যুক্তরাষ্ট্রের ‘সন্ত্রাসের মদদদাতার তালিকা’ থেকে কিউবাকে কেন বাদ দেওয়া উচিত

১৯৬০-এর দশকের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্র ও কিউবার মধ্যে সম্পর্ক শীতল হতে থাকে। এরপর প্রায় পাঁচ দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও কিউবার কূটনৈতিক যোগাযোগ বন্ধ ছিল। পুরো সময়টায় ওয়াশিংটনে কিউবার ও হাভানায় যুক্তরাষ্ট্রের কোনো দূতাবাস ছিল না। ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও কিউবা পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সম্মত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের করা সন্ত্রাসবাদের মদদদাতা দেশের তালিকা থেকে কিউবার নাম প্রত্যাহার করেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। তবে তাঁর উত্তরসূরি ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা ছাড়ার শেষ মুহূর্তে কিউবাকে পুনরায় ওই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেন। কেন কিউবাকে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া উচিত, তা নিয়ে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনলাইন সাময়িকী কাউন্টারপাঞ্চে লিখেছেন যুক্তরাজ্যের সংগীতজ্ঞ রজার ওয়াটারস, ভারতীয় ইতিহাসবিদ ও সাংবাদিক বিজয় প্রসাদ এবং ফিলিপাইনের ধর্মযাজক মানোলো দে লোস সান্তোস। নিবন্ধটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন হাসান ইমাম

১৯৮২ সালে প্রথমবারের মতো কিউবাকে সন্ত্রাসবাদের মদদদাতা দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেন সেই সময়কার মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান

‘রাষ্ট্রীয়ভাবে সন্ত্রাসবাদের মদদ দেয়’ এমন দেশগুলোর একটি তালিকা আছে যুক্তরাষ্ট্রের। তালিকায় এখন চারটি দেশ রয়েছে—কিউবা, উত্তর কোরিয়া, ইরান ও সিরিয়া। এ তালিকা করার পেছনে মূল যে চিন্তা কাজ করেছে, তা হলো যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ধারণা, ‘এসব দেশ আন্তর্জাতিকভাবে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডে সমর্থন জোগায়’। যদিও এ ‘সমর্থনের’ পক্ষে কোনো তথ্যপ্রমাণ যুক্তরাষ্ট্র সরকার প্রকাশ্যে তুলে ধরে না।

কিউবার সরকার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সমর্থন জুগিয়েছে—এমন তথ্যপ্রমাণের ছিটেফোঁটাও নেই। বস্তুত সেই ১৯৫৯ সাল থেকে কিউবাই বরং যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের শিকার হয়ে আসছে। এর মধ্যে রয়েছে ১৯৬১ সালে কিউবা উপকূলে পিগস উপসাগরে আগ্রাসনের উদ্যোগ ও দেশটির নেতাদের একের পর এক গুপ্তহত্যার চেষ্টা। শুধু ফিদেল কাস্ত্রোকেই মোট ৬৩৮ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল।

বিশ্বব্যাপী অস্ত্র রপ্তানির পরিবর্তে কিউবার চিকিৎসাসেবার আন্তর্জাতিকীকরণের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। দেশটির চিকিৎসক ও ওষুধপত্থ্য নিয়ে সন্তুষ্টি রয়েছে পাকিস্তান থেকে পেরু পর্যন্ত। বাস্তবতা হলো কিউবার চিকিৎসকদের নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করার পক্ষে একটি আন্তর্জাতিক প্রচারণাও রয়েছে। বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যসেবার বন্যা বইয়ে দেওয়া একটি দেশকে কেন সন্ত্রাসবাদের মদদদাতা হিসেবে চিহ্নিত করা হবে, যৌক্তিকভাবেই সে প্রশ্ন ওঠে।

২০১৬ সালের ২১ মার্চ ঐতিহাসিক কিউবা সফরে যান যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। তাঁকে স্বাগত জানান রাউল কাস্ত্রো

ওয়াশিংটনের প্রতিহিংসাপরায়ণতা

১৯৮২ সালে প্রথমবারের মতো কিউবাকে ‘সন্ত্রাসবাদের মদদদাতা’ দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেন সেই সময়কার মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান। পরে ২০১৫ সাল থেকে এই তালিকায় দ্বীপরাষ্ট্রটির নাম ছিল না। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তালিকা থেকে কিউবার নাম বাদ দেন। কিন্তু ২০২১ সালের ১২ জানুয়ারি কিউবাকে পুনরায় তালিকায় ঢোকান ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর ক্ষমতার শেষ সপ্তাহ ছিল সেটা, ছিল নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেনের শপথ নেওয়ার দিন কয়েক বাকি। ট্রাম্পের এমন পদক্ষেপের পক্ষে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও বিস্ময়কর যুক্তি দিয়েছিলেন। তাঁর ভাষ্য ছিল, পাঁচ বছর আগে কিউবাকে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হলেও দেশটির সরকার ‘দশকের পর দশক খুনি, বোমা–নির্মাতা ও অপহরণকারীদের খাদ্য, বাসস্থান ও চিকিৎসাসেবা দিয়েছে’।

