রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আজ মঙ্গলবার তাঁর বার্ষিক ‘স্টেট অব দ্য নেশন’ ভাষণে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেছেন। মস্কো, রাশিয়া ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আজ মঙ্গলবার তাঁর বার্ষিক ‘স্টেট অব দ্য নেশন’ ভাষণে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেছেন। মস্কো, রাশিয়া ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

পশ্চিমাদের পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে নতুন হুমকি দিলেন পুতিন

ইউক্রেন নিয়ে পশ্চিমাদের নতুন করে হুমকি দিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তিনি ঐতিহাসিক পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি স্থগিত করেছেন। পাশাপাশি পারমাণবিক অস্ত্র (নতুন স্ট্র্যাটেজিক সিস্টেম) যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত রাখার ঘোষণা এবং নতুন করে পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালানোর হুমকি দিয়েছেন।  

ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভযানের এক বছর পূর্ণ হতে চলেছে। এই অভিযানের কারণে ছয় দশকের পশ্চিমাদের সঙ্গে সবচেয়ে বড় সংঘাতময় পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে রাশিয়া। এই প্রেক্ষাপটে মঙ্গলবার মস্কোয় বার্ষিক ‘স্টেস্ট অব দ্য নেশন’ ভাষণে ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, ইউক্রেনে রাশিয়া তাঁর লক্ষ্য অর্জন করবে। পাশাপাশি পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে রাশিয়াকে ধ্বংস করার চেষ্টায় লিপ্ত হওয়ার অভিযোগ করেছেন তিনি।

দেশের রাজনৈতিক ও সামরিক অভিজাতদের সামনে রেখে দেওয়া ওই ভাষণে পুতিন বলেন, ‘পশ্চিমের অভিজাতরা তাঁদের উদ্দেশ্য গোপন করেননি। তবে তাঁরা এটাও বুঝতে ব্যর্থ হননি যে যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়াকে পরাজিত করা অসম্ভব।’

যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধকে বৈশ্বিক সংঘাতে রূপ দিতে চাইছে অভিযোগ করে পুতিন বলেন, ‘নিউ স্টার্ট’ চুক্তিতে অংশগ্রহণ স্থগিত করছে রাশিয়া।

পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে শুধু নিউ স্টার্ট চুক্তিই কার্যকর ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ ২০১০ সালে এই চুক্তিতে সই করেছিলেন। চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া মোট কী পরিমাণ পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করতে পারবে, তার সংখ্যা নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। ২০২১ সালে চুক্তির মেয়াদ পাঁচ বছরের জন্য বাড়িয়েছিল সামরিক দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দুই দেশ।

২০২৬ সাল পর্যন্ত এই চুক্তির মেয়াদ ছিল। এর আওতায় এক দেশের কর্মকর্তারা আরেক দেশের পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার পরিদর্শনের সুযোগ পেতেন। তবে ইউক্রেন নিয়ে উত্তেজনার কারণে ওই পরিদর্শন ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন রুশ প্রেসিডেন্টের ঘোষণাকে ‘অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ও দায়িত্বহীন’ বলেছেন। যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর মহাসচিব ইয়ানেস স্টলটেনবার্গ বলেছেন, এতে বিশ্ব আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠল। প্রেসিডেন্ট পুতিনকে এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

রাশিয়ার রাজনৈতিক ও সামরিক অভিজাতদের সামনে রেখে ‘স্টেট অব দ্য নেশন’ ভাষণ দেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন

ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, ওয়াশিংটনের কেউ কেউ পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষার ওপর যে স্থগিত অবস্থা রয়েছে, তা ভাঙার কথা বিবেচনা করছেন। তিনি বলেন, ‘...যুক্তরাষ্ট্র যদি পরীক্ষা চালায়, তাহলে আমরা চালাব। কারোরই বিপজ্জক কাল্পনিক চিন্তা থাকা উচিত নয় যে কৌশলগত অস্ত্রের ক্ষেত্রে বৈশ্বিক যে সমতা আছে, তা ধ্বংস করা যাবে। এক সপ্তাহ আগে আমি একটি ডিক্রিতে সই করেছি, যাতে ভূমি থেকে নিক্ষেপণযোগ্য পারমাণবিক অস্ত্র নিক্ষেপের ব্যবস্থাগুলো (স্ট্র্যাটেজিক সিস্টেমস) কম্ব্যাট ডিউটিতে মোতায়েন করা হয়।’

