বিশ্লেষণ

নেতানিয়াহুকে কি আর চায় না হোয়াইট হাউস

তেল আবিব সফরকালে বাইডেন ব্যক্তিগতভাবে নেতানিয়াহুকে তাঁর উত্তরসূরির বিষয়ে চিন্তাভাবনা করার পরামর্শ দেন। মার্কিন সংবাদপত্র দ্য পলিটিকোতে লিখেছেন জোনাথন লেমিরি, নাহাল টুসি ও আলেক্সান্ডার ওয়ার্ড।

ফিলিস্তিনের গাজায় নির্বিচার সামরিক হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলের নেতানিয়াহু সরকার
ছবি: এএফপি

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস ইসরায়েলে হামলা চালানোর পর থেকে গাজার নিরীহ মানুষের ওপর রীতিমতো নির্বিচার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বাহিনী। হামাসের ওই হামলায় ইসরায়েলের প্রায় ১ হাজার ৪০০ মানুষ নিহত হন। হামাস এত বড় হামলা চালাল, অথচ ইসরায়েলের সুসজ্জিত ও দক্ষ গোয়েন্দা বাহিনী কেন আগাম তথ্য দিতে পারল না, তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। সামনে চলে এসেছে নেতানিয়াহু সরকারের ব্যর্থতা। তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়েও চলছে আলোচনা।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও তাঁর ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তারা বলছেন, নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক দিন সম্ভবত ফুরিয়ে আসছে। সম্প্রতি এক আলাপচারিতায় বাইডেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীকে এই অনুভূতির কথা জানিয়েছেনও।

বাইডেন প্রশাসনের জ্যেষ্ঠ দুই কর্মকর্তা বলেন, সম্প্রতি হোয়াইট হাউসে বাইডেনের সঙ্গে এক বৈঠকেও নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক ভবিষ্যতের কথা উঠে এসেছে। বাইডেনের ইসরায়েল সফরে নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠকে সেই কথার পুনরাবৃত্তি ছিল।

বাইডেন কী বলেছেন

মার্কিন প্রশাসনের বর্তমান ও সাবেক দুই কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন, বাইডেন প্রশাসন মনে করে, নেতানিয়াহুর ক্ষমতার দিন শেষ হয়ে আসছে। কয়েক মাসের মধ্যে অথবা গাজায় ইসরায়েলি সেনা অভিযান শেষ হওয়ার পর সম্ভবত নেতানিয়াহুকে চলে যেতে হবে। অবশ্য তাঁরা এ–ও বলছেন, ইসরায়েলি রাজনীতি নিয়ে আগাম অনুমান করা কঠিনই বটে।

বাইডেন ও নেতানিয়াহুর একান্ত আলোচনার বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে মার্কিন প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলছেন, নেতানিয়াহুর ভাগ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে, সেটা নিয়ে ইসরায়েলি সমাজে নানা হিসাব–নিকাশ চলছে। শেষ কথা হচ্ছে, সবকিছুর দায় প্রধানমন্ত্রীর ঘাড়ে পড়ে।

নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে বাইডেন প্রশাসন এমন একটা সময়ে এসব নিয়ে কাজ করছে, যখন ইসরায়েলি নেতা ৭ অক্টোবরের হামলার পর হামাসের বিরুদ্ধে এক জটিল ও রক্তক্ষয়ী লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।

চেমালি বলেন, ‘এমনকি এই যুদ্ধ যদি চলতে থাকে বা যুদ্ধের নতুন নতুন রণক্ষেত্রও তৈরি হয়, তারপরও আমি বিশ্বাস করি, নেতানিয়াহুকে চলে যেতে হবে। কারণ, ইসরায়েলি জনগণ ইতিমধ্যে প্রশ্ন তুলেছেন, নেতানিয়াহু তাঁদের দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য সঠিক ব্যক্তি কি না। কেবল হামাসের সঙ্গে চলমান এই যুদ্ধে নয়; বরং শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ ইসরায়েলের জন্য বৃহত্তর লড়াইয়ে তাঁর যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তাঁরা।

মার্কিন প্রশাসনের শীর্ষ দুই কর্মকর্তা বলছেন, গত মাসে প্রেসিডেন্ট বাইডেন তেল আবিব সফরকালে ইসরায়েলের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন সত্য, কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে তিনি নেতানিয়াহুকে সতর্কভাবে এগোতে এবং ব্যাপকভাবে যুদ্ধে না জড়ানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। ওই সময় তিনি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীকে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানকে অগ্রাধিকার দিতে বলেছিলেন। হামাসকে নিশ্চিহ্ন করা এবং ভবিষ্যতে গাজায় দখলদারত্বের মতো পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন।

