মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন

বাইডেনকে ঘিরে সংকটে ডেমোক্রেট শিবির

ডেমোক্র্যাটদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে প্রথম বিতর্কে ব্যর্থ হওয়ার পর জো বাইডেনকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর দাবি ক্রমে জোরালো হচ্ছে। প্রথমে সেই দাবি তুলেছিলেন ডেমোক্রেটিক ভাষ্যকারেরা, তারপর কোনো কোনো বড় চাঁদাদাতা ও ডেমোক্রেটিক সমর্থক কলাম লেখকেরা। এখন দলের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও আওয়াজ তোলা শুরু করেছেন। বাইডেনের বয়স নিয়ে যে উদ্বেগ আগে থেকে ছিল, এখন তা যেন সুনামির আকার নিচ্ছে।

সমস্যা হলো—আওয়াজ যত জোরালো হোক না কেন, বাইডেন নিজে সরে না দাঁড়ালে তাঁকে টেনে বা ধাক্কা দিয়ে সরানোর কোনো উপায় নেই। মার্কিন নির্বাচনব্যবস্থায় প্রার্থীর পদ নির্ধারিত হয় প্রাইমারি বা বাছাইপর্বের নির্বাচনের মাধ্যমে। ডেমোক্রেটিক পার্টির বাছাইপর্বের নির্বাচন শেষে বাইডেন ইতিমধ্যেই তাঁর প্রয়োজনীয় সংখ্যক ডেলিগেটের সমর্থন অর্জন করেছেন। আগামী আগস্ট মাসে শিকাগোয় দলের নির্বাচনী কনভেনশনে এই ডেলিগেটরা তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে দলের প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করবেন।

এখন একমাত্র বাইডেনই পারেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়াতে এবং নিজের সংগৃহীত ডেলিগেট তাঁর পছন্দের কোনো প্রার্থীর জন্য অনুমোদন করতে। বিকল্প হিসেবে বাইডেন এসব ডেলিগেটকে ‘মুক্ত’ করে দিতে পারেন, যাতে তাঁরা ‘উন্মুক্ত কনভেনশনে’ নিজেদের পছন্দমতো কাউকে বেছে নিতে পারেন। পূর্বনির্ধারিত না হওয়ায় সে ক্ষেত্রে একাধিক প্রার্থী প্রেসিডেন্ট পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। সত্যি যদি এমন কিছু হয়, তাহলে মহা গন্ডগোল বাধতে পারে। ১৯৬৮ সালে প্রেসিডেন্ট জনসন স্বেচ্ছায় প্রার্থী পদ ছেড়ে দিলে সেই শিকাগোতেই উন্মুক্ত কনভেনশনে দক্ষযজ্ঞ হয়েছিল। আবারও সেই একই কাণ্ড ঘটানোর আশঙ্কা রয়েছে। ১৯৬৮ সালের সেই বিভক্ত কনভেনশনের ফল ছিল জনসনের মনোনীত প্রার্থী হিউবার্ট হামফ্রের ভরাডুবি ও রিপাবলিকান প্রার্থী রিচার্ড নিক্সনের সহজ জয়।

সেই বিপদ ঠেকাতে বাইডেনের সম্ভাব্য বিকল্প হিসেবে একাধিক প্রার্থীর নাম শোনা যাচ্ছে। এর অধিকাংশই কোনো না কোনো অঙ্গরাজ্যের ডেমোক্রেটিক গভর্নর। যেমন ক্যালিফোর্নিয়ার গেভিন ন্যুসাম ও মিশিগানের গ্রেচেন হুইটমার; এমনকি মিশেল ওবামার নামও শোনা যাচ্ছে।

স্বাভাবিকভাবে যাঁর নাম সবার আগে আসার কথা, তিনি হলেন বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস। কোনো কোনো মহলে তাঁর ব্যাপারে আপত্তি থাকলেও এখন এ কথা স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে বাইডেন সরে যেতে সম্মত হলে কমলাকেই দলীয় প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করতে হবে। একদিকে তিনি নারী, তারপর কৃষ্ণকায়। আগামী নির্বাচনে জিততে হলে ডেমোক্রেটিক পার্টিকে তাদের এই দুই প্রধান সমর্থক গ্রুপের ওপর ভর করতে হবে। তাঁকে এড়িয়ে অন্য কাউকে মনোনীত করলে দলকে এই দুই গ্রুপের রোষের শিকার হতে হবে। এরই মধ্যে প্রতিনিধি পরিষদে ডেমোক্র্যাট নেতা হাকিম জেফ্রিস ও বর্ষীয়ান কংগ্রেস সদস্য জিম ক্লাইবার্ন বলেছেন, বাইডেন সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে তাঁরা কমলাকেই দলের প্রার্থী হিসেবে সমর্থন করবেন।

