উত্তর আমেরিকায় অন্তত চার শিখ নেতাকে হত্যার ষড়যন্ত্রে এক ভারতীয় নাগরিককে অভিযুক্ত করেছেন মার্কিন কৌঁসুলিরা।
ভারতীয় নাগরিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের এ ঘটনার সঙ্গে চলতি বছরের জুনে কানাডায় শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জর হত্যার যোগসূত্র রয়েছে।
ফলে নিজ্জর খুনের আগের দিনগুলোতে এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দারা কী তথ্য জানতেন, সে ব্যাপারে প্রশ্ন উঠেছে।
গত ১৮ জুন কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় একটি শিখ মন্দিরের বাইরে নিজ গাড়িতে খুন হন খালিস্তানপন্থী নেতা নিজ্জর। কানাডার এই শিখ নেতাকে দুই বন্দুকধারী গুলি করে হত্যা করেন। গুলির পর তাঁর রক্তাক্ত নিথর দেহ গাড়ির স্টিয়ারিং হুইলে পড়ে ছিল।
এদিনই এ ঘটনার একটি ভিডিও দেখেছিলেন ভারতীয় নাগরিক নিখিল গুপ্ত (৫২)। পরে তিনি ভিডিওটি অপর এক ব্যক্তিকে পাঠান। এই ব্যক্তিকে অন্য একটি দেশে আরেকটি খুনের জন্য নিখিল ভাড়া করেছিলেন বলে অভিযোগ।
পরদিন ওই ব্যক্তিকে (ভাড়াটে খুনি) নিখিল ফোন করে বলেছিলেন, কানাডার এই শিখ নেতা (নিজ্জর) হত্যার তালিকায় ছিলেন।
নিখিল বলেছিলেন, ‘আমাদের অনেক লক্ষ্যবস্তু আছে।’
গত বুধবার মার্কিন কৌঁসুলিরা অভিযোগপত্রটি প্রকাশ করেন। অভিযোগপত্রে কথিত এই কথোপকথনের উল্লেখ আছে।
মার্কিন বিচার বিভাগ নিখিলকে নিউইয়র্কে বসবাসরত যুক্তরাষ্ট্র-কানাডার দ্বৈত নাগরিক শিখ নেতা গুরপতবন্ত সিং পান্নুনকে হত্যার ষড়যন্ত্রে অভিযুক্ত করেছেন।
অভিযোগপত্রের তথ্যানুযায়ী, ভারত সরকারের এক কর্মকর্তার নির্দেশনায় খালিস্তানপন্থী নেতা পান্নুনকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল।
পান্নুনকে হত্যার পরিকল্পনাটি ব্যর্থ হয়। গত ৩০ জুন চেক প্রজাতন্ত্রে নিখিল গ্রেপ্তার হন।
পান্নুনকে হত্যার জন্য নিউইয়র্কের ‘ভাড়াটে খুনিকে’ এক লাখ মার্কিন ডলার দিতে চেয়েছিলেন নিখিল। এই ‘ভাড়াটে খুনি’ আসলে ছিলেন একজন ছদ্মবেশী মার্কিন এজেন্ট।
১৫ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্রে নিজ্জর হত্যার বিষয়ে নতুন তথ্য রয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে এ হত্যার আগে কখন কে কী জানতেন, সে বিষয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে।
ভারতে শিখ সম্প্রদায়ের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গড়তে চান খালিস্তানপন্থীরা। নিজ্জর ও পান্নুন উভয়ের নাম ভারত সরকারের করা ‘সন্ত্রাসীর’ তালিকায় আছে।
নিজ্জর হত্যার কয়েক মাস পর গত সেপ্টেম্বরে এ ইস্যুতে ভারত ও কানাডার মধ্যে ব্যাপক কূটনৈতিক বিরোধ দেখা দেয়।
সে সময় কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো দেশটির পার্লামেন্টে বলেছিলেন, নিজ্জর হত্যায় ভারতের হাত থাকার বিষয়ে তাঁর সরকারের কাছে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য রয়েছে।
ট্রুডোর অভিযোগ ‘অযৌক্তিক’ বলে নাকচ করে ভারত।
নিজ্জর হত্যার ইস্যুতে পরবর্তী সময়ে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কে ব্যাপক অবনতি ঘটে।