সফরকালে একপর্যায়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর উত্তরাধিকারের বিষয়টিও চিন্তাভাবনার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তাঁর এই পরামর্শের গূঢ় অর্থ হচ্ছে এই যে সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হলে নেতানিয়াহু ক্ষমতায় না–ও থাকতে পারেন।

অবশ্য হোয়াইট হাউসের আরেক কর্মকর্তা নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে এমন ভাবনাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন। তাঁর মতে, ইসরায়েলে দীর্ঘদিন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। সুতরাং তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে এখনই কিছু বলার সময় আসেনি।

এসব আলোচনা নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর সম্পর্কে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার এক মুখপাত্র বলেন, নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে বাইডেনের সঙ্গে বৈঠকে কোনো আলোচনা হয়নি বা হচ্ছেও না। তিনি বলছেন, ‘তাৎক্ষণিক সংকট মোকাবিলার বিষয়টিকে আমরা এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।’

সবকিছুই ‘পর্দার আড়ালে’

বর্তমান মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, নেতানিয়াহুর ক্ষমতার যে এই নড়বড়ে অবস্থা, সেটা ‘পর্দার আড়ালে’। বাইডেন প্রশাসনের ‘অভ্যন্তরীণ’ আলাপে এসব কথা উঠে এসেছে। বাইডেনের ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা ইসরায়েলের ক্ষমতা ও ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজনীতিকদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ–আলোচনা করছেন।

মার্কিন প্রশাসনের বর্তমান দুই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাসহ সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাদের মতে, যাঁরা ভবিষ্যতে ইসরায়েলকে নেতৃত্ব দিতে পারেন, তাঁদের জন্য এসব আলোচনা নতুন করে ভাবনার খোরাক জোগাতে পারে।

৭ অক্টোবর হামাসের হামলা ঠেকাতে নেতানিয়াহু সরকারের গোয়েন্দা ব্যর্থতা ইসরায়েলিদের ব্যাপকভাবে ক্ষুব্ধ করেছে। বাইডেন প্রশাসন মনে করে, এতে ইসরায়েলের ক্ষমতায় নেতানিয়াহুর অবস্থান অনেক দুর্বল হয়ে গেছে। আবার গাজায় চলমান ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের বিরোধিতায় আন্তর্জাতিক বিশ্ব যেভাবে সরব হয়ে উঠেছে, তাতেও তাঁর অবস্থান আরও নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে।

ইসরায়েলে নেতানিয়াহুর জনপ্রিয়তাও ব্যাপকভাবে নিম্নগামী। মার্কিন কর্মকর্তারা মনে করছেন, ইসরায়েলের গোয়েন্দা ব্যর্থতা নিয়ে প্রকাশ্যে যেসব প্রতিবেদন হচ্ছে, সেগুলো নেতানিয়াহুর জন্য মোটেই সুখকর নয়। তাঁদের অনুমান, যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে চলমান যুদ্ধ ও হামাসের হামলা নিয়ে একটি মূল্যায়ন তৈরি করেছে, শিগগিরই সে রকম কোনো মূল্যায়ন যদি ইসরায়েলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তৈরি করেন, তাহলে নেতানিয়াহুর আম–ছালা সবই যাবে।

বাইডেন প্রশাসনের প্রিয় নন নেতানিয়াহু

চলমান সংকটে বাইডেন প্রশাসন ইসরায়েল সরকারের প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন জানিয়েছেন সত্য। একই সঙ্গে বাইডেনের শীর্ষ সহযোগীরা নেতানিয়াহুর পতনে যুক্তরাষ্ট্র–ইসরায়েল সম্পর্ক কেমন হতে পারে, সেটাও গুরুত্বের সঙ্গে ভাবছেন। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে গাজা উপত্যকায় যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর সেখানে স্থিতিশীল অবস্থা ফেরাতে বহুজাতিক বাহিনী মোতায়েনের সম্ভাব্যতা নিয়ে তাঁরা ভাবছেন।

ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর বা ইসরায়েলি দূতাবাস এসব বিষয় নিয়ে মুখ খুলতে নারাজ। তবে এসব বিষয় নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হলে ইসরায়েলি দূতাবাস এক বিবৃতিতে বলেছিল, প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বৈঠকে এমন কোনো কথা হয়নি।

বাইডেনের প্রশাসনের কাছে নেতানিয়াহু মোটেই সমাদৃত ব্যক্তি নন। তিনি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রকাশ্য সমর্থক। একই সঙ্গে নেতানিয়াহু ইরানের সঙ্গে ওবামা–বাইডেন প্রশাসনের পরমাণু চুক্তির তুমুল সমালোচক ছিলেন।

