যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচার–প্রচারণায় দুই প্রার্থীর ছবিতে সভা–সমাবেশস্থল ভরিয়ে তুলছেন তাঁদের সমর্থকেরা। কোনো ছবিতে প্রার্থীদের মঞ্চে দাঁড়িয়ে কথা বলতে, কোনোটিতে সমাবেশে উপস্থিত জনতাকে স্বাগত জানাতে দেখা যাচ্ছে। আবার, কোনো ছবিতে তাঁরা ধরা পড়ছেন উড়োজাহাজের সিঁড়ি দিয়ে নামার দৃশ্যে। তবে এর বাইরেও কিছু ছবি আছে, যেগুলো থেকে তাঁদের পরিচয় ও বেড়ে ওঠা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেতে পারে।
হোয়াইট হাউস কী, তা জানার অনেক আগেই ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছিলেন কমলা হ্যারিস ও ডোনাল্ড ট্রাম্প। তখন তাঁদের দুজনেরই বয়স ছিল মাত্র তিন বছর।
এবারের নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী কমলার প্রাথমিক জীবন কেটেছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের ওকল্যান্ডে। আর রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্প বেড়ে উঠেছেন নিউইয়র্কের কুইন্সে।
কমলা ও তাঁর বোন মায়াকে লালন-পালন করেছেন তাঁদের মা শ্যামলা গোপালান হ্যারিস। ভারতীয় ওই নারী একজন ক্যানসার গবেষক ও সমাজকর্মী।
ট্রাম্পের বাবা ফ্রেড ট্রাম্প ছিলেন একজন জার্মান অভিবাসীর সন্তান। মা মেরি অ্যান ম্যাকলয়েড ট্রাম্প জন্মগ্রহণ করেন স্কটল্যান্ডে। তাঁরা ট্রাম্পকে ১৩ বছর বয়সেই নিউইয়র্কে সামরিক একাডেমিতে ভর্তি করিয়ে দেন।
কমলা কানাডার মন্ট্রিলের একটি হাইস্কুলে পাঁচ বছর পড়াশোনা করেছেন। সেখানকার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন তাঁর মা। কমলা পরবর্তী সময় যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে কৃষ্ণাঙ্গদের ঐতিহাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।
ট্রাম্প বলেন, ১৯৫৯ সালে তিনি সামরিক একাডেমিতে ভর্তি হন। সেখানে পাঁচ বছর সামরিক প্রশিক্ষণ নেন। একাডেমি তাঁকে নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জনে সহায়তা করেছে। পরে সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক নিয়োগ স্থগিত হওয়ায় তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধে অংশ নেননি। চারবার প্রাতিষ্ঠানিক কারণে এবং একবার স্বাস্থ্যগত কারণে তাঁর নিয়োগ স্থগিত হয়েছিল।
প্রাথমিক জীবনে কমলা মায়ের কাছ থেকে নাগরিক অধিকার আন্দোলনের গুরুত্ব বুঝতে শেখেন। ২০০৪ সালে ওয়াশিংটনে বার্ষিক মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র ফ্রিডম মার্চে অংশ নিয়েছিলেন কমলা।
পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হোয়ারটন স্কুল থেকে ডিগ্রি লাভের পর ট্রাম্প তাঁর বাবার উত্তরাধিকারী হিসেবে পারিবারিক ব্যবসায় যোগ দেন।
এদিকে, কমলা ওয়াশিংটন থেকে ক্যালিফোর্নিয়ায় ফিরে আসেন। সেখানে খুব দ্রুত অঙ্গরাজ্যটির ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার শীর্ষ পর্যায়ে উঠে আসেন তিনি। দায়িত্ব নেন রাজ্যের অ্যাটর্নি জেনারেলের। আর এ দায়িত্ব তাঁকে ২০১৬ সালে সেখানকার সিনেটর হতে প্রেরণা জুগিয়েছে।
কমলা যখন মার্কিন কংগ্রেসের সদস্য হন, ট্রাম্প তখন প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট হিসেবে হোয়াইট হাউসে বসেন। ২০১৬ সালে তিনি ডেমোক্রেটিক প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনকে হারিয়ে পুরো বিশ্বকে চমকে দেন।
চার বছর পর প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পাওয়ার জন্য প্রচার চালান কমলা। কিন্তু তাঁর প্রচার খুব একটা আলোচনায় আসেনি; সে সময় প্রার্থী হিসেবে বেছে নেওয়া হয় জো বাইডেনকে। আর কমলা হন তাঁর রানিংমেট বা ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী। তাঁরা ২০২০ সালের নির্বাচনে ট্রাম্প ও তাঁর রানিংমেট মাইক পেন্সকে হারিয়ে সরকার গঠন করেন।
