হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। ইউক্রেন থেকে শিশুদের ধরে অবৈধভাবে রাশিয়ায় নিয়ে যাওয়াসহ দেশটিতে (ইউক্রেন) যুদ্ধাপরাধ করার অভিযোগে পুতিনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। একই সঙ্গে রাশিয়ার শিশু অধিকারবিষয়ক কমিশনার মারিয়া আলেক্সেইভনা লোভা-বেলোভার বিরুদ্ধেও একই অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে আইসিসি।
ইউক্রেনের তথ্যমতে, গত ফেব্রুয়ারিতে দেশটিতে রাশিয়া আক্রমণ শুরু করার পর এখন পর্যন্ত অসংখ্য যুদ্ধাপরাধ করেছে।
আন্তর্জাতিক কমিটি অব রেডক্রস বলছে, ‘যুদ্ধেও নিয়ম আছে।’ জেনেভা সনদসহ বিভিন্ন চুক্তি, নানা আন্তর্জাতিক আইন, সমঝোতার মধ্যেই এসব নিয়মকানুনের কথা বলা হয়েছে।
বেসামরিক নাগরিকদের ওপর ইচ্ছাকৃত হামলা করা যাবে না, এমনকি এমন কোনো অবকাঠামোতে হামলা করা যাবে না, যা তাদের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য।
কিছু অস্ত্রও যুদ্ধে ব্যবহার নিষিদ্ধ। কারণ, এসব অস্ত্র ব্যবহার করলে নির্বিচারে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেমন অ্যান্টিপারসোনাল ল্যান্ডমাইন, রাসায়নিক ও জীবাণু অস্ত্র।
অসুস্থ বা আহত ব্যক্তিদের অবশ্যই সেবা দিতে হবে। এর মধ্যে অসুস্থ সেনারাও থাকবেন, যুদ্ধবন্দী হিসেবে তাঁদের সেই অধিকার পাওয়ার কথা।
আরও কিছু গুরুতর অপরাধ রয়েছে। যেমন হত্যা, ধর্ষণ বা একটি গোষ্ঠীর ওপর গণনিপীড়ন, যা ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ বা কিছু পরিস্থিতিতে ‘গণহত্যা’ হিসেবে গণ্য হবে।
ইউক্রেন বিষয়ে জাতিসংঘের তদন্ত কমিশন বলেছে, ইউক্রেন থেকে হাজারো শিশুকে ধরে অবৈধভাবে রাশিয়ার নিয়ে যাওয়ার প্রমাণ রয়েছে।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, রাশিয়া কিছু নীতি চালু করেছে। যেমন শিশুদের রাশিয়ার নাগরিকত্ব নিতে বাধ্য করা এবং তাদের পালক পরিবারে পাঠিয়ে দেওয়া। আর তারা এই নীতিমালা করেছে এ জন্য ‘যাতে কিছু শিশু রাশিয়ায় স্থায়ীভাবে থেকে যেতে পারে’।
ইউক্রেনে আগ্রাসনের অপরাধের বিচারের জন্য বিশ্বনেতাদের আলাদাভাবে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা উচিত।ফিলিপ্পি স্যান্ডস, অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের আন্তর্জাতিক আইন
জাতিসংঘের তদন্তকারীরা লিখেছেন, এই স্থানান্তর সাময়িক বলা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটি দীর্ঘস্থায়ী হবে। অভিভাবক ও সন্তানদের মধ্যে যোগাযোগে একটি বাধা তৈরি হবে।
ইউক্রেন সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, জোর করে ১৬ হাজার ২২১ শিশুকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জোরপূর্বক এভাবে শিশুদের নিয়ে যাওয়া আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধের শামিল।
জাতিসংঘ বলেছে, ধর্ষণ, হত্যা ও ‘ব্যাপক’ নির্যাতনের অভিযোগের দায়দায়িত্ব মস্কোকে নিতে হতে পারে। জাতিসংঘ বলেছে, ধর্ষণ, হত্যা ও ‘ব্যাপক’ নির্যাতনের পাশাপাশি, মস্কো আরও গুরুতর ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’-এর দায়ে দোষী সাব্যস্ত হতে পারে, বিশেষত ইউক্রেনের জ্বালানি অবকাঠামো লক্ষ্য করে অক্টোবর থেকে রাশিয়ার টানা আক্রমণ যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে।
ইউক্রেনের বেশ কয়েকটি অংশ রাশিয়ার দখলমুক্ত হওয়ার পর সেসব জায়গায় গণকবর পাওয়া গেছে। সেখানে বেশ কিছু বেসামরিক মানুষের মরদেহ পাওয়া গেছে। তাদের গায়ে নির্যাতনের চিহ্ন ছিল।