এই ‘দশকের পর দশক’ কথাটি এটাই বলছে যে ট্রাম্প প্রশাসন ২০১৫ সালের আগে ফিরে গিয়েছিল, অর্থাৎ ওবামার নেওয়া এ–সংক্রান্ত পদক্ষেপের আগের পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়েছিল, শেষ পাঁচ বছরের পরিস্থিতির মূল্যায়ন করেনি তারা।

২০১৫ সালের পর থেকে সন্ত্রাসবাদের পক্ষে কিউবার কাজ করার কোনো ধরনের তথ্য–উপাত্ত ছিল না, যা প্রমাণ করে ট্রাম্পের পদক্ষেপ ছিল নিখাদ রাজনৈতিক। কেননা, যুক্তরাষ্ট্রের কট্টর ডানপন্থীরা বরাবরই কিউবার সরকার পরিবর্তনের পক্ষে। সেই ধারাবাহিকতায় ট্রাম্প ওই পদক্ষেপ নেন। একই সঙ্গে ওবামার গৃহীত নীতিকে ভ্রান্ত প্রমাণের চেষ্টা করেন।

১৯৫৯ সাল থেকে কিউবার বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপের পথে হাঁটছে যুক্তরাষ্ট্র। সে সময় কিউবার শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে বিপ্লবের সূচনা হয়। তখন কিউবা শাসন করতেন (যুক্তরাষ্ট্রের মাফিয়াসহ) গ্যাংস্টাররা। সেই অবস্থা থেকে কিউবাকে এমন একটা দেশে রূপান্তর করা হয়, যেখানে জনগণের চাওয়া–পাওয়াকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। বিপ্লবের মাধ্যমে সাক্ষরতা ও স্বাস্থ্যসেবাসংক্রান্ত অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। কিউবার যে জনগণ দীর্ঘ সময় ধরে স্পেন ও যুক্তরাষ্ট্রের উপনিবেশবাদের চাপে পিষ্ট হয়েছে, তাদের মধ্যে ফিরিয়ে আনা হয় আত্মবিশ্বাস।

একটা গরিব দেশ হয়েও কিউবা যে আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটাতে পেরেছে, তা নস্যাৎ করতে বরাবরই সচেষ্ট ছিলেন মার্কিন এলিটরা। অথচ ১৯৯২ সাল থেকে প্রতিবছর বিশ্বের প্রায় সব দেশ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে কিউবার বিরুদ্ধে অবরোধ দেওয়ার নিন্দা জানিয়েছে। সর্বশেষ ১৯৩টি দেশের মধ্যে ১৮৪টি দেশ কিউবার পক্ষে ভোট দিয়েছিল।

ফিদেল কাস্ত্রোকে মোট ৬৩৮ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল

কিউবাকে তালিকা থেকে বাদ দিন

যুক্তরাষ্ট্রের তরফে ‘সন্ত্রাসবাদের মদদদাতা’ দেশ হিসেবে দাগিয়ে দেওয়ার বিষয়টি কিউবা সরকারের সক্ষমতা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, দেশটির জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ওপর যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রভূত নিয়ন্ত্রণ আছে। ফলে বিভিন্ন ব্যাংক ও ব্যবসায়ীরা কিউবার সঙ্গে বাণিজ্যে জড়াতে আগ্রহ দেখান না। তাঁদের ভয়, অবরোধ উপেক্ষা করে কিউবার সঙ্গে বাণিজ্য করলে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নেবে।

এটা জেনে বিস্মিত হতে হয় যে অবরোধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো ওষুধের কাঁচামাল, ডাক্তারির পরীক্ষার যন্ত্রপাতি, রিঅ্যাকটিভ এজেন্টসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় মালামাল কিউবার কাছে বিক্রি করছে না। অথচ চিকিৎসা বা ওষুধসম্পর্কিত বিষয় অবরোধের অন্তর্ভুক্ত নয়। চিকিৎসাসংক্রান্ত এসব পণ্য কিউবার চমৎকার জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজনীয়, পাবলিক সায়েন্সের জন্যও প্রয়োজনীয়।

কলমের এক খোঁচায় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কিউবাকে তালিকা থেকে বাদ দিতে পারেন। হ্যাঁ, বিষয়টি এতটাই সহজ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সময় বাইডেন বলেছিলেন, ওবামা প্রশাসনের বাতিল করা নীতি তিনি ফিরিয়ে আনবেন; এমনকি ট্রাম্পের আরোপ করা নানা ধরনের কঠোর অবরোধও তুলে নেবেন। কিন্তু তিনি এখনো তেমন কিছু করেননি, সম্ভবত এর কারণ রাজনৈতিক।

কিউবার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের গৃহীত নীতির মধ্যে একধরনের প্রতিহিংসাপরায়ণতা দৃশ্যমান। অথচ দ্বীপরাষ্ট্র কিউবা যে তার জনগণের প্রতি দায়িত্বশীল, তা করোনা অতিমারির সময় প্রমাণ করেছে। কিউবার জনস্বাস্থ্য সেবার মডেল সারা বিশ্বের জন্যই অনুকরণীয়। সন্ত্রাসবাদ নয়, বরং কিউবা বৈশ্বিক কল্যাণের পৃষ্ঠপোষক।