ক্ষমতা গ্রহণ করেই কোভিড-১৯ মহামারির লকডাউন, মাস্ক ব্যবহারের অনুমোদন ও সামাজিক অস্থিরতার মুখে পড়ে জো বাইডেন ও কমলার সরকার। সে সময় মিনিয়াপলিসে পুলিশের হাতে জর্জ ফ্লয়েড নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবক নিহত হওয়ার ঘটনা বিশ্বজুড়ে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়।
ক্ষমতায় বসার পর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজের দক্ষতা প্রমাণ করতে গিয়ে মাঝেমধ্যেই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে কমলা হ্যারিসকে। তবে ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ে দেশজুড়ে নারীদের গর্ভপাতের অধিকার কেড়ে নেওয়া হলে তিনি আবার সরব হয়ে ওঠেন।
ট্রাম্পই মূলত যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টকে বেশি রক্ষণশীল করে তুলেছিলেন। গর্ভপাতের অধিকার কেড়ে নেওয়ার যে রায়, সেটির পথ প্রশস্ত করেছিলেন।
ওভাল অফিসে দায়িত্ব পালনকালে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে বের করে আনেন এবং অভিবাসন কমানোর উদ্যোগ নেন।
ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কমলা প্রথম বিদেশ সফর করেন ২০২১ সালে। সে বছর তিনি গুয়াতেমালায় যান। এ সফরের উদ্দেশ্য ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণে মেক্সিকো সীমান্ত দিয়ে লাতিন আমেরিকার অধিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্রে আসা (অভিবাসন) কমিয়ে আনা।
কমলার সময়ে বৈদেশিক নীতিসংক্রান্ত বিষয়গুলোও বেশ আলোচনায় ছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, রাশিয়া–ইউক্রেন সংঘাত ও গাজাযুদ্ধ এবং আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার।
অন্যদিকে, ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর প্রথম বিদেশ সফরে ২০১৭ সালে সৌদি আরবে যান। ট্রাম্প বিদেশি সংঘাত থেকে নিজ দেশকে মুক্ত রাখার জন্য বিচ্ছিন্নতাবাদী নীতির সমর্থক ছিলেন।
কমলা এমহফকে বিয়ে করেন। তিনি নিয়মিত কমলার পক্ষে নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছেন। এমহফের প্রথম ঘরের ছেলে কোল ও মেয়ে এলার সৎমা হলেন কমলা। তাঁরা কমলাকে আদর করে মোমালা বলে ডাকেন।
ট্রাম্পের পরিবারের সদস্যরাও তাঁর রাজনৈতিক জীবনে বিভিন্ন সময় ভূমিকা রেখেছেন। যদিও ২০২৪ সালের নির্বাচনী প্রচারাভিযানে তাঁর স্ত্রী ও সাবেক ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্পের উপস্থিতি কম দেখা যাচ্ছে।
প্রথম স্ত্রী ইভানার ঘরে ট্রাম্পের তিন সন্তান। তাঁরা হলেন, ডোনাল্ড জুনিয়র, ইভাঙ্কা ও এরিক। দ্বিতীয় স্ত্রী মারলা ম্যাপলসের ঘরে তাঁর একটি মেয়ে, নাম টিফানি। ট্রাম্প ২০০৫ সালে তৃতীয় স্ত্রী হিসেবে মেলানিয়াকে বিয়ে করেন। ব্যারন নামে তাঁদের একটি ছেলে আছে।
এবারের নির্বাচনী দৌড়ে একটু দেরিতেই এসেছেন কমলা। জো বাইডেন প্রার্থিতা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়ে কমলাকে সমর্থন দেন। এর মধ্য দিয়ে প্রথম কোনো কৃষ্ণাঙ্গ ও এশিয়ান-আমেরিকান হিসেবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের টিকিট পেয়ে কমলা ইতিহাস গড়েছেন এবং ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের শিকাগোতে ডেমোক্রেটিক দলের জাতীয় সম্মেলনে ভাষণ দিয়েছেন।
এ নির্বাচনে নিজ দলের পক্ষ থেকে তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর মনোনয়ন পেয়ে বিরল গৌরব অর্জন করেছেন ট্রাম্প। বন্দুক হামলায় আহত হয়ে কানে ব্যান্ডেজ নিয়েই তিনি উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যের মিলওয়াকিতে রিপাবলিকান দলের জাতীয় সম্মেলনে বক্তব্য দিয়েছেন। এ বছর নির্বাচনী প্রচারাভিযানে দুবার হামলার মুখে পড়েছেন তিনি।