মার্কিন সম্প্রচারমাধ্যম সিএনএনের এক নতুন জনমত জরিপেও কমলার ব্যাপারে সমর্থনের আভাস পাওয়া গেছে। এই জরিপ অনুসারে, এই মুহূর্তে ট্রাম্প বাইডেনের তুলনায় ৬ পয়েন্টে এগিয়ে (৪৯: ৪৩)। অন্যদিকে ট্রাম্প ও কমলার মুখোমুখি লড়াইতে তাঁদের ব্যবধান মাত্র ২ শতাংশ (ট্রাম্প ৪৭, কমলা ৪৫)।

ট্রাম্প যে কত বড় হুমকি, সে কথা ডেমোক্র্যাটদের বুঝিয়ে বলার কিছু নেই। তিনি ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছেন, নির্বাচিত হলে এক দিনের জন্য হলেও তিনি ‘ডিক্টেটর’ হবেন। নিজের প্রতে৵ক রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে তিনি কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন। বাইডেন এই তালিকার বাইরে নন। রক্ষণশীল থিঙ্কট্যাংক হেরিটেজ ফাউন্ডেশন যে তথাকথিত ‘প্রজেক্ট ২০২৫’ তাঁর পক্ষে প্রস্তাব করেছে, তা বাস্তবায়িত হলে সব ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হবেন তিনি।

দেশের সর্বোচ্চ আদালত ইতিমধ্যে প্রেসিডেন্টের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা রয়েছে বলে যে রায় দিয়েছেন, তা বস্তুত দ্বিতীয় দফায় ট্রাম্পকে যা খুশি করার আগাম ‘সবুজসংকেত’। বিচারপতি সোনিয়া সোতোমায়োর সেই রায়ের ব্যাপারে ভিন্নমত প্রকাশ করে বলেন, ট্রাম্প (বা পরবর্তী কোনো প্রেসিডেন্ট) চাইলে তাঁর প্রতিপক্ষ রাজনীতিককে হত্যা বা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সামরিক অভ্যুত্থান করলেও আইনের চোখে তিনি নির্দোষ।

অতএব আমেরিকার গণতন্ত্রের স্বার্থে ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফা নির্বাচন ঠেকাতে হবে; কিন্তু কীভাবে? জনমত জরিপে তিনি এগিয়ে। ব্যাটলগ্রাউন্ড হিসেবে পরিচিত গুরুত্বপূর্ণ সাতটি অঙ্গরাজ্যের পাঁচটিতেই তিনি বাইডেনের তুলনায় ৫ থেকে ১২ পয়েন্ট এগিয়ে। অন্যদিকে প্রথম বিতর্কের আগে থেকেই নিজের সমর্থকদের মধ্যে বাইডেনের অবস্থান নড়বড়ে ছিল। এখন তা দুঃস্বপ্নের আকার নিচ্ছে। সে কারণে তাঁকে সরিয়ে অন্য কাউকে বাছাইয়ের জন্য চাপ বাড়ছে; কিন্তু সেসব অলস জল্পনাকল্পনা। কারণ সরে দাঁড়ানোর কোনো ইঙ্গিত দেখাননি বাইডেন; বরং তাঁর স্ত্রী ও পরিবারের অন্যান্য সদস্য তাঁকে লড়াই চালিয়ে যেতে চাপ দিচ্ছেন। যেসব রাজনৈতিক কর্মকর্তা বাইডেনকে ঘিরে নিজেদের রুটিরুজির ব্যবস্থা করে নিয়েছেন, তাঁরাও স্বাভাবিক কারণে চান না বাইডেন সরে দাঁড়ান। তাঁরা বলছেন, এক বিতর্কের ভিত্তিতে বাইডেনকে বিচার করা অন্যায়। বারাক ওবামাও তো মিট রমনির সঙ্গে প্রথম বিতর্কে প্রায় ৪০ পয়েন্টে হেরেছিলেন; কিন্তু দ্বিতীয় বিতর্কে তিনি সামলে ওঠেন।

