যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে চাইছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এ কারণে গাজায় একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে উপনীত হতে তিনি বিলম্ব করছেন, ডেমোক্র্যাট নেতাদের এমন উদ্বেগের মধ্যে গতকাল শুক্রবার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, এ বিষয়ে তিনি নিশ্চিত নন।
আগামী ৫ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।
গতকাল শুক্রবার হঠাৎই হোয়াইট হাউসের সংক্ষিপ্ত সংবাদ সম্মেলনে হাজির হয়েছিলেন বাইডেন। সেখানে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘তিনি (নেতানিয়াহু) নির্বাচনকে (যুক্তরাষ্ট্রের) প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন কি না, আমার তা জানা নেই, তবে আমি এটার ওপর নির্ভর করছি না।’
এরপর তিনি নিজের দীর্ঘদিনের মিত্রকে উদ্দেশ করে কয়েকটি কড়া কথা বলেন। বাইডেন বলেন, ‘আমি ইসরায়েলকে যতটা সহায়তা করেছি, ততটা আর কোনো প্রশাসন করবে না। কেউ না, কেউ না, কেউ না। এবং আমি মনে করি (নেতানিয়াহুর) এটা মনে রাখা উচিত।’
বাইডেন ও নেতানিয়াহুর মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে কয়েকজন ডেমোক্র্যাট নেতা সম্প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বাইডেন চান, ইসরায়েল আলোচনার মাধ্যমে গাজায় একটি যুদ্ধবিরতি এবং সেখান থেকে জিম্মিদের বাড়ি ফিরিয়ে আনতে একটি চুক্তিতে উপনীত হোক। কিন্তু নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির ক্ষতি করতে নেতানিয়াহু বাইডেনের ওই আহ্বান এড়িয়ে যাচ্ছেন বলে মনে করেন ওই নেতারা।
এ সপ্তাহের শুরুতে ডেমোক্র্যাট সিনেটর ক্রিস মুরফি সিএনএনকে বলেছিলেন, ‘ইসরায়েলের কয়েকটি পদক্ষেপ, প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর কয়েকটি পদক্ষেপ যে আমেরিকার নির্বাচনের সঙ্গে সম্পর্কিত, সেটা বুঝতে আপনাকে জাদুকর হতে হবে বলে আমার মনে হয় না।’
সম্প্রতি কয়েকটি জনমত জরিপেও একই আভাস পাওয়া গেছে। জরিপে দেখা গেছে, মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বাড়তে থাকা যুদ্ধ উত্তেজনা এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে একটি কূটনৈতিক চুক্তিতে উপনীত হতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে বাইডেন ও ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী কমলা হ্যারিস (ভাবমূর্তি) ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
গত এক বছরে আরব বংশোদ্ভূত আমেরিকানদের মধ্যে বাইডেনের গ্রহণযোগ্যতা দ্রুত হ্রাস পেয়েছে। মূলত ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের (অন্ধ) সমর্থনের কারণে তাঁরা ক্ষুব্ধ। আর এটা নভেম্বরের নির্বাচনে দলের সম্ভাবনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
বাইডেন কয়েক মাস ধরে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে একটি কূটনৈতিক চুক্তির চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কয়েকবার আলোচনায় একটি চুক্তির কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়ার ইঙ্গিতও দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা। গাজায় একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হলে, সেটা বাইডেন ও তাঁর দলের জন্য একটি বড় অর্জন হবে। যদিও এ ধরনের কোনো চুক্তির সম্ভাবনা দিন দিন ক্ষীণ হচ্ছে।
একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি না হওয়ার জন্য বাইডেন প্রশাসন বেশির ভাগ সময় গাজার ফিলিস্তিনিদের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের নিন্দা করেছে। তবে বাইডেন কখনো কখনো প্রকাশ্যেই এ বিষয়ে নেতানিয়াহুর প্রতিও তাঁর বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। যেমন সম্প্রতি বাইডেন অভিযোগ করে বলেছেন, একটি চুক্তিতে উপনীত হতে নেতানিয়াহু যথেষ্ট কিছু করছেন না।
অন্যদিকে নেতানিয়াহু গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তির কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া সম্পর্কিত ওয়াশিংটনের বক্তব্য উড়িয়ে দিয়েছেন।
এ মাসের শুরুতে নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘হামাস এখনো চুক্তিতে উপনীত হওয়ার পর্যায়ে পৌঁছায়নি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, চুক্তি বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই।’
অথচ নেতানিয়াহুর এই বক্তব্যের মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে যুক্তরাষ্ট্রের একজন কর্মকর্তা বলেছিলেন, যুদ্ধবিরতি চুক্তির কাজ ৯০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে।
বাইডেন-নেতানিয়াহু পরস্পরকে কয়েক দশক ধরে চেনেন। কিন্তু তাঁদের এই সম্পর্কে চিড় ধরেছে ও দূরত্ব বাড়ছে। সেই তুলনায় রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে নেতানিয়াহুর সম্পর্ক বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ।
দুই দিন পরই গাজা যুদ্ধের বর্ষপূর্তি। এই এক বছরে মাত্র এক সপ্তাহের (গত বছর নভেম্বরে) যুদ্ধবিরতি ছাড়া গাজায় ইসরায়েলের হামলা থামেনি। হামলা এখনো অব্যাহত আছে; বরং ইসরায়েল এখন প্রতিবেশী দেশ লেবাননেও সামরিক অভিযান শুরু করেছে।
কয়েক সপ্তাহ ধরে তীব্র বিমান হামলার সঙ্গে দেশটি এখন লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে স্থল অভিযানও শুরু করেছে। ইসরায়েলের লক্ষ্য লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহকে ধ্বংস করা।
ইরান–সমর্থিত হিজবুল্লাহ গাজা যুদ্ধের শুরুতেই হামাসকে সমর্থন দেয় এবং ইসরায়েলের সীমান্ত এলাকায় হামলা চালাতে থাকে।
হিজবুল্লাহকে দমন করতে ইসরায়েল কয়েক সপ্তাহ ধরে লেবাননে তীব্র বিমান হামলা চালাচ্ছে। তাদের হামলায় হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ নিহত হয়েছেন। নাসরুল্লাহর হত্যার প্রতিশোধ নিতে ইরান ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে। দুই চিরশত্রু ক্রমাগত পরস্পরকে ধ্বংস করে দেওয়ার হুমকিও দিয়ে যাচ্ছে। ইরানের হামলার প্রতিশোধ নিয়ে ইসরায়েলে দেশটিতে পাল্টা হামলা করে বসে কি না, তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
গতকালের সংবাদ সম্মেলনে হাজির হয়ে বাইডেন বলেন, ‘হামলার জবাব দিতে ইসরায়েলিরা যা করতে চলেছেন, সেটা বন্ধ করা ঠিক হবে না। তবে আমি যদি তাদের জায়গায় থাকতাম, তবে আমি তেল ক্ষেত্র বাদ দিয়ে অন্য কোথাও হামলার কথা ভাবতাম।’
ইরানের তেল ক্ষেত্রে হামলার সম্ভাব্যতা নিয়ে আলোচনা করছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল। বাইডেন গত বৃহস্পতিবার এ কথা বলার পর বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়ে যায়।