২০২২ সালের এপ্রিল কিয়েভের একটি উপশহর বুচাতে চার শতাধিক বেসামরিক মানুষের মরদেহ পাওয়া গেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে খারকিভ অঞ্চলে ইজিউমে অনেক গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। সেগুলোতে ৪৫০ জনের মরদেহ ছিল, যাঁদের বেশির ভাগই সাধারণ মানুষ ছিলেন।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনোস্কি বলেন, খেরসন অঞ্চলে রুশ বাহিনী চার শতাধিক যুদ্ধাপরাধ করেছে। অপরাধগুলো গত বছরের মার্চ থেকে নভেম্বরের মধ্যে সংঘটিত হয়েছে। ওই সময় অঞ্চলটি রাশিয়ার দখলে ছিল।
২০২২ সালের মার্চে রুশ বাহিনী মারিউপোলে একটি থিয়েটারে বিমান হামলা চালায়। ওই সময় থিয়েটার কেন্দ্রটি শিশুদের আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল। গত বছরের মার্চে মারিউপোলে একটি হাসপাতালেও হামলা হয়।
ইউক্রেনের আদালত ইতিমধ্যে এক রুশ সেনার বিচার করেছেন।
নিরস্ত্র এক বেসামরিক ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যার দায়ে ২১ বছর বয়সী রুশ ট্যাংক কমান্ডার ভাদিম শিশিমারিনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় গ্রাম চুপাখিভকা গ্রামে ঘটনাটি ঘটেছিল।
সামরিক কমান্ডার বা জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদদের চেয়ে যুদ্ধাপরাধের জন্য সৈন্যদের আলাদা করে বিচার করা সহজ হতে পারে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (ইউরোপ ও সেন্ট্রাল এশিয়া) পরিচালক হিউ উইলিয়ামসন বলেন, ভবিষ্যতের যেকোনো বিচারকাজের জন্য ‘চেইন অব কমান্ড’ প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) ইউক্রেনে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্ত করছে। ইউক্রেন থেকে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের আগে থেকে; অর্থাৎ ২০১৩ সাল থেকে ওঠা অভিযোগগুলো তদন্ত করবে।
আইসিসির প্রধান প্রসিকিউটর ব্রিটিশ আইনজীবী করিম খান মনে করেন, যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তা বিশ্বাস করার যৌক্তিক ভিত্তি রয়েছে।
অবশ্য আইসিসির সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের কোনো ক্ষমতা নেই। আর এই আদালতের আদেশ কেবল সেসব দেশের জন্যই খাটে, যারা এ আন্তর্জাতিক আদালত গঠনের জন্য চুক্তিতে সই করেছিল। এতে রাশিয়া সই না করায় দেশটি থেকে কাউকে প্রত্যর্পণের সম্ভাবনা ক্ষীণ।
আইসিসি সাধারণত সেসব দেশের যুদ্ধাপরাধের বিচারের দায়িত্ব নেয়, যেসব দেশে বিচারব্যবস্থা খুব দুর্বল এবং নিজেদের বিচার চালাতেই বেগ পায়।
তবে এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে, ইউক্রেনের আদালত তাঁদের নিজস্ব মামলাগুলোর বিচার করতে সক্ষম। আগস্টের শেষের দিকে দেশটির প্রসিকিউটর জেনারেল ১৩৫ সন্দেহভাজনের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ এনেছিলেন।
আইসিসি কোনো রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে ‘আক্রমণাত্মক যুদ্ধ’ পরিচালনার অভিযোগে মামলার বিচারকাজ করতে পারে। এর আওতায় রয়েছে অযৌক্তিক আক্রমণ বা সংঘাত, যা আত্মরক্ষার স্বার্থে করা হয়নি।
অবশ্য ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের আন্তর্জাতিক আইনবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ফিলিপ্পি স্যান্ডস বলেছেন, আইসিসি আবার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মতো রুশ নেতাদের বিচার করতে পারবে না। কারণ, দেশটি আদালত গঠনে সই করেনি।
তাত্ত্বিকভাবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ আইসিসিকে এই অপরাধ তদন্ত করার জন্য বলতে পারে। তবে রাশিয়া এতে ভেটো দিতে পারবে।
অধ্যাপক স্যান্ডস বলেন, ইউক্রেনে আগ্রাসনের অপরাধের বিচারের জন্য বিশ্বনেতাদের আলাদাভাবে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা উচিত।