পুতিন বলেছেন, ইউক্রেন রাশিয়ার ভেতরে এমন একটি স্থাপনায় হামলা করতে চেয়িছেল, যেখানে পরমাণু অস্ত্র রাখা আছে।

পারমাণবিক অস্ত্র

বিশ্বের মোট পারমাণবিক অস্ত্রের ৯০ শতাংশ রয়েছে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। নিউ স্টার্ট চুক্তিতে উভয় দেশের সর্বোচ্চ ১ হাজার ৫৫০টি দূরপাল্লার পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েনের সুযোগ ছিল। দুই দেশই ২০১৮ সালের মধ্যে ওই সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল

গত বছর ধরে পুতিন আকারে ইঙ্গিতে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দিয়েছেন। রাশিয়া আক্রান্ত হলে এই ব্যবহার করা হবে বলে ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন। এবার তিনি স্পষ্ট করলেন যে পশ্চিমারা ইউক্রেনকে মদদ দেওয়া বন্ধ না করলে পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের কাঠামো ভেঙে ফেলতে পারেন।  

পুতিন বলেছেন, রাশিয়াকে এই সংঘাতে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। বিশেষ করে স্নায়ুযুদ্ধের পর থেকে ন্যাটোর পূর্বমূখী সম্প্রসারণের মধ্য দিয়ে এটা করা হয়েছে। রুশ প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘ইউক্রেনের জনগণ কিয়েভের বর্তমান শাসকগোষ্ঠী ও তাদের পশ্চিমা তাঁবেদারদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। যাঁরা দেশটিকে রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে পুরোপুরি দখল করে আছে।’

রুশ প্রেসিডেন্ট ‘স্টেট অব দ্য নেশন’ ভাষণে ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য পশ্চিমাদের দায়ী করেছেন। মস্কো, রাশিয়া ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

কিয়েভ ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ পশ্চিমা নেতারা রুশ প্রেসিডেন্টের এই বক্তব্য নাকচ করে আসছেন। তাঁরা বলছেন, একটি স্বাধীন দেশের ভূমি দখলের জন্য এই ভাষ্য নির্মাণ করা হয়েছে। সোমবার কিয়েভ সফর করা বাইডেন মঙ্গলবার পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশতে একটি বড় সমাবেশে বক্তব্য দিয়েছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘(ভেঙে যাওয়া) একটি সম্রাজ্য পুনর্গঠনে একজন স্বৈরশাসকের অভিলাষ কখনোই স্বাধীনতার প্রতি মানুষের ভালোবাসাকে কমিয়ে দিতে পারবে না। বর্বরতা কখনোই স্বাধীন মানুষের ইচ্ছাকে দমিয়ে দিতে পারবে না। ইউক্রেন কখনোই রাশিয়ার কাছে বিজয় রূপে আসবে না।’

পশ্চিমা দেশগুলো আঞ্চলিক একটি যুদ্ধকে বৈশ্বিক সংঘাতের পর্যায়ে নিয়ে যেতে চায় মন্তব্য করে রুশ প্রেসিডেন্ট বলেন, পশ্চিমাদের তৎপরতাকে রাশিয়া ঠিক এভাবেই দেখছে। এর যথাযথ জবাব দেওয়া হবে। কারণ, এটা রাশিয়ার অস্তিত্বের বিষয়।

প্রায় পৌনে দুই ঘণ্টার বক্তব্যে ভ্লাদিমির পুতিন বলেন, যুদ্ধে রাশিয়াকে পরাজিত করা অসম্ভব। তাঁর ভাষ্যমতে, রুশ সমাজকে বিভক্ত করতে পশ্চিমাদের যে চেষ্টা, তার সামনে কখনো নতিস্বীকার করবে না রাশিয়া। আর ইউক্রেন যুদ্ধের পেছনে বেশির ভাগ রুশ নাগরিকের সমর্থন রয়েছে।

গত এক বছরের যুদ্ধে রুশ বাহিনী ইউক্রেনে তিন দফায় বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। তবে এরপরও দেশটির এক–পঞ্চমাংশ অঞ্চল রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।