গাজার রাফায় ইসরায়েলের সম্ভাব্য পুরোদমে স্থল অভিযান দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্রের বোমার চালান স্থগিত করার অন্যতম কারণ
গাজার রাফায় ইসরায়েলের সম্ভাব্য পুরোদমে স্থল অভিযান দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্রের বোমার চালান স্থগিত করার অন্যতম কারণ

ইসরায়েলের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বোমার চালান স্থগিত করা কেন বড় হুঁশিয়ারি

বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র এমন একটি দেশ, ইসরায়েলের ওপর যার সত্যিকারের প্রভাব খাটানোর ক্ষমতা রয়েছে। অথচ এখন পর্যন্ত গাজা যুদ্ধ নিয়ে ঘনিষ্ঠতম মিত্র দেশটির পরামর্শের বেশির ভাগই গায়ে লাগায়নি দেশটি।

যুক্তরাষ্ট্রের সরকার বলছে, ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ সংগঠন হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের যুদ্ধে তার সমর্থন ‘ইস্পাতকঠিন’। তবে এ যুদ্ধে গাজায় বেসামরিক লোকজনকে রক্ষায় ইসরায়েলি বাহিনীর ব্যর্থতা ও উপত্যকাটিতে মানবিক ত্রাণ সরবরাহে বাধা দেওয়ায় বারবারই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে দেশটি।

গাজায় ইসরায়েলের চলমান যুদ্ধ সাত মাস অতিক্রম করেছে। এই সময়ে ওই ইস্যুতে ইসরায়েলের ওপর ধাপে ধাপে চাপ বাড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। একান্ত ঘরোয়াভাবে দিয়েছে নানা পরামর্শ। প্রকাশ্যে করেছে সতর্কও। আবার, জাতিসংঘে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আনা নিন্দাসূচক প্রস্তাবে ভেটো দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে যুক্তরাষ্ট্র। এসবই  শুধু নয়, যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম তীরের দখলকৃত ভূখণ্ডে ইসরায়েলি অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের মধ্যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।

গাজায় ইসরায়েলের চলমান যুদ্ধ সাত মাস অতিক্রম করেছে। এই সময়ে ওই ইস্যুতে ইসরায়েলের ওপর ধাপে ধাপে চাপ বাড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। একান্ত ঘরোয়াভাবে দিয়েছে নানা পরামর্শ। প্রকাশ্যে করেছে সতর্কও। আবার, জাতিসংঘে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আনা নিন্দাসূচক প্রস্তাবে ভেটো দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে যুক্তরাষ্ট্র।

এক মাস আগে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে উত্তেজনাকর ফোনালাপ হয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের। আলাপে বাইডেন নেতানিয়াহুকে বলেন, সীমান্ত পেরিয়ে গাজায় ত্রাণবাহী ট্রাকের প্রবেশে ইসরায়েল যদি বাধা দেয়, তবে দেশটিকে দেওয়া মার্কিন সমর্থন কমাবেন তিনি।

যদিও এ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, ইসরায়েল তার মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের এসব পরামর্শ ও চাপের বেশির ভাগই গা করেনি। তাই এখন ইসরায়েলের ওপর নিজের সবচেয়ে বড় ছড়ি ঘোরানো শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলে অস্ত্র ও গোলাবারুদ চালানের সবচেয়ে বড় জোগানদাতা। রীতিমতো আইন করে প্রতিবছর ইসরায়েলকে ৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন (৩৮০ কোটি) ডলারের অস্ত্র সরবরাহ করছে ওয়াশিংটন। লক্ষ্য, ইসরায়েলকে তার প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর বাড়তি সুবিধা পাইয়ে দেওয়া। ইসরায়েলকে অতিরিক্ত ১৪ বিলিয়ন (১ হাজার ৪০০ কোটি) ডলারের সামরিক সহায়তা দিতে গত মাসে বিল পাস করেছে মার্কিন কংগ্রেস।

এখন বাইডেন প্রশাসন প্রথমবারের মতো ইসরায়েলে অস্ত্রের চালান পাঠানো স্থগিত করেছে। প্রশাসনের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বিবিসিকে নিশ্চিত করেছেন, ২০০০ পাউন্ড ও অন্যান্য ওজনের হাজার হাজার বোমার সরবরাহ স্থগিত করা হয়েছে।

এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ইসরায়েলের কাছে অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র বিক্রির বিষয়ও পুনর্বিবেচনা করা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে এমন সরঞ্জামও, যার সহায়তায় সাধারণভাবে ফেলার উপযোগী বোমাকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম গোলায় পরিণত করা সম্ভব।