বাইডেনকে যা হতাশ করেছে

ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বছরের পর বছর ধরে নেতানিয়াহুর কট্টর অবস্থান বাইডেন ও তাঁর সহযোগীদের হতাশ করেছে। আবার ইসরায়েলের বিচার বিভাগের সংস্কার নিয়ে বাইডেন প্রশাসনের আপত্তিকে তিনি পাত্তাই দেননি। ইসরায়েলের অধিকাংশ মানুষ বিচার বিভাগ সংস্কারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন।

তবে এটাই বিবেচনায় রাখতে হবে, বাইডেন ও নেতানিয়াহু একে অন্যকে কয়েক দশক ধরে চেনেন–জানেন। নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও প্রকাশ্যে তাঁরা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখছেন। হামাসের হামলার পর বাইডেন ইসরায়েল ও নেতানিয়াহুর প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন।

অবশ্য পর্দার আড়ালে বাইডেন কিছু বিষয়ের মূল্যায়ন করছেন। তিনি মনে করেন, নেতানিয়াহুর মধ্যে অগণতান্ত্রিক প্রবণতা রয়েছে। তাঁর এমন প্রবণতার কারণে বাইডেন সরকার হামাসের হামলার পর কীভাবে উদ্যোগ নেবে, সেটা নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্ত ছিল।

বাইডেন প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেন, তাঁরা জানতেন, এখন তাঁদেরকেই কাজ করতে হবে। কিন্তু তাঁরা বুঝতে পারছিলেন না, কীভাবে এবং কার সঙ্গে তাঁরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করবেন।

সাবেক এক মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, ভবিষ্যতের কথা ভেবে মার্কিন কর্মকর্তারা ইসরায়েলের বর্তমান যুদ্ধকালীন সরকারের সদস্য বেনি গান্টজ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট, বিরোধী নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইয়ার লাপিদসহ অন্যান্য ঊর্ধ্বতন ইসরায়েলি নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন।

ইসরায়েলের সামরিক পদক্ষেপের বিষয়ে বাইডেন প্রশাসন নেতানিয়াহু ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের পরামর্শ দিয়ে খুব একটা লাভ হয়নি। বিশেষ করে প্রাথমিক অবস্থায় উত্তর গাজা খালি করার আদেশ এবং স্থল অভিযান সামনে রেখে গাজার সব ধরনের যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করার ইসরায়েলি উদ্যোগ মার্কিন কর্মকর্তাদের হতাশ করেছিল।

যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতির আন্তর্জাতিক আহ্বানকে সমর্থন জানাতে আগ্রহী ছিল না। তবে যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছিল যুদ্ধে ‘মানবিক বিরতি’ দেওয়া হোক। কিন্তু ইসরায়েল তাতেও সম্মত হয়নি। এক ইসরায়েলি কর্মকর্তা গত বুধবার সকালে দ্য পলিটিকোকে বলেন, তাঁর দেশ যুদ্ধে কয়েক ঘণ্টার ‘মানবিক বিরতি’ দিতে পারে। এর বেশি নয়।

দুই জ্যেষ্ঠ মার্কিন কর্মকর্তার মতে, বাইডেন প্রশাসনের আশঙ্কা, নেতানিয়াহু তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এই যুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলতে পারেন। আর এ জন্য কিছু ক্ষেত্রে তিনিই সংঘাত আরও বাড়িয়ে দিতে পারেন।

সাবেক ওবামা প্রশাসনের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা হ্যাগার চেমালি বলেন, ‘এমনকি এই যুদ্ধের সেরা দৃশ্যপটও নেতানিয়াহুকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে পারবে বলে মনে হয় না। কারণ, গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার দগদগে ঘা তাদের হৃদয়পটে সব সময় ভেসে উঠবে। অনেক ইসরায়েলি ইতিমধ্যে সরাসরি বলে দিয়েছেন এবং তাঁরা বিশ্বাস করেন, নেতানিয়াহুর ব্যর্থ নীতির কারণে হামাস এই হামলা চালাতে পেরেছে।’

চেমালি বলেন, ‘এমনকি এই যুদ্ধ যদি চলতে থাকে বা যুদ্ধের নতুন নতুন রণক্ষেত্রও তৈরি হয়, তারপরও আমি বিশ্বাস করি, নেতানিয়াহুকে চলে যেতে হবে। কারণ, ইসরায়েলি জনগণ ইতিমধ্যে প্রশ্ন তুলেছেন, নেতানিয়াহু তাঁদের দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য সঠিক ব্যক্তি কি না। কেবল হামাসের সঙ্গে চলমান এই যুদ্ধে নয়; বরং শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ ইসরায়েলের জন্য বৃহত্তর লড়াইয়ে তাঁর যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তাঁরা।