বাইডেনও ঠিকই পারবেন। সেই যুক্তিতে কোনো কোনো ডেমোক্রেটিক নির্বাচনবিশেষজ্ঞ বাইডেনের খুঁত না ধরে তাঁর পেছনে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার যুক্তি খাড়া করছেন। তাঁদের বক্তব্য—এই শেষ মুহূর্তে বাইডেনকে বাদ দিয়ে যাঁকেই নেওয়া হবে, তাঁর পক্ষে ট্রাম্পকে টপকে যাওয়া শুধু কঠিন নয়, অসম্ভবও। আদর্শ ও নীতিগত প্রশ্নে দল আগে থেকেই বিভক্ত। বাইডেনকে বাদ দিয়ে যাঁকেই নেওয়া হবে, তাতে এই বিভক্তি বাড়বে বৈ কমবে না। এ দেশে নির্বাচনে জয়ের জন্য বড় শর্ত—অর্থ ও মাঠপর্যায়ে সংগঠন। একমাত্র বাইডেনের পক্ষেই সম্ভব এই দুই ক্ষেত্রে ট্রাম্পকে সমানে সমানে টক্কর দেওয়া। প্রমাণ হিসেবে বাইডেন শিবির থেকে বলা হয়েছে, প্রথম বিতর্কের পর দলীয় সমর্থকদের কাছ থেকে তিনি এক দিনে ৩৮ মিলিয়ন ডলার চাঁদা তুলেছেন।

এ সবই সত্য; কিন্তু এ কথাও সত্য—প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে তাঁর প্রতি দেশের মানুষের অনাস্থা বাড়ছে। আগামী কয়েক সপ্তাহের জনমত জরিপে এ কথার সত্যাসত্য আরও স্পষ্টভাবে বোঝা যাবে। তবে এই মুহূর্তে প্যানিকগ্রস্ত (হতবিহ্বল) ডেমোক্রেটিক সমর্থকেরা বাইডেনকে সরে দাঁড়ানোর জন্য রীতিমতো অনুনয়বিনয় শুরু করেছে। তাদের একটি হলো নিউইয়র্ক টাইমস। নিজের ‘ইগো’কে প্রাধান্য না দিয়ে বাইডেন দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ বিবেচনায় রেখে সরে দাঁড়াবেন—এমন একটি আশাবাদ ব্যক্ত করে পত্রিকাটি লিখেছে, প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাইডেন সবার প্রশংসার দাবিদার। তাঁর নেতৃত্বে আমেরিকা নানাভাবে উপকৃত হয়েছে, দেশের দীর্ঘমেয়াদি নানা সমস্যা নিয়ে কাজও শুরু হয়েছে তাঁর সময়ে। ট্রাম্পের কারণে মার্কিন সমাজে যে রক্তক্ষরণের সূত্রপাত হয়েছিল, বাইডেনের নেতৃত্বে তার উপশম হওয়া শুরু হয়েছে। এসবই খুব প্রশংসনীয়; কিন্তু দেশের স্বার্থে এখন যে কাজ প্রেসিডেন্ট বাইডেন করতে পারেন, তা হলো আগামী নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়ানো।

একই কথা বলেছেন ওয়াশিংটন পোস্ট–এর প্রভাবশালী কলামিস্ট ডেভিড ইগনেশাস। নির্বাচনী প্রচারণার সময় বাইডেন নিজেকে একজন ‘অন্তর্বর্তীকালীন’ প্রেসিডেন্ট হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। অর্থাৎ তিনি যে চার বছর দায়িত্ব পালন করবেন, সেটি হবে পরবর্তী নবীনতর প্রজন্মের জন্য প্রস্তুতি পর্ব। সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে ইগনেশাস লিখেছেন, প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি নিজের দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল ২০২০ সালে ট্রাম্পকে ঠেকানো। ২০২৪ সালে তিনি যদি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, তাহলে নিজের সেরা সাফল্যকে তিনি নিজেই ব্যর্থতার দিকে ঠেলে দেবেন।

কী করবেন বাইডেন? আমরা জানি, বাইডেন একগুঁয়ে হতে পারেন; কিন্তু তিনি নির্বোধ নন। ডেমোক্র্যাটরা আশা করছেন, বালুতে মাথা গুঁজে না রেখে তিনি দেয়ালের লিখন পড়বেন।