টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষস্থলে পর্যটকদের আটলান্টিক মহাসাগরের তলদেশে নিয়ে যাওয়া নিখোঁজ সাবমেরিনের সন্ধানে যেভাবে তৎপরতা চালানো হচ্ছে, তা বিশাল প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ঘটনা প্রযুক্তিগত জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাকে দেখিয়ে দিল।
গত রোববার যাত্রা শুরুর ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট পর নিখোঁজ হয় টাইটান নামের সাবমেরিনটি। সাগরের তলদেশে পর্যটকদের টাইটানিকের ধ্বংসাবেশস্থলে পরিবহনের কাজে সেটি ব্যবহার করা হতো। ওরকা তিমি আকৃতির এই সাবমেরিন ২১ ফুট লম্বা। এটিতে পাঁচ আরোহী রয়েছেন। তাঁরা হলেন যুক্তরাজ্যের ধনকুবের হ্যামিশ হার্ডিং, পাকিস্তানি ধনকুবের শাহজাদা দাউদ, তাঁর ছেলে সুলেমান, সাবমেরিনটির প্রতিষ্ঠান ওশানগেটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) স্টকটন রাশ ও ফ্রান্সের সাবমেরিন অপারেটর পল অঁরি নিরজিওলেট, যাঁর ডাকনামই হয়ে গেছে ‘মি. টাইটানিক’।
সাবমেরিনের অক্সিজেন প্রায় ফুরিয়ে আসছে। বাংলাদেশ সময় আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা নাগাদ অক্সিজেন ফুরিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এখন সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উদ্ধারকারী দল সাবমেরিনের অবস্থান শনাক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু উত্তর আটলান্টিকের ৭ হাজার ৬০০ বর্গমাইল এলাকায় প্রায় ৪ কিলোমিটারের বেশি গভীরে এই তল্লাশি চালানো সহজ কাজ নয়।
টাইটানিক বিশেষজ্ঞ টিম মালটিন এনবিসি নিউজ নাওকে বলেন, সেখানে পরিবেশ ঘুটঘুটে কালো। পানি বরফঠান্ডা। সমুদ্রতলে কাদা। এখানে পানিতে মুখের সামনে নিজের হাত দেখা দেখা যায় না। আসলে এটা অনেকটা নভোচারীর মহাকাশে যাওয়ার মতো।
টাইটানে করে পর্যটকদের ভ্রমণে নিয়ে যাওয়া মার্কিন প্রতিষ্ঠান ওশানগেট এক্সপেডিশনস জানায়, সাবমেরিনটিতে প্রতি আসনের জন্য গুনতে হয় আড়াই লাখ মার্কিন ডলার।
মার্কিন কোস্টগার্ডের ক্যাপ্টেন জ্যামি ফ্রেডরিখ সাংবাদিকদের গত মঙ্গলবার বলেন, তাঁরা অনুসন্ধানকাজের সমন্বয় করছেন। তবে এটি অত্যন্ত কঠিন কাজ। সাধারণত কোস্টগার্ড যেসব কাজ করে, এটি তার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন।
তবে জ্যামি ফ্রেডরিখ বলেন, ইউএস কোস্টগার্ড অনুসন্ধান ও উদ্ধারকাজে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করলেও এ ধরনের ঘটনায় প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও সরঞ্জাম তাঁদের কাছে নেই। এটি একটি জটিল তল্লাশি। এখানে বিশেষ দক্ষতাসম্পন্ন সংস্থা ও বিশেষ সরঞ্জামের প্রয়োজন।
জ্যামি বলেন, টাইটানের সন্ধানে উদ্ধারকারীরা বিশাল এলাকাজুড়ে নানা কৌশল ব্যবহার করছেন। তলদেশে যাওয়ার দুই ঘণ্টার মধ্যে সাবমেরিনটি মূল জাহাজের সঙ্গে সংযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
অনুসন্ধানকাজে হেলিকপ্টারও ব্যবহার করা হচ্ছে।
এখন পর্যন্ত উদ্ধার অভিযান যতটুকু হয়েছে, তার ফলাফল শূন্য। আজ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তল্লাশি অভিযানে বড় ধরনের কোনো অগ্রগতি নেই। শেষ যেখানে টাইটানের অবস্থান ছিল, সেখানে অনেক বড় একটি জাহাজ মোতায়েন করা হয়েছে।
১৯৮৫ সালে টাইটানিককে খুঁজে বের করার জন্য ব্যবহৃত অপটিক্যাল ইমেজিং সিস্টেম উন্নয়ন দলের সদস্য ছিলেন জুলেস জ্যাফি। তিনি বলেন, উদ্ধারকারীদের তিনটি জায়গায় আলাদা করে দেখতে হবে।
সানডিয়েগোতে এবিসি ১০–কে জুলেস বলেন, ‘হয় সাবমেরিনটি সমুদ্রের তলদেশে বসে আছে অথবা পানির মাঝামাঝি স্তরে ভাসছে অথবা পানির ওপরে ভাসছে। তবে এটির পানির মাঝামাঝি স্তরে থাকার সম্ভাবনাই বেশি বলে আমার মনে হচ্ছে।’
যুক্তরাজ্যের কিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেনসিক ভূবিজ্ঞানের অধ্যাপক জেমি প্রিঙ্গেল এনবিসিকে বলেন, এই ছোট সাবমেরিন যদি সমুদ্রের তলদেশে চলে গিয়ে থাকে, তাহলে এটিকে শনাক্ত করা কঠিন। কারণ, সমুদ্রের তলদেশ সমতল নয়। সেখানে অসংখ্য পাহাড় ও গিরিখাত রয়েছে।
চ্যালেঞ্জের বিষয়গুলো তুলে ধরে জেমি বলেন, পানির নিচে চার কিলোমিটার গভীরে যে চাপ তৈরি হবে, তা সমুদ্রপৃষ্ঠের চাপের চেয়ে প্রায় ৪০০ গুণ বেশি। এই চাপ যন্ত্রপাতির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে এবং এত গভীরে খুব কম নৌযানই টিকতে পারে।
উডস হোল ওশানোগ্রাফিক ইনস্টিটিউশনের তথ্যমতে, পারমাণবিক সাবমেরিনগুলো সাধারণত পানির নিচে মাত্র ৩০০ মিটার গভীরে কাজ করে।