প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো ভারতের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তোলেন, তার পক্ষে তথ্যপ্রমাণ হাজির করার জন্য তিনি চাপের মুখে পড়েন।
যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় নাগরিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের প্রেক্ষাপটে গত বুধবার ট্রুডো বলেন, এখন ভারতের উচিত কানাডার অভিযোগকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় নাগরিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পদক্ষেপটি ট্রুডোর দাবিকে জোরালো করেছে।
কানাডার অটোয়ার কার্লেটন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বিষয়ের অধ্যাপক স্টেফানি কারভিন বিবিসিকে বলেন, এখন যে তথ্যপ্রমাণ সামনে এল, তা গত সেপ্টেম্বরে ট্রুডো যা বলেছিলেন, তার চেয়ে অনেক বেশি জোরালো। মার্কিন অভিযোগপত্রে স্পষ্ট, চারজনকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। এর মধ্যে তিনজনই কানাডার। নিজ্জর হত্যাকাণ্ড বিচ্ছিন্নভাবে ঘটেনি।
ট্রুডো যখন ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিলেন, তখন কানাডার মিত্রদেশগুলোর কাছ থেকে জোরালো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি।
নিজ্জর হত্যাকাণ্ড নিয়ে মার্কিন কর্মকর্তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। তবে তাঁরা ট্রুডোর দাবির সঙ্গে সুর মিলিয়ে কথা বলেননি। আবার তাঁরা সরাসরি ভারতের নিন্দা জানানো থেকেও বিরত ছিলেন।
কিন্তু এখন জানা গেল, বিষয়টি ট্রুডোর প্রকাশ্যে আনার কয়েক সপ্তাহ আগেই ভাড়াটে খুনি দিয়ে শিখ নেতাদের হত্যার চক্রান্তসংক্রান্ত মার্কিন তদন্তের ব্যাপারে হোয়াইট হাউস অবগত ছিল।
একজন জ্যেষ্ঠ মার্কিন কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে এ বিষয়ে তাঁর উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন।
‘কানাডায় একটি বড় লক্ষ্যবস্তু আছে’
মার্কিন কর্মকর্তাদের ভাষ্য, নিখিল আগে আন্তর্জাতিক মাদক ও অস্ত্র পাচারের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এক ব্যক্তিকে হত্যার ব্যবস্থা করতে ২০২৩ সালের মে মাসে এক ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তা তাঁকে নিয়োগ দেন।
মার্কিন অভিযোগপত্রে লক্ষ্যবস্তুর নাম উল্লেখ করা হয়নি। তবে জানা গেছে, এ হত্যার লক্ষ্যবস্তু ছিলেন নিজ্জরের সহযোগী পান্নুন।
অভিযোগপত্রের তথ্যানুসারে, ভারত সরকারের ওই কর্মকর্তার নির্দেশ অনুসারে কয়েক সপ্তাহ ধরে পান্নুনের গতিবিধির ওপর নজর রাখছিলেন নিখিল। তিনি কথাবার্তায় নিজেকে ‘জ্যেষ্ঠ মাঠ কর্মকর্তা’ হিসেবে বর্ণনা করছিলেন।
মার্কিন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কীভাবে কথিত এ হত্যা চক্রান্ত উদ্ঘাটন করল, তার বিবরণ অভিযোগপত্রে রয়েছে। নিখিলের ‘ভাড়াটে খুনি’ ছিল তাদেরই ছদ্মবেশী এজেন্ট।
পান্নুনকে হত্যার ষড়যন্ত্রটি এগিয়ে যাচ্ছিল। এমনকি পান্নুনের পর আর কাকে কাকে হত্যা করা হবে, তার একটি দীর্ঘ তালিকার ইঙ্গিত পর্যন্ত দিয়েছিলেন নিখিল।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, গত জুন মাসে নিখিল এক ফোনকলে বলেছিলেন, আরও একাধিক কাজ (হত্যা) আছে। সম্ভাব্য এ কাজগুলোর মধ্যে আন্তসীমান্ত ‘অপারেশন’ অন্তর্ভুক্ত ছিল।
