আদালতের সদস্যদের জন্য বাধ্যতামূলক। এই সিদ্ধান্ত আপিলযোগ্যও নয়। আমরা জানি খুব শিগগির এই আদালতের রায় আসবে না। আইনি প্রক্রিয়া মিটতে হয়তো দেড়-দুই বছর লেগে যাবে। কিন্তু রায় একসময় আসবে এবং যথেষ্ট আস্থার সঙ্গেই বলা যায় এই রায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যাবে। ধরে নেওয়া যাক তত দিনে এই যুদ্ধ বন্ধ হবে, কিন্তু গাজায় ইসরায়েলের অধিগ্রহণ বন্ধ হবে না, ফিলিস্তিনিদের ভাগ্যেরও কোনো পরিবর্তন হবে না। সে অবস্থায় ইসরায়েলকে জাতিহত্যার জন্য অভিযুক্ত করে কোনো রায় আইসিজে থেকে আসে, সঙ্গে কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ তাতে যুক্ত থাকে, তাহলে সে রায় যে ইসরায়েল মানবে না, তা–ও একরকম নিশ্চিত। সে অবস্থায় এই রায় বাস্তবায়ন করার আবেদন জানিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের দ্বারস্থ হতে পারে। সেখানে যুক্তরাষ্ট্র একজন স্থায়ী সদস্য, যেকোনো প্রস্তাব ‘ভেটো’ দেওয়া বা প্রত্যাখ্যানের ক্ষমতা তার রয়েছে। কিন্তু তেমন কিছু করার অর্থই দাঁড়াবে নিজের নৈতিক অবস্থান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে বড়াই, তার শেষ আব্রুটুকু হারিয়ে ফেলা।
ভাবা হচ্ছে, নিরাপত্তা পরিষদে আইসিজের রায়টি বিবেচনার জন্য পাঠানো হলে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো পক্ষে বা বিপক্ষে কোনো অবস্থান গ্রহণের পরিবর্তে ভোট দানে বিরত থাকবে। তাতে নিদেনপক্ষে মুখ রক্ষা হবে, সে কথা কোনো কোনো মহলে বলা হয়েছে।
কিন্তু ইসরায়েলের কী হবে? এত দিন ‘হলোকাস্টের’ যুক্তি দেখিয়ে সে ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে তার ঔপনিবেশিক অধিগ্রহণের পক্ষে সাফাই গেয়ে এসেছে। কিন্তু সে নিজেই যদি এক নতুন হলোকাস্টের রচয়িতা হয়, তাহলে কোথায় থাকবে সে সাফাই? গার্ডিয়ান মন্তব্য করেছে, ইসরায়েল হয়তো এই রায় উপেক্ষা করার চেষ্টা করবে, যেমন সে আগেও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ছাতার নিচে আশ্রয় নিয়ে সে হয়তো রক্ষা পেয়েছে, কিন্তু আইসিজের রায়ে জাতিহত্যার তকমা তার কপালে জুটলে বিশ্বের মানুষের ঘৃণা ও প্রত্যাখ্যান তাকে চিরকালের মতো কালিমালিপ্ত করে রাখবে। নিজের জন্য গভীর লজ্জা ও অপমান মেনে নেওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় তার থাকবে না। সে জন্য ইসরায়েলিরাই এই মামলাকে তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি বলে ভীতি প্রকাশ করেছে।
আগেই বলেছি, আদালতের বিচারপ্রক্রিয়া দীর্ঘদিন চলবে। অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকা আদালতের কাছে আবেদন রেখেছে, তাঁরা যেন ইসরায়েলকে অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ ও ত্রাণ প্রেরণের সুযোগ সৃষ্টির নির্দেশ দেন। এক-দুই সপ্তাহের মধ্যেই এই বিষয়ে আদালত তাঁর সিদ্ধান্ত জানাবেন। সে সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া হিসেবে ইসরায়েল কী ব্যবস্থা নেয়, তা থেকেই বোঝা যাবে জেনোসাইড প্রশ্নে আইসিজের রায় তারা কীভাবে গ্রহণ করবে।