তাই প্রশ্ন উঠেছে, অবশেষে যুক্তরাষ্ট্র কেন ইসরায়েলের ওপর নিজের প্রভাব খাটানোর সম্ভবত সবচেয়ে বড় হাতিয়ারকে কাজ লাগাতে চাইছে। এর প্রথম উত্তর হলো, গাজার সর্বদক্ষিণের ও অতিঘনবসতিপূর্ণ শহর রাফায় ইসরায়েলের সম্ভাব্য সর্বাত্মক সামরিক অভিযান। যুক্তরাষ্ট্র ও অনেক পশ্চিমা দেশের আশঙ্কা, এমন অভিযানে বেসামরিক লোকজনের মধ্যে ব্যাপক প্রাণহানি ও মানবিক বিপর্যয় দেখা দেবে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন

মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, ইসরায়েলে তাঁরা যেসব বোমার চালান স্থগিত করেছেন, সেগুলো হয়তো রাফায় ব্যবহার করা হতো। ঘনবসতিপূর্ণ শহরাঞ্চলে এ বোমার ব্যবহার বিপর্যয় সৃষ্টিকারী পরিণতি বয়ে আনতে সক্ষম। যুক্তরাষ্ট্র রাফায় ইসরায়েলের অভিযান চায় না। অস্ত্রের চালান স্থগিত করাটা এ বার্তাকেই জোরাল করার আরেক উপায়। একজন মার্কিন কর্মকর্তা ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকাকে বলেছেন, ইসরায়েল যাতে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়, সে লক্ষ্যে এটি একটি ‘সতর্কতা’।

দ্বিতীয় উত্তর হলো, হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তি সমর্থন করতে ইসরায়েলের মন্ত্রিসভার ওপর চাপ বজায় রাখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠায় কায়রোয় বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে আলোচনা চলছে। যুদ্ধবিরতি নিয়ে সমঝোতায় রাজি না হলে ইসরায়েলকে যে খেসারত দিতে হবে, সম্ভবত সেটি আরও বাড়াতে চায় ওয়াশিংটন।

তৃতীয় কারণ নিশ্চিতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে জো বাইডেন এখন নিজ দলের ভোটারদের মধ্য থেকেই ভীষণ রকম চাপের মুখে। গাজায় ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও ইসরায়েলকে নিরবচ্ছিন্ন সমর্থন দিয়ে চলায় তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ এ ভোটাররা।

চলতি ২০২৪ সাল যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনী বছর। বিভিন্ন জনমত জরিপ ইঙ্গিত দিচ্ছে, গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ ডেমোক্র্যাট ভোটারদের একটি অংশ, বিশেষ করে তরুণ ভোটাররা নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে যেতে ও বাইডেনকে ভোট দিতে আগ্রহী নন। কম ভোটারের উপস্থিতি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বাইডেনের লড়াই কঠিন করে তুলতে পারে।

ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তা দেওয়া স্থগিত রাখার যেকোনো সিদ্ধান্ত ঝুঁকি তৈরি করতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও। কেননা, ইসরায়েল তার মিত্র দেশটির কথা ও কাজ আবারও উপেক্ষা করতে পারে। ভাবতে পারে, এসব ওয়াশিংটনের ধোঁকা এবং দীর্ঘমেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সমর্থন পেতে থাকবে তারা।

এটি হলে বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ক্ষয়ে আসার বিষয়টি খুব স্পষ্টভাবে প্রকাশ হয়ে পড়বে। তবে সমভাবে, ইসরায়েল তার সবচেয়ে বড় মিত্রের সঙ্গে সম্পর্কের ঐতিহাসিক ফাটল সৃষ্টির ঝুঁকি নিতে না চাইতে পারে। কেননা, অতিসম্প্রতি ইরানের হামলার সময় আকাশ প্রতিরক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সহায়তা নিয়েছে ইসরায়েল। এতে ইরানের শত শত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্রের হামলা তারা সফলভাবে ঠেকাতে পেরেছে।

শিগগিরই ইসরায়েলের সামনে আসছে এক বড় পরীক্ষা। মানবাধিকার লঙ্ঘনে ইসরায়েলি বাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করছে কি না, ওই সময় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর সে বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত দেবে। এ–সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন দ্রুতই প্রকাশিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

সর্বশেষে, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের একমাত্র মিত্র দেশ নয়। যুক্তরাষ্ট্র যদি ইসরায়েলে অস্ত্র বিক্রি বিলম্বিত করে, তবে অন্য দেশের ওপরও একই কাজ করার জন্য চাপ বাড়বে। এর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাজ্য। এ বিধিনিষেধ যতটা বাস্তবিক হবে, তার চেয়ে বেশি হবে প্রতীকী। কিন্তু ইসরায়েলকে বিশ্বে কূটনৈতিকভাবে একঘরে করতে ভূমিকা রাখবে এটি।