গত ১২ জুন নিখিল মার্কিন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার এজেন্টকে বলেছিলেন, কানাডায় একটি বড় লক্ষ্যবস্তু আছে। এর ছয় দিন পর গত ১৮ জুন কানাডায় নিজ্জর খুন হন।
কানাডার জাতীয় পুলিশ ও রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ এখনো নিজ্জর হত্যার তদন্ত করছে। মার্কিন অভিযোগপত্রের বিষয়ে তারা কোনো মন্তব্য করেনি।
যুক্তরাষ্ট্রের অভিযুক্ত চক্রান্তকারীরা নিজ্জর হত্যায় জড়িত ছিলেন, এমনটা অভিযোগ করেননি মার্কিন কৌঁসুলিরা। তবে তাঁদের ভাষ্য, নিজ্জর হত্যার পরপরই নিখিল ও তাঁর ভারতীয় নিয়োগকর্তা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন।
মার্কিন অভিযোগপত্রের তথ্যানুসারে, ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তাকে নিখিল বলেছিলেন, নিজ্জর হত্যায় তাঁর অংশ নেওয়ার ইচ্ছা ছিল।
নিজ্জর হত্যার পরই যুক্তরাষ্ট্রের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার এজেন্টকে ফোন করেছিলেন নিখিল। তিনি এজেন্টকে বলেছিলেন, কানাডায় একটি বড় লক্ষ্যবস্তুর যে কথা কয়েক দিন আগে উল্লেখ করেছিলেন, তিনি নিজ্জর।
নিখিল বলছিলেন, ‘এই সেই লোক। আমি আপনাকে ভিডিও পাঠাচ্ছি। অন্য লোক এ কাজ (হত্যা) করেছে।’
মার্কিন আদালতের নথির ইঙ্গিত, নিজ্জর হত্যার ঘটনাটি নিখিল উৎসাহিত করেছিল বলে মনে হয়। কারণ, তিনি মার্কিন এজেন্টকে বলেছিলেন, পান্নুনকে দ্রুত শেষ করতে হবে। এরপর জুন মাস শেষ হওয়ার আগেই তাঁদের আরও তিনটি কাজ করতে হবে। তিনটি কাজই কানাডার।
মার্কিন অভিযোগপত্রে থাকা তথ্য নিজ্জরসহ কানাডার শিখ নেতাদের জীবনের হুমকির বিষয়ে নতুন প্রশ্ন সামনে এনেছে।
নিজ্জরকে তাঁর জীবনের হুমকির বিষয়ে কানাডার আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সতর্ক করেছিল বলে জানা যায়।
তবে কানাডীয় নাগরিকদের জীবনের হুমকির বিষয়ে গোপনে সংগ্রহ করা তথ্য মার্কিন গোয়েন্দারা কতটা কানাডাকে জানিয়েছিলেন, তা স্পষ্ট নয়।
কানাডার গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল গভর্ন্যান্স ইনোভেশনের জ্যেষ্ঠ ফেলো ওয়েসলি ওয়ার্ক বিবিসিকে বলেন, মার্কিন গোয়েন্দাদের পাওয়া তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে কানাডার কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়নি—বিষয়টি তাঁর কাছে অবিশ্বাস্য লাগছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র-কানাডার আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মধ্যে খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তাঁর মতে, এ ক্ষেত্রে সম্ভবত গোয়েন্দা তথ্য জানানোর ব্যাপারে দ্রুততার কমতি ছিল।
মার্কিন অভিযোগপত্র ও ট্রুডোর অভিযোগ এই ইঙ্গিত দেয়, নিজ্জরকে হত্যায় সম্ভবত একাধিক ঘাতক দল ছিল। এর মধ্যে একটি ঘাতক দল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ এড়িয়ে নিজ্জর হত্যার মিশন সম্পন্ন করতে পেরেছে।